নান্দীমুখ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০২২ : একজন দর্শকের চোখে

প্রণব সিংহ | সোমবার , ১২ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারাদেশের নাট্যাঙ্গনে একটা দৈন্যতা চলছে। এক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া, মৌলবাদের উত্থান, নাট্যকর্মীদের পেশাগত ব্যস্ততা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সেলফসেন্সরশিপ ইত্যাদি বিবিধ সমস্যার কথা উঠে আসতে পারেকিন্তু নিরেট সত্যিটা হচ্ছে দৈন্যতা চলছে।

ভালো কিছু করতে চাইলে ভালো নমুনা আগে দেখতে হয়। তেমনি ভালো নাটক করতে গেলে ভালো নাটক দেখা এবং পড়া প্রয়োজন (নাটক যেহেতু মূলত ‘দেখা’র জিনিস, তাই দেখা কথাটা আগে রেখেছি)। পড়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে ভাষাগত ব্যবধান, আর দেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে ভালো নাটকের অভাব।

আমাদের নাট্যাঙ্গনের ভালো নাটকগুলির একটা বড় অংশই বিদেশি নাটকের অ্যাডাপটেশন (রূপান্তর)। বিদেশি নাটক যদি আপনি অ্যাডপ্ট করতেই পারেন, তবে বিদেশি নাটক, বিদেশি অভিনয় দেখতে সমস্যা কোথায়? কথাটা বলতেই হলো এই কারণে যে, এই ধরনের বিভাজনের কথা বাতাসে ভাসতে শুনেছি। বিদেশি নাটকের দর্শকপ্রিয়তা আর দেশি নাটকের দর্শকহীনতা নিয়ে হাহুতাশ বা তির্যক মন্তব্য শুনেছি।

কিন্তু সত্যিটা বেশি কাউকে স্বীকার করতে শুনছি না যে, আমরা ভালো নাটক প্রচুর দেখছি না বা পড়ছি না। মৌলিক নাটকের অভাব তো ঘুচলোই না, উচ্চাঙ্গের নাট্য সমালোচনাও নেই। এসব নিশ্চয় ভালো নাটকের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং দর্শক স্বল্পতার একমাত্র না হলেও বড়ো কারণ।

চট্টগ্রামের নান্দীমুখ এক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকা পালন করছে। দু’তিন বছর পরপর চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবের সুবাতাস বইয়ে দিয়ে তারা অন্তত বছরের কয়েকটি দিন মিলনায়তনকে দর্শকমুখর করে তুলতে পারছেন। এর সিংহভাগ কৃতিত্ব নান্দীমুখের কর্ণধার অভিজিৎ সেনগুপ্তের। কোন ম্যাজিকে এই প্রায় অসম্ভবকে তিনি সম্ভব করেন, সেটা আমি বহুবার ভেবেও কুল পাইনি। ক্রমাগত সংস্কৃতিচর্চা বিরোধী এই দেশে অসহ্য আমলাতান্ত্রিকতা আর পদে পদে ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করা বাধার মুখে এই রকম একটি মহাযজ্ঞ করতে যে ধৈর্য আর সাহস লাগেঅতি বিনয়ের সাথে বলছি; বেশিরভাগ লোক এটা বুঝতেই পারবেন না।

আছে নাটক বাছাই, যোগাযোগ, স্পন্সর যোগাড়, শিডিউল প্রাপ্তি, ভিসা অনুমতি, স্বরাষ্ট্র ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে ইঁদুর দৌড়, পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং নিরাপত্তা বিষয়ক শত খুঁটিনাটি। কী আশ্চর্য, এখানে বিদেশী দলের নাটকের টিকেট মূল্য ১০০ টাকা ছাড়ালেই নাকি ট্যাক্স দিতে হয়! কিন্তু যে সংগঠন দশ দিন ধরে আটটি বিদেশি দল, দু’টি দেশি দলের নাটক, দশদিনব্যাপী মুক্তমঞ্চের অনুষ্ঠান, সেমিনার, মাস্টার্স ক্লাস, নাট্য বিষয়ক কর্মশালাসহ একটা পুরো আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবের আয়োজন এতসব সমস্যা মাথায় নিয়ে করতে পারে, তাঁদের জন্য প্রশংসায় পঞ্চমুখ বোধহয় হওয়াই যায়।

হয়তো চট্টগ্রামের নাট্যইতিহাস কোনদিন নান্দীমুখ বা অভিজিৎ সেনগুপ্তের এই উদ্যোগের মূল্যায়ন করবে, হয়তো করবে নাকিন্তু একজন নিরপেক্ষ দর্শক, যে চট্টগ্রামে বসে চোখের সামনে স্পেন, মেক্সিকো, জাপান বা সুইডেনের নাট্যধারা, অভিনয়শৈলী আর নাট্যচিন্তার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, তার মনে নান্দীমুখ অবচেতনেই নিশ্চয়ই জায়গা করে নেবে।

এবারের আয়োজনের নাটকগুলোতে নিরীক্ষাধর্মী প্রযোজনার প্রাধান্য ছিল। দর্শক হিসেবে আমার কাছে এর কয়েকটি গিমিক বা দুর্বোধ্য মনে হলেও অনেকগুলোই ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে। আরেকটি বিষয়, যেটি আমাকে আকৃষ্ট করেছেসেটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন বা নারী চরিত্রের দৃষ্টিতে সামাজিক বয়ানের নাটকের প্রাধান্য।

উৎসবের প্রথম নাটক ছিল গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের ‘জুলিয়াস সিজার’। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে বাপ্পা চৌধুরী, অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য, যীশু দাশ ব্যক্তিগতভাবে ভালো অভিনয় করলেও পুরোটা কেমন যেন নাটক হিসেবে জোড়া নেয়নি এলিয়ে গেছে। যে চড়া গতিতে নাটক শুরু হয়, সেই গতি, সেই টানটান ভাব ধরে রাখা যায়নি। দ্বিতীয় দিনে লোকনাট্য দলের ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’ও একইভাবে মনে লাগেনি।

উল্লেখযোগ্য ছিল তরঙ্গিনী’র ভূমিকার ভাবনা এবং প্রয়োগ। একটি চরিত্রের বিভিন্ন আবেগ বা মানসিক অবস্থাগুলো ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টাটি অন্তত আমার কাছে প্রশংসাযোগ্য মনে হয়েছে। তবে এই নাটকে ঋষ্যশৃঙ্গসহ অন্যান্য চরিত্রগুলো কেমন যেন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তৃতীয় দিনে ছিল এবারের উৎসবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাটক জাপানের গাম্বো থিয়েটার গ্রুপএর নাটক ‘টিরুম অন দ্য বর্ডার।

’ সত্যিকারের নাটকের স্বাদ পেয়েছি এই নাটকে। মনে হয় এই নাটকটি শুধু আমার নয়, সত্যিকার নাট্যপ্রেমী মাত্রেরই হৃদয়ে দীর্ঘজীবী হবে। নাট্যভাবনা থেকে শুরু করে প্রতীক, অনুষঙ্গ, আলো, আবহ এবং অভিনয়প্রতিটি ক্ষেত্রে নাটকটি উৎকর্ষের চরম মাত্রা স্পর্শ করেছে।

নাটকের বার্তাটি ছিল সাধারণ বা বর্তমান সময়ে বহুল চর্চিত, কিন্তু নির্দেশক কায়ো তামুরা’র নির্দেশনাগুণে নাটকটি অসাধারণ হয়ে ধরা দিয়েছে। দর্শককে নিজের নাট্যভাবনার সাথে মিলিয়ে নিয়ে চতুর্থ দেয়াল ভেঙ্গে ফেলার এক চমৎকার প্রয়োগ দেখেছি। চতুর্থ দিনের নাটক ছিল ভারতের থিয়েটার শাইন প্রযোজনা ‘অপেক্ষায় অপেক্ষায়’। একজিসস্ট্যানশিয়ালিজমের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এই নাটকটিতে নিহিলিজমএর খানিকটা ছোঁয়া পেয়েছি।

আমার অ্যাবসার্ড নাটক পড়ার কিছুটা ভালো অভিজ্ঞতা থাকলেও মঞ্চে আমি এই নাটকটি সহ মাত্র তিনটি পুরোপুরি অ্যাবসার্ড নাটক দেখেছি। এই ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা নিয়ে নাটকটি সম্পর্কে মন্তব্য করাটা ধৃষ্টতা মনে হচ্ছে, কিন্তু আমার মনে হয়েছে নাটকটি তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

থিওরির দিক থেকে নাটকটি ত্রুটিশূন্য ভাবা যায়; কিন্তু অভিনয় এবং সংলাপএ নাটকে দুর্বল। আমার মনে হয়েছে দু’য়েকটি খণ্ড নাট্যক্রিয়া যদি না থাকতো, তবে দৈর্ঘ্য আরেকটু কমিয়ে এনে নাটকটিকে আরও শক্তিশালী করা যেতো। আর ‘ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে অন্যভাবে অ্যাবসার্ডিটি উপস্থাপন করা যায় কিনা সেটাও হয়তো নাট্যকার ভাবতে পারতেন। পঞ্চম দিনের নাটক ছিল ভারতের সবার পথ নাট্যদলের প্রয়োজনা ‘শীতল পাটি’।

থিয়েটার গ্রুপ গাম্বো’র ‘টি রুম অন্য দ্য বর্ডার’ নাটকটির পর এটাই ছিল এই উৎসবের দ্বিতীয় নাটকযেখানে অভিনয় দেখে অভিভূত হয়েছি। বক্তব্যের গভীরতা, অনন্য অভিনয়, হ্যান্ড পাপেটের দুুর্দান্ত ব্যবহার এবং যেটা আমি সবসময় কামনা করি পরিষ্কার সংলাপ প্রক্ষেপণ সবটুকুই নাটকটিকে অনবদ্য করেছে। আমি আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় বলছিতৃপ্তি মিত্র বা শাঁওলী মিত্রের অভিনয় দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু সঞ্জিতা মুখার্জীর অভিনয় সেই অপূর্ণতাকে পূর্ণ করে দিয়েছে।

অভিনেতা কীভাবে গল্পের প্রতিটি চরিত্রে তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব মিশিয়ে নিজেকে চরিত্রের সাথে একীভূত করেন, তার অনুপম দৃষ্টান্ত এই নাটকটি। ‘হাজুদের তো মাথা নেই, তাদের শরীর শুরু হয় গলার নীচ থেকে আর শেষ হয় হাঁটুর একটু ওপরে’ আশিস গোস্বামীর লেখা এই সংলাপ কানে বাজবে বহুদিন। ষষ্ঠ দিনের নাটক আয়োজক দল নান্দীমুখের প্রযোজনা ‘আমার আমি।

’ দীপ্তা রক্ষিত নিঃসন্দেহে ভালো অভিনেত্রী, অসীম দাসের নির্দেশনা ক্ষমতাও প্রশ্নাতীত, তবে আমার মনে হয়েছেনাটকটি আরো দৃঢ়, আরো পরিণত হতে পারতো। বাংলা রঙ্গমঞ্চের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী বিনোদিনী দাসীকে নির্দেশক হয়তো আরো দৃঢ়তায়, আরো ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপন করতে পারতেন। এসুযোগে একটি প্রশ্নও করিপর পর দুই উৎসবে নান্দীমুখের একই নাটক দেখলাম। আগামীতে কি ভিন্ন কিছু দেখতে পাবো?

সপ্তম দিনে ছিলো একিক্লেমা থিয়েটার, মেক্সিকো প্রযোজনা ‘মার্কারিও, স্টার্ভিং’ এবং লোট্টো ঘার্টন, সুইডেনএর প্রযোজনা ‘রেনগার, কামপিংগেবেকেন৩’এই দুটি নাটক। ‘মার্কারিও স্টার্ভিং’এ অভিনেতা রিকার্ডোমেনা রোসাডো তার শক্তিশালী শারীরিক অভিনয় দিয়ে মনের দরোজায় কড়া নাড়তে পেরেছেন। সুইডেনএর নাটকটির নির্বাচন যথাযথ হয়নি বলে মনে হয়েছে।

অষ্টম দিনের নাটক ছিলো লা টুরবা কোম্পানী, স্পেন পরিবেশিত নাটক ‘ভেজিটারিয়ান ওফেলিয়া’। সত্যি কথা বলতে কি, এই নাটকটিকেই আমার কাছে এই উৎসবের দর্শকদের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নাটক মনে হয়েছে। শেক্সপীয়ারের নাটকের চরিত্রকে আশ্রয় করে প্রায় দুর্বোধ্য সূত্রাবলী থেকে নাটকের বক্তব্য বা প্রবহমানতা বোঝার যে মাত্রা সেটা উপভোগ করবার চেষ্টা করেছি।

নবম দিনে ছিল থিয়েটার প্লাটফর্ম, ভারতের প্রযোজনা ‘একটি সহজ খুনের গল্প।’ খুবই অনুল্লেখ্য অভিনয় আর দুর্বল মঞ্চক্রিয়ার এই নাটকটি আমাকে আকৃষ্ট করেনি।

দশম এবং শেষ দিনে ছিলো বারাসাত কাল্পিক, ভারত প্রযোজনা ‘ওয়ার্ড নং ৬’। আন্তন শেকভের নাটকটির সার্থক বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন অভিনেতারা। ইভান এবং আন্দ্রের ভূমিকায় দুই অভিনেতা অত্যন্ত প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন, বিশেষত ইভান চরিত্রটিকে আরও অনেকদিন চোখের সামনে দেখতে পাবো।

সমালোচনায় এবং আত্মসমালোচনায় আমরা নিশ্চয় এই নাট্যোৎসব নিয়েও হয়তো অনেক ত্রুটি ধরিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু এই উৎসবে আমাদের অর্জনও অনেক। জীবনানন্দ তার সমালোচকদের উদ্দেশ্যে একবার বলেছিলেন– ‘বরং তুমি নিজেই লেখোনাকো একটি কবিতা।’ আমিও শুধু সেটাই বলতে চাই।

দশটি দিন নান্দীমুখের এই আয়োজনে নাটকে ডুবে থাকতে পেরেছি এজন্য আয়োজকদের প্রাণখোলা অভিনন্দন জানাই। এউৎসব আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত নান্দীমুখের সকল সদস্য এবং যেসব প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহযোগিতা করেছেন তাদেরকেও ধন্যবাদ জানাই। শেষ করছি রবীন্দ্রনাথের একটি নীতিকবিতা দিয়েযথাসাধ্য ভালো কহে, কেঁদে ‘আরো ভালো, / কোন স্বর্গপুরী তুমি করে থাকো আলো?’ / আরও ভালো কেঁেদ কহে, ‘আমি থাকি হায়,/ অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকাত্তরের শহিদ ছবুর ও নেপথ্যের গল্প
পরবর্তী নিবন্ধদ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লিগের ফলাফল