সংস্কৃত শব্দ ‘নৃ’ থেকে নর আর ‘নৃ + ঈ’ থেকে নারী শব্দের উৎপত্তি। এই নারী শব্দের সমার্থক শব্দ যেমন স্ত্রীলোক বোঝায় তেমনি এর সমার্থক রূপে ‘কামিনী’ ‘অবলা’, ‘রমণী’ ইত্যাদি শব্দও বোঝায়। ভাবগত দিক থেকে এই শব্দগুলো পুরাকাল থেকেই নারীকে বোকা ও সরল হিসেবে অভিহিত করার জন্যই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ছোট বেলা থেকে নিজেদের অথবা প্রতিবেশী লোকেদের মুখে নারী দুর্বল, নারী অসহায়, নারী অক্ষম…এসব শুনতে শুনতে বেড়ে উঠেছিল আমাদের সমাজে তখনকার দিনের নারীরা। দীর্ঘদিন ধরে পুরুষশাসিত সমাজের তৈরি করে দেওয়া এই কথাগুলো শুনতে শুনতে বদ্ধমূল ধারণার ছাপ পড়ে যেতো নারীদের মননে– মগজে। যেন নিজস্ব চিন্তা –চেতনা – স্বপ্ন বলে কিছু থাকতে নেই। ইচ্ছে নেই। অধিকার নেই। নিজ থেকে কিছুই করার নেই জীবনে।
এমন অবস্থায় একসময় ভোঁতা হয়ে যাওয়া মগজ তাদের এটাই ভাবতে বাধ্য করে যে, স্বামী হচ্ছেন প্রভু। পতি হচ্ছেন পরম গুরু।এই প্রভুর অধীনে থেকে নিজপায়ে ভর করে চলতে পারা সম্ভব নয় কখনো। আর প্রয়োজনটাই বা কি? গৃহকোণের নিরাপত্তায় এই তো বেশ আছি! পতিসেবা, সন্তান লালনপালন, আর সংসার সামলানোই তো স্ত্রীলোকের প্রধান ধর্ম। এর অন্যথায় ঘোর পাপ!
‘পরনির্ভরশীলতাই আমার ধর্ম’ এই হয়ে যেতো তাদের নীতি। ধীরেধীরে এই পরনির্ভরশীলতার এক চরম পর্যায়ে গিয়েও তাদের মনে থাকতো না যে, স্বাধীনভাবেও বেঁচে থাকা যায়। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেও নেয়া যায়।
বহু ধরনের সামাজিক অবরোধ, কুসংস্কার আর শিক্ষার অভাবের কারণে যুগযুগ ধরে বাঙালি নারীর অগ্রসর হওয়া অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। সন্তান জন্মদান ও তাদের লালনপালন, স্বামীসেবা ও গৃহস্থালী কর্মের মধ্যেই জীবনকে বৃত্তাবদ্ধ করে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনোই নারীকে তার যোগ্য মর্যাদা বা স্থান দেয়নি। নারী ও পুরুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই যে সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য, এই চরম সত্যটি আমাদের সমাজ কখনো মেনে নেয় নি। নারীবিষয়ক ধর্মের হাজারো বেড়াজাল যেন নারীদের নিয়ন্ত্রণ করতেই সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যদিকে পুরুষদের ক্ষেত্রে ধর্ম, সমাজ যুগপৎভাবেই আশ্চর্যরকম উদার।
এমতাবস্থায় অসীম মনোবলের অধিকারী গুটিকয় কিছু নারী সমাজের এই অন্যায় নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল উপেক্ষা করে বেরিয়ে আসতে চাইলেন। ক্ষেত্রবিশেষে সক্ষমও হলেন। যদিও সংখ্যায় এরা ছিলেন অত্যন্ত নগণ্য। এই স্বাধীনচেতা নির্ভীক নারীদের ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে উনিশ শতকের প্রথম দিকে নারীদের অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছিলো। আগে পৃথিবী জুড়ে নারীদের ভোটাধিকার পর্যন্ত ছিলো না। ১৯১৮ সালে প্রথম ইউরোপে নারীদের ভোট দেবার অর্থাৎ নিজেদের স্বাধীন মতবাদ জানানোর অধিকার স্বীকৃত হয়েছিলো। বর্তমান যুগে আমরা এক নবপরিবর্তিত বিশ্বে বসবাস করছি। সভ্যতার সাথে সাথে প্রযুক্তি ও শিক্ষার যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি আমাদের নারীদের অবস্থানেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই নারীদের বাদ দিয়ে জাতির উন্নতি যে অসম্ভব তা সর্বজনস্বীকৃত।
এই প্রসঙ্গে বলি, পৃথিবীতে সৃষ্টির আদি পেশা কৃষিকাজ শুরু হয়েছিলো কিন্তু নারীদের হাত ধরেই। যদিও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই সত্যটি কখনো সেভাবে স্বীকার করেনি।
যেটা বলছিলাম, আজকের নারীসমাজ কিন্তু এখন আর সেভাবে স্বামীসেবা, সন্তান প্রতিপালন আর গৃহকর্মে নিজেদের আবদ্ধ করে রাখেননি। তাঁরা এখন গৃহকোণ থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে সমৃদ্ধি আর উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে শিক্ষা, সাহিত্য সংস্কৃতি, বিজ্ঞান সহ সর্বক্ষেত্রে নারীদের অসামান্য অবদান রয়েছে। শিক্ষা–দীক্ষায়, জ্ঞানে– প্রজ্ঞায়, প্রোজ্জ্বল নারীসমাজকে নিয়ে সারাবিশ্বই আজ গর্ব করে। এই প্রসঙ্গে সমাজে নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাও যথাযথভাবে হয়েছে বলে দাবি করেন অনেকে।
নারীদের প্রতিষ্ঠাতো অবশ্যই হয়েছে, তবে তা সম্পূর্ণরূপে বা যথাযথভাবে হয়েছে কি?
অতীতে নারীদের মূল্যায়ন করা তো দূরের কথা, কন্যাসন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করার পরপরই নিষ্ঠুর সমাজ তাদের দিকে ছুঁড়ে দিতো এক প্রতিকূল পরিবেশ।
বলা হতো, ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’। কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়া ছিলো জন্মদাত্রী মায়ের জন্য অভিশাপস্বরূপ। কন্যাশিশু নামক সেই ভাবী নারীকে জন্ম দেওয়ার জন্য অনেক লাঞ্চনা– গঞ্জনার শিকার হতে হতো মা নামক সেই নারীকে। এক অর্থে, অঙ্কুর থেকে পরিপূর্ণ নারীরূপে প্রস্ফুটিত হওয়াটাই এই নারীসত্তার জন্য ছিলো এক বিশাল ব্যাপার।
বর্তমানে অবশ্য এতটা না হলেও আমাদের সমাজে বা বেশিরভাগ পরিবারগুলোতে আজও কন্যাসন্তান ব্রাত্য।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর কথা না হয় থাক, আমার পরিচিত বহু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারেও দেখেছি, কন্যাসন্তান জন্ম নিলে যেন পুরো পরিবারে শোকের ঝড় বয়ে যায়! তথাকথিত অনেক শিক্ষিত পরিবারেও কন্যাসন্তান হয় জন্মাবধি শিক্ষা–দীক্ষা সবকিছুতেই অবহেলার শিকার। তাদের ধারণা, যেখানে পুত্রসন্তান হচ্ছে বংশের বাতি। তারা বড় হয়ে অর্থোপার্জন করে পরিবার চালাবে, পিতার কাঁধের বোঝা হালকা করবে। পরিবারের ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে তাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার অধিকার আছে তাদের। আর মেয়েদের তো জন্মই হয় পরের জন্য। তাই পরের ঘরের বাসিন্দার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে এত ব্যয় করে লাভ কি? কাজ চালানো গোছের লেখাপড়া কিছু শিখিয়ে তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে পরের হেফাজতে দিয়ে দেওয়াই হচ্ছে সবার জন্য মঙ্গল। বর্তমানে শহুরে সমাজে বাল্যবিবাহ নেই। মেয়েদের পায়ে সেরকম বিধিনিষেধের শেকলও পরানো নেই। তবুও সূক্ষ্ম হোক বা মোটাদাগেই হোক পুত্রসন্তান আর কন্যাসন্তানের মাঝে একটা ফারাক থাকেই অনেক পরিবারে।
এরপর আসে বিয়ের পরের কথা। যদি বিয়ের আগেই উচ্চশিক্ষিত হয়ে কোন নারী শ্বশুরবাড়িতে আসে, অনেকক্ষেত্রে সেখানেও তার চাকরি করার সুযোগ মেলে না। কারণ, এখনো অনেক শিক্ষিত পরিবারেই একটা অশিক্ষিত চিন্তাধারা বিরাজ করে। সেটা হলো, ‘ঘরের বৌ কাজ করতে বাইরে গেলে ঘর সামলাবে কে? তখন তো সন্তানের অযত্ন হবে। বিনা যত্নে, বিনা শাসনে সন্তান তো উচ্ছন্নে যাবে’!
ব্যস! অতএব সেই পতিসেবা, সন্তান প্রতিপালন, আর গৃহকর্মে মনোনিবেশ করা ছাড়া আর উপায়ই বা কি?
এ ছাড়াও আছে প্রতিপদেই নারীদের নিরাপত্তার ভয়। নিরাপত্তা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সেটা জীবনের হোক কিংবা সম্মানের। কিন্তু নারীদের সেই মৌলিক অধিকার প্রাপ্তিটুকুও এই সমাজ নিশ্চিত করেনি । রাস্তাঘাটে, এমনকি যানবাহনে চলাচলরত অবস্থায়ও আজকাল নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। তাই বাড়ি থেকে মেয়েদের একা বের হওয়া কিংবা একটু রাত করে বাইরে থাকলে পিতামাতার নাভিশ্বাস উঠে যায়! মেয়েটা ঠিক আছে কিনা, অথবা নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারবে কিনা, এসব ভাবতে ভাবতে তারা নিজেদের অসুস্থ বানিয়ে ফেলেন।
আমাদের বর্তমান সমাজ নিজেকে যতই আধুনিক ভাবুক না কেন, মেয়েদের ব্যাপারে কিন্তু সে এখনো যথেষ্টই সেকেলে আছে। অবিবাহিত একা মহিলা, বিধবা, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে এমন নারীদের একটুখানি হলেও বাঁকা চোখে দেখে এই সমাজ। তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষগুলো অতি সাবধানী আর অতিমাত্রায় যত্নশীল!
সমাজের বেশিরভাগ মানুষ একা মহিলাকে নানাভাবে অপদস্ত করে। প্রত্যেকটা মুহূর্তে তাকে বোঝানো চলে যে, একা থাকা মহিলারা ভালো চরিত্রের হয় না। যদি কেউ ‘সিঙ্গেল মাদার’ হন তখন তাঁর সন্তানদেরও সহ্য করতে হয় নানা গঞ্জনা। কেন তাদের বাবা থেকেও নেই, প্রতিমুহূর্তে এই একটা প্রশ্নে জর্জরিত হতে থাকে তারা সমাজের চাপেই বাড়তে থাকে তাই তাদের হতাশা। উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ পরিবারেই এখনো নারীকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কখনো সামান্য পরিমাণ সম্পত্তি দিয়েই নিষ্পত্তি করা হচ্ছে, আবার কখনো সম্পূর্ণভাবেই বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের।
বর্তমান সমাজ নিজের প্রয়োজনে ছোটোখাটো পরিবর্তন এনে মেয়েদের কিছু সুযোগ সুবিধা দিলেও মূল কাঠামোয় কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি। বদলায়নি নারীদের নিয়ে সমাজের মানসিকতাও। মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এখনো উনিশ শতকের ভিক্টোরীয় সামাজিক আদর্শ সযত্নে লালন করে চলেছে নতুন নতুন রাংতায় মুড়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরা নিজেদের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখতে এখনো সদাসক্রিয়। আমাদের সমাজে আলোকিত কিছু নারী এবং অবশ্যই কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ আছেন যাঁরা নারীদের নিয়ে প্রচলিত এই ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেন, কিছু পুরাতন ধারণা ভাঙতে সাহায্য করেন, নারীদের সম্পর্কে মানসিকতা বদলের কথা বলেন। ফলে নারীবিরোধী কিছু আইন পরিবর্তন হয়, নারীবান্ধব নতুন কিছু আইন সংযুক্ত হয়। কিন্তু তার কোন সুফলই সমাজের তৃণমূল স্তরে পৌঁছায় না। এর কারণ, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন এখনো হয়নি। সমাজের সিংহভাগ মানুষের মানসিকতা পড়ে আছে এখনো সেই মধ্যযুগের স্তরেই। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী যে তিমিরে ছিলো সে তিমিরেই রয়ে গেছে। যতদিন না নারীদের নিয়ে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে ততদিন নারীর অবস্থার পরিবর্তনও আশা করা যায় না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার