আমাদের আকাশ কোবাল্ট ব্লুর সাথে সাদা মিলে একটা ফ্যাকাসে নীলরঙ ধরেছে, মনে হচ্ছে শোকের বাড়ির শামিয়ানার তলায় বসে বিষাদের কিচ্ছা শুনছি। এমন বিষণ্ন সময়গুলোতে আমি নবনীতার দিকে হাত বাড়াই। বিষাদের ভেতর বসে কীভাবে ঝলমল করতে হয়, সে-মন্ত্রণা নিতে বসেছি ভালবাসার বারান্দায়। এই ভালবাসার বারান্দায় বসে নবনীতা খুলে দেন তাঁর অন্তরমহল। কবিতায় নবনীতা যেন জল কলকল নদী। নিজের কবি পরিচয়টা ওঁর সমস্ত প্রেমের কেন্দ্রে, অথচ গদ্যে, উপন্যাসে, গল্পে, শিশুসাহিত্যে এবং গবেষণায় ভীষণ সাবলীল তিনি, মনেই হয় না মূলত তিনি কবি।
আবেগে ঢলে পড়া অমন ভেজামন নিয়ে কি দারুণ সব বাক্যে বেঁধেছেন যুক্তিতর্ক, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি থেকে ভ্রমণ অথবা ব্যক্তিগত জীবন। তাঁর অনায়াস গদ্যের সামনে পাঠক নিজেকেও খুঁজে নিয়ে বাধাহীন মিশে যেতে পারেন তাঁর সাথে। সভাসমিতি টিভিপর্দা, সাহিত্য আলোচনায় মুখর নবনীতা তাঁর লেখার টেবিলেও ভীষণ প্রাণবন্ত। এতটাই প্রাণবন্ত যে ‘ভালো-বাসার বারান্দা’ খুলে দু-চার পাতা এগুলোই ওঁর ঘরোয়া মেয়ের চরিত্রটা বুঝতে পারা যায়। বাসার সবচেয়ে দুরন্ত আর মুখরা মেয়েটির অবয়ব একদম মিলে যাবে নবনীতার সাথে।
সেই চেনা অবয়বের নবনীতাই নারীসত্তাটিকে মেলে ধরেছেন চারপাশ থেকে। নারীর মনকে পরিমিত আবেগ, যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেচনা দিয়ে পরিমাপের ক্ষমতা তাঁর অনন্য। ষোড়শ শতাব্দীর কবি চন্দ্রাবতী বাংলায় প্রথম নারী যিনি রামায়ন বিনির্মাণ ঘটান সীতাকে কেন্দ্রে রেখে। চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণে রামের দেবত্ব ঘুচে গিয়ে তার নির্মমতা, পাপাচার, বিকৃত মস্তিষ্ক এরকম নানারূপে তুলে ধরা হয়েছে। চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণ এবং সারা ভারতবর্ষের নারীদের রচিত সীতাকেন্দ্রিক উপকথা সীতার গান নবনীতার ভাবনার জগৎকে আলোড়িত করে। সেই আলোড়নে নবনীতা খুলে দেবেন রামায়নের নতুন পাঠ ‘সীতা থেকে শুরু’।
‘বামাবোধিনী’ উপন্যাসের পাতায় তিনি লিখছেন ‘বেশিরভাগ সময়ে আমরা চোখ বুজে থাকতে চাই।’ আমাদের বোজা চোখের পাতা জোর করে খুলে দিয়ে নবনীতা পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক রামতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন নির্ভয়ে। নারীকে ভাবনার কেন্দ্রে রেখে ‘রাম নাম সত্য হ্যায়’ র দেশে বসে রামের দিকে তাক করা প্রশ্নবাণ এই সময়ের নারীর মনোভাবের প্রতিফলন। সমাজে, রাজনীতিতে, পরিবারে নারীর অবস্থান নিয়ে পরিষ্কার কথা বলার সাবলীলতা এবং পাঠকের ভাবনার জায়গা তৈরি করে দেয়ার অনমনীয়তাই নবনীতার অলংকার ।
নারীর মন তাঁর নিজের বুকেও ভীষণ সজাগ কিন্তু বিচার বিবেচনার বাইরে দাঁড়িয়ে নারীর প্রতি পক্ষপাত নেই তাঁর। একা নারীর লড়াইটা পুরোদমে যাপন করেও নারীকে একতরফা মহিমান্বিত করবার প্রবণতা থেকেও তিনি মুক্ত। তাঁর লেখায় নারীর মন, মনন ঘুরেফিরে এসেছে বারবার অথচ কি অসামান্য সে নৈবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর লড়াইটাকে সমাজ, সংসার, দেশকালের সীমানা অতিক্রম করিয়ে, বৈশ্বিক জায়গা থেকে বিবেচনায় নিয়ে দেখেছেন কেবল তা নয়, কখনো-কখনো নিজেই হয়ে উঠেছেন নারীর সত্যবাক আয়না।
নিজের ভেতর দৃঢ় নারীবাদী সত্তা নিয়েও নিজেকে নারীবাদী দাবি করেননি কখনো বরং নারীর একান্ত ভাষ্যকার হয়ে উঠেছেন ক্রমশ। নবনীতা যখন নারীর সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেন তখন নব্য নারীবাদীরা খানিক আহত হন। অথচ তাঁর নিবিড়পাঠে বোঝা যায় নারীর চরিত্রের ব্যত্যয়গুলোতে তিনি যখন সজাগ তর্জনী রাখেন তখন সেখানই নারীবাদীতার মূলপাঠের শুরু।
কেবল লেখায় নয়, তিনি নিজে স্বাধীন নারীর স্টাইল আইকন হয়ে উঠেছেন নিজের অজান্তেই। সলো ট্রাভেলারের নতুন ধারণা এখন অনেকের মনে তোলপাড় অথচ শরীরে অমন কর্কট রোগ নিয়েই পৃথিবীময় একা ঘুরে বেড়ানো নবনীতা আমাদের প্রধান সলো ট্রাভেলার। রসবোধের চূড়ান্তে তাঁর অবস্থান, নিজেকে নিয়েই রসের ভাড়ার উপর করে লিখেছেন ছোট আত্মজীবনী “নটি নবনীতা”। কঠিন আলোচনা তিনি করেছে সরল সব বাক্যে। শব্দের অলংকারে ভাষাকে বাহুল্য ভারে ভরিয়ে সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতা থেকে দূরে সরে থাকতে চাননি । বাংলা ভাষায় তাঁর দখল এতোটাই সাবলীল যে যেকোন পাঠক সহজেই নবনীতাকে নিজের সঙ্গী করে নিতে পারে। “সই” নামের সংগঠন চালিয়েছেন আমৃত্যু। নারী লেখকদের, নারী লেখক তকমায় যে ভোগান্তি পোহাতে হয় তাঁর থেকে মুক্তির একটা ভিন্ন প্লাটফর্ম এই “সই”। কিন্তু তাঁকে নারী লেখক বিবেচনায় আড়চোখে দেখার অবকাশ নেই একদম। বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো অতো উঁচুদরের সমালোচক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সাহিত্যের সব কটি শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন রাজারবেশে যেমন করে তিনি লিখেছেন “মেয়েদেরও এক টুকরো ছেলেবেলা থাকে বই-কী” তেমনি।
নবনীতা দেবসেন যে উজ্জ্বল্য ধারন করেন, তাতে করে তাঁর প্রয়াণ দিবস বলে কিছু থাকে না আসলে, বরং তাঁর ‘জন্মের কোন শেষ নেই’। তাই প্রয়াণ দিনেও তাঁর জীবনকে উদযাপন করতে পারাই আনন্দের।