নারী কেলেঙ্কারির ভয় দেখিয়ে অপহরণ বাণিজ্য

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৩ নভেম্বর, ২০২২ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি। ২-৩ লাখ টাকা পেলেই ছেড়ে দেওয়া হয় ভিকটিমকে। কিন্তু তার আগে অপহরণ চক্রের নারী সদস্যদের সঙ্গে তুলে রাখা হয় অশ্লীল ছবি। সেই ছবিকে পুঁজি করে দেখানো হয় নারী কেলেঙ্কারির ভয়। ভয়ের এ অস্ত্রের মুখে ভুক্তভোগীরা আর মুখ খোলেন না। পুলিশও জানতে পারে না তথ্য। ফলে নির্বিঘ্নে চলতে থাকে একের পর এক ‘অপহরণ বাণিজ্য’। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় এ ধরনের একাধিক অপহরণ চক্র।
ঈশিতা ত্রিশ বছর বয়সেই স্বামী পাল্টেছেন চার বার। চড়েন দামী গাড়িতে, থাকেন বিলাসবহুল ফ্লাটে। সময়ে সময়ে চাকরি করেন স্পা হোটেলগুলোতে। তবে সেই চাকরি তার পেশা নয়। একাধিক বিয়ের তথ্য গোপন করে সেখানে তার টার্গেট থাকে বিত্তশালীরা। তাদের কখনো বিয়ের প্রলোভন, কখনো প্রেমে জড়ানোর চেষ্টা করেন। দরিদ্র ও অসহায় নারী সেজে তাদের কাছে স্বল্প বেতনে চাকরিও নেন। পরে সুযোগ বুঝে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা থাকেন বহুরূপী এই নারী প্রতারক।
প্রতারণার একাধিক মামলার আসামি এই নারী অবশেষে গত মঙ্গলবার রাতে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়। তার প্রকৃত নাম লুৎফন নাহার ঈশিতা (৩০)। নিজ বাড়ি ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙা থানার কামার গ্রামে। গত অক্টোবর মাসে ঢাকা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের হওয়া প্রতারণার একটি মামলায় পরোয়ানা জারির পর ওই নারীকে গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। একই মামলায় আসামি ওই নারীর স্বামী আবদুল্লাহ আল মামুন ও তার সহযোগী দেলোয়ার হোসেনকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঢাকা কেরানীগঞ্জ মডেল থানার বাসিন্দা মাহদি প্রপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজুল আলম বাদী হয়ে ঈশিতা, তার স্বামী সহ ৩ জনের বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা আত্মসাতের ওই মামলাটি করেন।
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাঈনুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বুধবার (২ নভেম্বর) এই তিনজনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। চক্রটির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকারী চান্দগাঁও থানা পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) রোকন উদ্দিন বলেন, ওই মহিলা যে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন সেখানে ৭টি এয়ার কন্ডিশন লাগানো রয়েছে। ৪টি ফ্রিজসহ দামী আসবাবপত্র রয়েছে। তাদের আয়ের কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। মহিলার স্বামী আবদুল্লাহ আল মামুন আগে পাঠাও চালক ছিলেন।
গত ২৯ অক্টোবর পাহাড়তলী থানার অলংকার শপিং কমপ্লেক্সের নিউ চাঁদনী জুয়েলার্সের মালিক সঞ্জিত কুমার রায়ের (৫০) মোবাইলে রেহেনা আক্তার মীম (২২) ফোন করে স্বর্ণালংকার বিক্রির কথা জানান। পরে তিনি স্বর্ণালংকারগুলো কিনতে সম্মত হলে মীমের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী হালিশহর থানাধীন নয়াবাজার মোড়স্থ তায়েফ হোটেলের বিপরীত পাশে আধঘণ্টা পরে উপস্থিত হন। তখন নুরুল ইসলাম ও সেলিম সিএনজি টেক্সি করে সঞ্জিতকে ছুরি ধরে ভয়ভীতি দেখিয়ে হালিশহর ১ নম্বর পানিরকল এলাকায় একটি বাসায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ওই বাসায় আয়েশা আক্তার ও রেহেনা আক্তার মীম আসেন। পরে তারা তাকে রুমের ভেতর আটকে রেখে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। যদি টাকা না দেয় তবে আয়েশা আক্তার ও রেহেনা আক্তার মীমের সাথে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। এ ঘটনায় জড়িত আয়েশা আক্তার প্রকাশ ফিরোজা (৩২), রেহেনা আক্তার মীম (২২), আমিনুল ইসলাম (৩৩), মোঃ নুরুল ইসলাম (৩৭) ও মো. সেলিম (৩৭) নামে ৫ জনকে গ্রেফতার করে।
হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহির উদ্দিন বলেন, অপহরণকারীরা আয়েশা আক্তার ও রেহেনা আক্তার মীমকে লজ্জার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে মুক্তিপণ এবং ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে। ১৬ অক্টোবর কোতোয়ালী থানাধীন হাজারী গলি থেকে মোরশেদুল আলম নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে একটি চক্র। মোরশেদ আলমের মেয়ের জামাই থানায় মামলা করলে পুলিশ হালিশহর রঙ্গিপাড়া থেকে মো. জাহেদ আলম (১৮), মো. বেলাল হোসেন ইমন (১৮), মো. কাউছার (১৯) ও মো. ইমন (১৮) নামে চার অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করে। এসময় মনোয়ারা ও ইয়াছমিন আক্তার নামে দুইজন কৌশলে পালিয়ে যায়।
গত ৪ অক্টোবর নগরীর ফিশারিঘাটে একটি ফিশিং বোটের মাঝি কামরুল হোসেন (৪২) এমন একটি চক্রের হাতে পড়েন। প্রতারক চক্রের পাল্লায় পড়ে ছখিনা বেগম নামে এক নারীর সঙ্গে কয়েক মাস ধরে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ৪ অক্টোবর মেয়েটি কামরুলকে নগরীর স্টিল মিল এলাকায় ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে কণা বেগম (৩০) নামের এক নারীর সঙ্গে তার আপত্তিকর ছবি তুলে রাখে। পরে বিশ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। অপহরণকারী চক্রকে বিকাশের মাধ্যমে ২ লাখ ৮২ হাজার টাকা দেয়া হয়।
কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. জাহিদুল কবীর আজাদীকে বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ৬ অক্টোবর ফটিকছড়ির দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে আমরা ছখিনা বেগম (৪৬), শাহজাহান (৩০) ও কণা বেগমকে (৩০) গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কোতোয়ালী থানার এসআই মোমিনুল হাসান বলেন, এ চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণের ঘটনা ঘটিয়ে আসছিল। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবায়েজিদে পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণ
পরবর্তী নিবন্ধচবির চারুকলা ইন্সটিটিউটে শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন