নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ

| রবিবার , ১৭ জুলাই, ২০২২ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা উপায়ে নারীরা অবদান রেখেছে, বিশেষ করে নারী তার শ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় শ্রমবাজারের সাপেক্ষে নারীর অবদান বিশ্লেষণ করতে চাইলে স্বীকৃত ও অস্বীকৃত উভয় প্রকার অবদানকেই বিবেচনায় আনা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, গত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশে নারী পোশাক শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য, তবে পোশাক শিল্প ছাড়াও কৃষি কিংবা সেবা খাত, বিশেষ করে খামারবহির্ভূত কৃষি কিংবা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে নারী শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যদিও সে অবদানের বিষয় খুব একটা আলোচিত হতে আমরা দেখি না। তবে অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে গৃহস্থালি কাজের ক্ষেত্রে নারীর অবদান, যা কিনা অর্থনীতি কিংবা সামাজিক মানদণ্ডের বিচারেও অস্বীকৃত ও অপ্রদর্শিত। সামপ্রতিক সময়ে গৃহস্থালি ও সেবাকাজে নারীর অবদানের বিষয়টিকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি আলোচনায় এলেও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ-জাতীয় কাজকে গুরুত্বহীন ও অর্থনৈতিকভাবে অর্থবহ হিসেবে কখনই বিবেচনা করা হয়নি। যদিও গত ৫০ বছরে এর মূল্যমান হিসাব করলে বোঝা সম্ভব যে অর্থনীতিতে এ ধরনের কাজের গুরুত্ব কতটা ব্যাপক।

এতো অগ্রগতির পরও সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় এই, নারী-পুরুষ ব্যবধান সূচকে পিছিয়েছে বাংলাদেশ। গত ১৫ জুলাই আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিকার আর অংশগ্রহণের প্রশ্নে নারী-পুরুষের ব্যবধান ঘোচানোর ক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সূচকে এক বছরে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও সবচেয়ে ভালো অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে।

ডব্লিউইএফ-এর ২০২২ সালের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ৬ ধাপ পিছিয়ে বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে ৭১ নম্বরে নেমে গেছে। গতবছর এই তালিকায় বাংলাদেশ ৬৫ নম্বরে ছিল। তার আগের বছর ছিল ৫০ তম অবস্থানে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম তাদের এই লিঙ্গ সমতা সূচক প্রকাশ করে আসছে ২০০৬ সাল থেকে। অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন- এই চার মাপকাঠিতে নারী-পুরুষের বৈষম্য বিবেচনা করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সূচকে একটি দেশের অবস্থান নির্ধারণ করা হয় ১ ভিত্তিক স্কেলে, যেখানে ১ মানে হল পুরো সম অধিকার, আর শূন্য মানে পুরোপুরি অধিকার বঞ্চিত। এই হিসাবে বাংলাদেশের মোট স্কোর এবার ০.৭১৪, যা গতবছর ছিল ০.৭১৯। প্রথম বছরে, অর্থাৎ ২০০৬ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ০.৬২৭।

গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান গতবছর ছিল সপ্তম। এবার দুই ধাপ পিছিয়ে নবম স্থানে নেমে এসেছে বাংলাদেশ, যদিও স্কোর আগের মতই ০.৫৪৬ রয়েছে। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ গতবারের ১৪৭তম অবস্থান থেকে ছয় ধাপ এগিয়ে ১৪১তম অবস্থানে উঠে এসেছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বেড়েছে, সূচকের ১২১তম স্থান থেকে বাংলাদেশ নেমে গেছে ১২৩তম স্থানে। স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, এ দিক দিয়ে বাংলাদেশ ১৩৪ থেকে উঠে এসেছে ১২৯তম স্থানে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, উচ্চশিক্ষা, দক্ষতা, জীবিকা, সম্পদ, রাজনৈতিক ক্ষমতা, পরিবার ও সমাজে অবস্থান-এ ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশের নারীরা এখনো পুরুষের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে আছেন। নারী-পুরুষের সমান সুযোগ, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এখনো গোড়ার সমস্যা। গত কয়েক দশকে নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে। সাফল্য আছে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক পরিস্থিতিতেও। পাশাপাশি কিন্তু বড় সমস্যা হয়ে আছে নারীর প্রতি সহিংসতা, যা কিনা অর্জনগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলছে। নারী অধিকার-কর্মী ও গবেষকেরা আরও বলছেন, বৈষম্য এবং বৈষম্যের মানসিকতা দূর করে নারীর অবস্থান শক্তিশালী করা না গেলে এ সহিংসতা প্রতিরোধ করা যাবে না। উচ্চতর শিক্ষা ও দক্ষতা, মানসম্মত জীবিকার সুযোগ, আয় ও সম্পদ, রাজনৈতিক ক্ষমতা-এসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানো আগামী দিনগুলোতে তাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। সার্বিকভাবে সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি দূর করার কার্যকর কৌশল ঠিক করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে