নারীজন্মই একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র

ববি বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ২ জুন, ২০২২ at ৪:১৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের বুকে বিশাল দেহ নিয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে আমার কর্মক্ষেত্র ওমর গনি এম ই এস কলেজ। প্রায়শই নানাজাতের পাবলিক পরীক্ষা সংগটিত হচ্ছে। আর প্রতিটা দিনই জন্ম নেয় নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। আর কখনো কখনো মনকে নাড়া দেয় নানা রকম ঘটনা।

কলেজে মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে। সকাল থেকে এইচএসসি, ডিগ্রী, অনার্স এর ক্লাস। এরপরই ১.৩০ টা শুরু মাস্টার্স পরীক্ষা বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। বলা চলে সারাদিন মানের কর্মযজ্ঞ। বেলার খাবার খাওয়ার সময়ও ঠিকঠাক পাওয়া যায় কদাচিৎ।

একটি দৃশ্য ইদানীং প্রায়ই চোখে পড়ছে কলেজের মূল ভবনে অবস্থিত লাইব্রেরী হলের পাশ দিয়ে আসা যাওয়ার পথে। তা হলো এই লাইব্রেরী যেখানে বসে আমাদের শিক্ষার্থীরা সুযোগ মত পড়াশোনা করে সেই টেবিলে কিছু একমাস, দুমাস, পাঁচমাস কিংবা নানা বয়সী শিশু ঘুমানোর দৃশ্য। কিংবা কিছু শিশুর এদিক ওদিক ছোটাছুটি, কিছু শিশু অবিরাম কেঁদেই সারা। আর তাদের খেয়াল রাখছে তাদের বাবা, মামা, চাচা, নানী কিংবা খালা। লোভ সামলাতে না পেরে গেলাম ভেতরে। একজন শিক্ষকের অনাহুত আগমনে সবাই একটু হকচকিয়ে গেলেও পরে বুঝতে পারলেন আমার আগমনের কারণ। একটি শিশু প্রায় তিনমাস হয়তো হবে। পিতার কোলে সমান তালে কেঁদেই চলেছে। আমি একটু আদর করায় কিংবা নতুন মুখ বুঝে শিশুটি কখনো ফিক করে হাসছে আবার হয়তো তার কান্নার মুখ কারণ তার মায়ের কথা মনে করে আবার কান্নায় ফিরে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে নিজে মনে মনে হাসলাম। হয়তো হাসিটা কিছু কষ্টের আবার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনায় মিল খুঁজে পাওয়ায়।

২০০৭ সালে এপ্রিল মাসে নয়মাসের সন্তান পেটে নিয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম আমিও। ১১ এপ্রিল লিখিত পরীক্ষা শেষে ১৭ এপ্রিল পৃথিবীর মুখ দেখেছিল আমার প্রথম সন্তান। সে কী কষ্ট পড়াশোনায়। একে অর্থনীতির ছাত্রী। গণিত, লেখচিত্র সবমিলিয়ে বেশ ঝক্কি ঝামেলার পড়াশোনা। অনেক কায়দা করে বসে, শুয়েও জুত করা যাচ্ছিল না। পেটে অনবরত সন্তানের নড়াচড়া, লাথি খাওয়া। কী অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা ! অনেক কষ্টেসৃষ্টে অন্তত লিখিত পরীক্ষা শেষ করতে পেরেছি। পরে অবশ্য সন্তানকে হাসপাতাল থেকে ঘরে পাঠিয়ে কাটা পেট নিয়ে গিয়েছি ভাইবা দিতে।

এটি আমার ভাগ্য ভালো যে অন্তত লিখিত পরীক্ষা শেষ করতে পেরেছিলাম। এমনও হয়েছে আমার হলে আমার আরেক সহপাঠীর শেষ পরীক্ষার দিন পরীক্ষার মাঝপথেই যেতে হয়েছিল হাসপাতালে। সন্তান প্রতিপালন চক্রে আদৌ তার পরীক্ষা কখনো শেষ করতে পেরেছিল কিনা তা আজো জানা হয়নি।

এটি ছিল একজন মায়ের সন্তান প্রসবের আগেকার কথা। যখন আবার হলে প্রবেশ করি আরেকটু মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা প্রদানরত ছেলে এবং মেয়েদের দিকে লক্ষ করি। ছেলেরা যত স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে তার বিপরীতে কিছু মেয়ের চেহেরা মলিন। হয়তো লেখার ফাঁকেই হাজার চিন্তা খেলা করছে মস্তিষ্কে।

পরীক্ষার খাতাপ্রশ্ন নিয়ে লিখতে বসেছে ঠিক তারা মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিতে পারছে কতোটা? ছাত্ররা যতো অবলীলায় পরীক্ষার খাতা ভরে লিখছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঠিক ততোটাই উৎকণ্ঠা আর চিন্তার রেখা কপালে এঁকে পরীক্ষা সম্পন্ন করছে। সর্বক্ষণ চিন্তা তার লাইব্রেরী রুমে রেখে যাওয়া সন্তান তারা বুকের দুধের অভাবে কাঁদছে কিনা, তার অভিভাবক যারা তার সন্তানকে রাখছে তারা ঠিকঠাক সামলাতে পারছে কিনা! আবার পরীক্ষার মাঝে মাঝে গিয়ে বুকের দুধ দিয়ে আসা। আহা! মাতৃ জীবন! আহা নারীজাতি! আর এভাবেই হয়তো অকালেই ঝরে যায় তাদের উচ্চ শিক্ষা লাভের আকাঙ্ক্ষা।

নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) অগ্রগতি প্রতিবেদন (২০১৯) বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের শিক্ষার হার ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এদের মধ্যে পুরুষের শিক্ষার হার ৭৪ শতাংশ।

এ হিসাবে শিক্ষায় পুরুষের চেয়ে ২ দশমিক ৬ শতাংশ এগিয়ে আছে বাংলাদেশের নারীরা। তবে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশ পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চমাধ্যমিকে ছাত্রীর হার (একাদশদ্বাদশ) ৪৬.৯৭ শতাংশ, ডিগ্রিতে ৪১.৩৯ শতাংশ এবং স্মাতকোত্তর শ্রেণিতে ৩৬.০৭ শতাংশ। উপরের তথ্য মতে, নারীদের শিক্ষায় বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়ে গেলেও উচ্চশিক্ষায় নারীর অবস্থান এখনো যথেষ্ট পরিমাণে কম।

আর একজন নারী হয়ে নিজের জীবনের উপলব্ধি দিয়ে অনুভব করি পরিবার, সন্তান, চাকরি সবদিক সামলিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভে ডক্টর অব ফিলোসফি (পিএইচডি) বা সমমানের গবেষণায় জ্ঞানের গভীরতা ও প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জন করে সামাজিক রূপান্তরে বড় প্রভাব রাখার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেই সুযোগ ও সময় হয়ে ওঠে না।

এই বিষয়টি ছাড়াও গবেষণায় দেখা যায়, নারীদের শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ার হার শহরের তুলনায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশি। এর কারণ হিসেবে পরিবারের অভিভাবকদের অসচেতনতা, অর্থনৈতিক সংকট বা দারিদ্র এবং কন্যা সন্তানকে পরিবারের বোঝা মনে করাকে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’র তথ্য মতে, শুধু ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর এই সাত মাসে দেশের ২১ টি জেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬ জন মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন। তাদের ৪৮ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। এছাড়া ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাল্যবধূর সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ।

পঠনপাঠন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে গেলেও আমাদের নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা কাঠামো ও সামাজিক প্রেক্ষাপট নারীপুরুষের মাঝে ব্যবধান তৈরি করে দিচ্ছে। আমাদের সমাজে অশ্লীল বক্তব্য ও লেখনী, অশ্লীল চলচ্চিত্র ও পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা নারীকে কেবল ভোগ্যপণ্য হিসেবেই দেখতে শেখাচ্ছে।

এছাড়াও নিজেদের সম্মানমর্যাদার প্রতি নারীদেরই উদাসীনতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব নারীসমাজকে পিছিয়ে দিচ্ছে। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেনতার অভাবে তারা নিজেরা যেমন সচেতন নয় ঠিক একই ভাবে তারাই অন্য নারীর উচ্চ শিক্ষা লাভে প্রতিবন্ধক হিসেবে ভুমিকা রাখছে সবচেয়ে বেশি।

কতোদিন আগে একটি লেখায় বলেছিলাম প্রকৃতির নিয়মেই বন্দী নারীজীবন। কথাটি অস্বীকার করার যেমন জো নেই ঠিক তেমনি এতো এতো প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে উত্তরণের চেষ্টাও কম না। পরিবারের প্রতিটা সদস্যের একটু আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে নারী। বিশ্ব জয়ের ক্ষমতা রাখতে পারা নারী জয় করতে পারে বিশ্ব।

আসুন না একটু আন্তরিক হই ওই লাইব্রেরী রুমে বসা স্বামী, চাচা, মামা কিংবা নানী, দাদী, খালাদের মতো করে। আসুন তাদের স্বপ্ন পূরণে সহায়ক হই। এতে উপকার আমার, আপনার, সকলের। কারণ উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের যথাযথ অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো দেশ বা জাতির পক্ষে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব নয়।

ওদের হাত ধরেই এগুক না সমাজ, দেশ ও জাতি। ওদের নিয়ে গর্ব করুক সারাবিশ্ব। নারী নেতৃত্বে এগিয়ে যাওয়া দেশ, আমাদের বাংলাদেশ সমাদৃত হোক বিশ্বদরবারে।

লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ওমরগণি এমইএস কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবন্দর-ইপিজেড এলাকায় উন্নতমানের সরকারি হাসপাতাল চাই
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল