একাত্তরের শহিদ ছবুর ও নেপথ্যের গল্প

রশীদ এনাম | সোমবার , ১২ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ

ছেলেবেলায় মায়ের মুখে প্রথম শুনেছিলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা। সেই সময় নানাবাড়িতে আগুন দিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। চারদিকে আগুন, গোলাগুলি আর বোমাবজি। চিৎকার আর আহাজারির শব্দ। বাতাসে লাশের গন্ধ। মায়ের বয়স আর কত চারপাঁচ। মাকে পাখির ডানার মতো শাড়ির আঁচলে আগলে রাখতেন নানুমণি।

একাত্তরের সেই গল্প শুনে ভয়ে শিউরে উঠতাম। চোখে দেখিনি ’৭১। মুক্তিযুদ্ধের নাটক, ছবি আর ইতিহাস পড়ে উপলব্ধি করতাম, যুদ্ধের স্মৃতিকথা শুনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভাবতাম অনেক শত্রু সেনাদের খতম করব। দেশ স্বাধীন করব, স্বপ্ন ডানায় চড়ে, লাল সবুজের বিজয় নিশান কপালে বেঁধে সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে আনন্দ মিছিল করব। বিজয় মিছিলের স্লোগান হবে, জয় বাংলা! জয় বাংলা!

আহারে, শিকড়ের কাছে শোনা সেই গল্প, মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্ম হয়ে হৃদয় গহিনে ধারণ করে স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ানো। যুদ্ধদিনের গল্প স্মৃতির ঝাঁপিতে রাখার চেষ্টা করেছি মাত্র। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই নক্ষত্র মাটি। যে মাটিতে সবাই হেসেখেলে ঘুরে বেড়াই, জোছনা ভরা রাতে জোছনা উপভোগ করে, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিতে ভিজে। জাঁকিয়ে যখন শীত নামে কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে প্রভাতফেরিতে যায় এদেশের খেটে খাওয়া মানুষ। আনন্দসুখদুঃখ একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা যেন সোনার বাংলাদেশ। এত সুন্দর আমার দেশের মাটি বিশ্বে আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। রাজনীতির কবি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হৃদয়স্পর্শী ভাষণ শুনে সমগ্র দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন হাতে মুঠোয় নিয়েছিলেন।

সেই মামাটির টানে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, খুব কাছের প্রতিবেশী শহিদ গাজী আবদুস ছবুর। যিনি যুদ্ধ শেষে মায়ের কাছে ফিরেননি। ১২টি বছর প্রতীক্ষায় ছিলেন শহিদ ছবুরের মা ছমেরাজ খাতুন। শেষ নিঃশ্বাসটি চলে যাওয়ার সময়ও ছেলেকে খুঁজে বেড়িয়েছেন শহিদ ছবুরের মা। ছেলেও চিরতরে চলে যাওয়ার সময় মাকে দেখার জন্য আর্তনাদ করেছিলেন। শহিদ ছবুর তাঁর সহযোদ্ধদের বলেছিলেন, ‘খবরদার অস্ত্র ফেলো না হাত থেকে। আমি মরে গেলেও দেশ স্বাধীন হবে।’

হ্যাঁ, দেশ স্বাধীন হয়েছে। ৫১টি বছর বৃক্ষের পাতার মতো ঝরে গেল। কী পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা? আজও অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ভাতা থেকে বঞ্চিত। অনেক মু্‌ক্তিযোদ্ধাকে আজও মানুষের হাতে লাঞ্চিত হতে হয়। চিকিৎসার অভাবে না ফেরার দেশে চলে যেতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। আমরা কি দিতে পেরেছি তাঁদের সম্মান কিংবা মর্যাদা ? আহা মুক্তিযোদ্ধা ! তাঁরাই তো সোনার বাংলার সোনার মানুষ। ছবুর মারা যাওয়ার পর তাঁর স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলতে চেয়েছে একটি পক্ষ। তাঁর কবর পাহাড়ে রয়ে গেছে। সঙ্গীসাথি কিংবা পাড়া প্রতিবেশীরা কেউ বলেননি, তাঁর কবর তাঁর গ্রামে মায়ের কবরের পাশে নিয়ে আসার জন্য। তাঁর গ্রামেও হয়নি কোনো শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ। পটিয়া শহরের অনেকে আজও জানেন না শহিদ ছবুর কে? দেশে আজও রয়ে গেছে সেই শকুনের প্রজন্ম। যারা পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করে কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিল। বিচারের বাণী বহুদিন নিভৃতে কেঁদে ফিরেছে। বহু চড়াইউতরাইয়ের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশ আজ কলঙ্কমুক্ত হতে চলেছে। অন্ধকারের অবসান হয়ে, আলোকিত হতে চলেছে দেশ।

৩০ লাখ শহিদের একজন শহিদ গাজী আবদুস ছবুর। গাজী আবদুস ছবুর ১৯৫১ সালে ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়া পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের শেয়ান পাড়ার গাজী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত গাজী আলী চাঁন সওদাগর পেশায় একজন লবণ ব্যবসায়ী এবং মাতা মৃত ছমেরাজ খাতুন। ১৯৭১ সালে ২ অক্টোবর যুদ্ধাপরাধী রাজাকার মারতে গিয়ে সহযোদ্ধার সেম সাইডে শহিদ হয়েছিলেন। পটিয়া কেলিশহরের ভট্টাচার্য হাট এলাকার গুরটিলা পাহাড়ের পাদদেশে বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় তাঁকে দাফন করা হয়েছিল। কেলিশহরের খিল্লা পাড়ার টিলা পাহাড়ের কবরস্তানে। আমার খুব কৌতূহল ছিল, মুক্তিযোদ্ধাশহিদদের সম্পর্কে জানার। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গল্প শোনার। ছাত্রজীবনে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে চট্টগ্রাম জেলার প্রথম আলো বন্ধুসভার উদ্যোগে এবং পটিয়া বন্ধুসভার উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার আয়োজন করেছি বহুবার। প্রায় ১৪ বছর ধরে শহিদ ছবুরের অজানা গল্প কুড়োনোর চেষ্টা করেছি মাত্র। গত ২০১৫ সালে দৈনিক আজাদীর খোলা হাওয়া বিভাগে ‘যুদ্ধশেষে যে দামাল ছেলেটি বাড়ি ফিরেনি’ নামে একটি ফিচার ছাপা হয়। ফিচারটি পড়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মাহাবুবুর রহমান আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন । তিনি বলেন, ‘রশীদ এনাম আমি চাই তুমি একটা বই করো শহিদ ছবুরকে নিয়ে’। বহু চড়াইউতরাইয়ের মধ্য দিয়ে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করি। প্রয়াত শহিদজায়া মুশতারী শফি আন্টি পাণ্ডুলিপি পড়ে মুগ্ধ হন। তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে বইয়ের ভূমিকা লিখে দেন। অতঃপর ২০১৬ সালে বলাকা প্রকাশন থেকে ভূমিষ্ঠ হলো আমার সন্তানতুল্য প্রথম প্রকাশিত বই ‘একাত্তরের শহিদ ছবুর’ ২০১৬ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী প্রফেসর সাবিহ্‌ উল আলম ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুসাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া ও কবি রহীম শাহ বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বইয়েল মোড়ক উন্মোচন করলেন। মেলায় বইটি পাঠকনন্দিত হলো। বিশেষ করে আমার প্রাণের পটিয়াবাসী একটি বিস্মৃত অধ্যায় সম্পর্কে জানল।

পটিয়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শহিদ ছবুর রোড সবাই চিনত। কিন্তু শহিদ ছবুরকে কেউ চিনত না নতুন প্রজন্মরা কিশোর ‘শহিদ ছবুর’ সম্পর্কে জানল। সে সময় আমার সুহৃদ আরিফের পরামর্শে ক’জন বন্ধু মিলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাত্তরের শহিদ ছবুর ফেসবুক গ্রুপ খুলি। গ্রুপটিতে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য আমরা কাজ করতাম। পাশে থাকত পটিয়ার কনফিডেন্স কোচিং সেন্টারের ছাত্রছাত্রীরা।

লেখালিখি হওয়ার পর শহিদ ছবুরের নামে পটিয়া কেলিশহরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। ইশকুলটি প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেনপ্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট হরিসাধন দাদা ও পটিয়ার সংসদ মাননীয় হুইপ শামসুল হক চৌধুরী। আমরা দাবিদাওয়া করার পর তাঁর স্মৃতিবিজড়িত ইশকুলে শহিদ মিনার স্থাপন করা হয়। আমার পরিকল্পনায় শহিদ ছবুরের নামে পটিয়ায় প্রথম শিশুতোষ পাঠাগার স্থাপন করা হয়। সবচেয়ে বড়ো অর্জন শহিদ ছবুরের নাম ৫১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গেজেট ভুক্ত হয়। দীর্ঘসময় পর শহিদ ছবুর পরিবার শহিদ ভাতা পেতে যাচ্ছেন।

ধামাচাপা পড়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া মু্‌ক্তযোদ্ধাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে লেখা গল্পের ঝাঁপি মেলে দিলাম নতুন প্রজন্মের কাছে। জানি না শহিদ ছবুরের আত্মা শান্তি পাচ্ছেন কি না। এঅর্জন আমার নয় প্রিয় পাঠক এবং আমার পটিয়বাসীর।

প্রিয় পাঠক! শুধু এটুকু বলব, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কেউ অসম্মান করবেন না। যাঁরা যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন কিংবা না ফেরার দেশে চলে গেছেন তাঁদের পরিবারের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিন। তাঁদের কাছে থাকবেন, পাশে থাকবেন, খোঁজখবর নিবেন। মুক্তিযোদ্ধের সঠিক তথ্য ও ইতিহাস তুলে ধরবেন। ভুলে যাবেন না, তাঁদের আত্মত্যাগের কারণে এই সোনার বাংলাদেশ। শহিদ ছবুরের গ্রাম পটিয়া পৌরসভার শেয়ানা পাড়ায় তাঁর কোনো স্মৃতি নেই। তাঁর কবরটিও রয়ে গেছে পটিয়া কেলিশহরের গুরটিলা পাহাড়ে। আমাদের প্রত্যাশা শহিদ ছবুরের কবরটি শেয়ান পাড়া গ্রামে কেলিশহর থেকে নিয়ে আসা হোক এবং তাঁর গ্রামে ‘একাত্তরের চেতনা ও শহিদ ছবুর স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করছি। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর তনয়া মানবতার মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় ও মু্‌ক্তযোদ্ধা মন্ত্রী এবং শহিদ ছবুর পরিবারের প্রতি যারা ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছেন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই একাত্তরের শহিদ ছবুর সহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সকলকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধনান্দীমুখ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০২২ : একজন দর্শকের চোখে