বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে হঠাৎ খসে পড়া একটি নক্ষত্রের নাম নবনীতা দেবসেন। খসে পড়লেও হারিয়ে যাননি নবনীতা, হারাবেন না কোনদিন। তিনি খুব রূপকথা লিখতেন। তাঁর রূপকথার গল্পের নায়ক মেয়েরা; রানীই এগিয়ে যায় রাজাকে উদ্ধার করতে। রূপবতী নয়, বুদ্ধিমতি রাজকুমারীদের গল্প শোনাতেন তিনি। নারী শক্তির উত্থানের অনুপ্রেরণা তাঁর মা রাধারানী দেবী। গেল শতকের প্রথমার্ধে বালবিধবা রাধারানী নবজীবন লাভ করে মেতে উঠেছিলেন সৃষ্টিশীলতায়। এসব গল্প আমাদের মেয়েদের কাছে আজও অচেনা। তাইতো আমরা মেতে আছি সৌন্দর্যের অধিকারের লড়াইয়ে।
আজও আমাদের মেয়েরা ‘তুমি সুন্দর’ কিংবা ‘তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে’ শুনে যতটা বিমোহিত উদ্বেলিত হয়, ‘তোমার কাজটা বেশ ভাল হয়েছে’ শুনে ততটা খুশি হয় না। আর সেকারণেই নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য যত খাটাখাটুনি করে, কাজটা ভাল বা সুন্দর করার জন্য তেমনটা করতে দেখা যায় না। এখনও বোধ হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত মেয়ে এই দলে রয়ে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যাদের নেই, কিংবা যারা সামাজিক মইয়ের নিচের দিকে বা প্রান্তিক অবস্থানে আছে তাদের কথা এখানে হয়তো বলা সাজে না। কারণ তারা জানেইনা দেশ বিদেশের অনেক মেয়ে লড়ছে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীমুক্তির জন্য। তারা জানেই না যে নারী দিবস বলে বিশেষ একটা দিন আছে যা শতবছর আগ থেকে পালিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
মহান এই দিবসে সাজসজ্জার অন্ত থাকেনা, বক্তৃতা-আলোচনা চলে বিরামহীন। কেউ লড়ছে সমান অধিকারের জন্য, কেউবা চাইছেন অগ্রাধিকার। কিন্তু একজন মেয়েকে কেন পুরুষের সমান হতে হবে, কিংবা পুরুষকে ছাড়িয়ে যেতে হবে? নারীর চাওয়া পাওয়ার মাপকাঠি কেন পুরুষের কী কী আছে কিংবা পুরুষরা কী কী করে, তা দিয়ে নির্ধারণ হবে? সে নিজেই নিজের কাজটা করে নিকনা। প্রয়োজনে বন্ধুর সাহায্য নেবে; সে বন্ধু ছেলে মেয়ে যাই হোক না কেন। নিজেও বাড়িয়ে দেবে সাহায্যের হাত বন্ধুর দিকে; ছেলেমেয়ে সব বন্ধুর। সমাজকে পৃথিবীকে যে-যার জায়গা থেকে সেবা দিয়ে যাবে, সমৃদ্ধ করবে। ভালোবাসা নিয়ে, আনন্দ নিয়ে। দুঃখ জরা জয় করে। হাতে হাত রেখে। পুরুষ তো নারীর প্রতিপক্ষ নয়, প্রতিযোগীও নয়, সহযাত্রী ও সহযোগীমাত্র।
তাই নারী মুক্তির সভায় পুরুষ বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে কাজ হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে নারীর হাতেও নির্যাতিত হয় নারী। সফল নারীদের গল্পকথা, সংগ্রামের ইতিবৃত্ত প্রেরণা যোগাবে আগামীদিনের নারীদেরকে। কিন্তু পোশাকি আনুষ্ঠানিকতা, ব্যয়বহুল ও জাঁকজমক উদযাপন দিবসের মূল প্রতিপাদ্য থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় আমাদের।
২
আধুনিক অগ্রসর সমাজের কন্যা হিসেবে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন নবনীতা। তাঁর নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং কবিগুরু। তাঁকে নিয়েও আছে নবনীতার বিশাল গল্পভাণ্ডার। নিজ শহরের সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার পালা সাঙ্গ হলে পাড়ি দেন তিনি উত্তর আমেরিকার সেরা প্রতিষ্ঠানে। তুলনামূলক সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে পিএইচডি সম্পন্ন করেন, নানান মহাদেশের নামী প্রতিষ্ঠানে গবেষণায় সক্রিয় থেকে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, এসবই কিন্তু গেল শতকের মধ্যভাগের কথা। তথ্যপ্রযুক্তির নামগন্ধও তখন শোনা যায়নি। এরপর সগৌরবে ফিরে আসেন তিনি দেশের বুকে। লেখাপড়া,পাঠদান, লেখালেখি, সন্তানের দেখভাল চলতে থাকে সমানতালে। যশ, খ্যাতি, মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা কিছুই বাকী থাকেনা জীবনে। তবে ঝড়ঝাপটা আসেনি তাতো নয়। কিন্তু চেয়ে দেখুন হাসিখুশি মানুষটার দিকে। ষোল আনা বাঙালীয়ানায় কোন কমতি নেই সারা অবয়বে। ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক, স্বকীয়তায় অনন্য। পশ্চিমের ভাব নেই, ইংরেজির গরিমা নেই।
আমাদের আজকের শিক্ষিত মেয়েদের অনেকে পেটে বিদ্যে পড়ামাত্র কেমন যেন হয়ে যায়। চলনেবলনে, পোশাকেআশাকে, কথাবার্তায় অন্যরকম একটা ভাব-গরিমা ধারণ করে। কৃত্রিমতার খোলস পরে নিজ ভূমে অচেনা রূপ ধরে নিজেকে সফল প্রমাণে উঠেপড়ে লাগে। অঙ্গসজ্জায় ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ কসরত করে নারীমুক্তির আস্বাদ লাভ করে। ওদের কাছে নারীচেতনা কী অর্থ বহন করে ওরাই জানে।
সত্যি বলতে কী আজ আমি এখানে নারী চেতনা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যাবনা। কারণ প্রথমত, এবিষয়ে আমার ব্যক্তিগত জ্ঞান নিতান্তই সীমিত। আর দ্বিতীয়ত, তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় ভর করে সাজানো গোছানো কথাগুলো সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। আমার ভয় হচ্ছে, উঁচু তলার নারীদের অনেকে শুরুতেই এ লেখাকে বাতিলের ঝুড়িতে ফেলে দেবেন, হয়তোবা ইতোমধ্যেই ফেলেই দিয়েছেন কেবল সাজসজ্জা বা সৌন্দর্যের অধিকারের লড়াইকে অপ্রয়োজনীয় বলে আখ্যায়িত করায়।
৩
বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র চট্টগ্রামের এক সভায় যোগদানের প্রথম দিনটি আনুষ্ঠানিক আলোচনা সভা সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে দিয়েছিল। গতানুগতিক ধারায় সুসজ্জিত অতিথি ও বক্তৃতার ভারে নুইয়ে পড়েনি সেদিনের সভা। অংশগ্রহণকারী সকলের পরিচিতির সঙ্গে সঙ্গে ভাবনা প্রকাশের সুযোগ ছিল। ব্যতিক্রমধর্মী এই মতবিনিময়সভায় লেখক, সংবাদকর্মী, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, সমাজকর্মী থেকে শুরু করে গৃহকর্মী ও শিক্ষার্থীর সমাবেশ ঘটেছিল। দু’তিন জন পুরুষ কর্মীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সেই বিকেলটা সার্বজনীন রূপ নিয়েছিল। ঘরকুনো আমি দ্বিতীয়বারের মতো নারীমুক্তি কেন্দ্রের ডাকে ঘরের বাইরে যাই রোকেয়া দিবসে। ত্রয়োদশ বর্ষীয় কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে।
আনুষ্ঠানিকতার বাড়াবাড়ি নেই বলে প্রাণের টান বড় মধুর মনে হয়। দু’বারই বাড়ি ফিরে আসি মুগ্ধতা নিয়ে, অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে; আমাদের মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে, দিন বদলাবেই। কিন্তু একটা বিষয় মন থেকে তাড়াতে পারি না। অনুষ্ঠান চলাকালে বৈদ্যুতিক গোলযোগ হলে কিংবা শব্দ নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত হলে আজও আমাদের মেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা সারাই করতে পারে না। একটু দোনমনো করে একজন পুরুষকর্মীকে নিয়ে আসা হয় উদ্ধারকর্তা হিসেবে। এই নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের।
শুরুতে বলেছিলাম- প্রয়োজনে বন্ধুর সাহায্য নেবে; সে বন্ধু ছেলে মেয়ে যাই হোক না কেন। সেকথা ফেলে দিচ্ছিনা। কিন্তু প্রযুক্তি ও যন্ত্রনির্ভর এই পৃথিবীতে যন্ত্রকৌশল রপ্ত করা ছেলে মেয়ে সবার জন্যই অতি জরুরী একটা শিক্ষা। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে আমাদের মেয়েদের যন্ত্রভীতি জয় করতে হবে। আর যেটা করতে হবে আমাদের মেয়েদের তা হল -কথা বলা। নিজের কথা নিজেকেই বলতে হবে। চাওয়া পাওয়ার কথা, স্বপ্নের কথাতো বটেই, সেই সঙ্গে বঞ্চনা ও বেদনার কথা। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে আপোষ করে অলীক সুখ আঁকড়ে থাকলে চলবে না। নজরুলের ‘জাগো নারী জাগো, বহ্নিশিখা’ অনেকের চেনা। তবে আমরা তার কতটুকু হৃদয়ে ধারণ করে কাজে প্রয়োগ করছি, তা অজানা। আজ শেষ করছি কবি গুরুর দুটো পঙক্তি দিয়ে। সিলেট জেলার শিলচরের প্রথম মহিলা সম্পাদিত পত্রিকা ‘বিজয়িনী’র প্রথম বর্ষের চতুর্থ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বহস্তে লিখিত এক আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন। ১৯৪০ সালের কথা। বিশ্বকবি লিখেছেন-
হে বিধাতা, রেখোনা আমারে বাক্যহীনা,
রক্তে মোর বাজে রুদ্রবীণা।।
কৃতজ্ঞতা: আধুনিকতার অভিঘাত ও শ্রীভুমির নারী জাগরণ (১৮৭৬- ১৯৪৭)- দীপংকর মোহান্ত।