মহামতি লেলিন বলেছেন, ‘নারীর সাহায্যে, তার চিন্তাশীলতা ও সচেতনতায় নব সমাজের নির্মাণ সুদৃঢ় হতে পারে’। বলছি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক আত্মপ্রত্যয়ী নারীর সৃষ্টির ইতিহাস। বিশ্বাস, ভালোবাসা আদর ও শাসনের বুনোটে বাধা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম বৃত্তান্ত। ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইট পাথরে ঢাকা এই চট্টগ্রাম শহরের বুক চিরে ছোট্ট একটি চারা গাছ সবে সূর্য রশ্মির আলোক ধারায় স্নান করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক যত্ন করে দুহাতে আঁকড়ে ধরে যিনি চারা গাছটি বপন করেছিলেন তিনি আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয়া মহীয়সী নারী নাদেরা বানু বেগম। যার হাতের ছোঁয়ায় কতশত বাধা অতিক্রম করে চারা গাছটি আজ ‘বাংলাদেশ এলিমেন্টারি স্কুল’ নামে বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়েছে। প্রচারবিমুখ এই নারী ১৯৪৪ সালের ২৯শে জুন কলকাতায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বাবা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম ও মা রাহাত আরা বেগমের কোল আলো করে এই পৃথিবীতে আসেন। তিনি ছিলেন ভাই বোনদের সবার ছোট। বলা বাহুল্য প্রখ্যাত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ভৌত বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলামের ছোট বোন তিনি। তবে ভাই বোনদের সাথে বয়সের পার্থক্যের কারণে তিনি একটা সময় একাকী হয়ে পড়েন। মাত্র চার বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুতে ছোটবেলা থেকে অনেকটা চ্যালেঞ্জিং মনোভাবেই বড় হবার তাগিদ অনুভব করেন। আধ্যাত্মিক চেতনায় রত বাবার কাছ থেকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা পেয়েছিলেন। নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি খুবই অল্প বয়সে এসএসসি পরীক্ষায় সফলতা লাভ করেন। ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রি সম্পন্ন করার পাশাপাশি তিনি ব্যাচেলর অফ এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই সময়কার প্রেক্ষাপটে নিজের চেষ্টা ও উদ্যোগে তিনি পড়ালেখায় সফল হন। পরবর্তীতে বিশিষ্ট নামকরা ব্যবসায়ী মি. এস এম খলিল এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষিকা হিসেবে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘ ২৮ বছর চাকরি শেষে শিশুদের মানবিক ও নৈতিক চেতনায় গড়ে তোলার লক্ষ্যে নাদেরা বানু বেগম মাত্র ৩৫ জন শিক্ষার্থী ও ১২ জন শিক্ষক নিয়ে একটা স্বপ্নের সূচনা করেন।
এই পৃথিবীতে মানুষের চাওয়ার শেষ নেই, স্বপ্নের শেষ নেই। বিশাল চাওয়া পাওয়াগুলো মানুষকে অন্য মানুষে পরিণত করে দেয়। কিন্তু জীবনের অতি ক্ষুদ্র চাওয়া ও স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে একজন নারী কিভাবে লড়াই করে গেছেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ শ্রদ্ধেয়া নাদেরা বানু বেগম।
শুধু শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে শিশুদের সঠিক পথে ধাবিত করার জন্য শিক্ষকদের বেতন সংকুলান করতে না পেরে নিজেও পাঠদান করতে শুরু করেন। নতুন করে শুরু করেন জীবন যুদ্ধ। সেই জীবন যুদ্ধের সৈনিক হলেন গুটি কয়েক শিশু ও শিক্ষক। দেশ বিদেশের নামিদামি লেখকদের বই তিনি সংগ্রহ করতে শুরু করেন, রাত জেগে টাইপ রাইটারে নিজেই প্রশ্ন তৈরি করতে শুরু করেন। এভাবেই কর্মকে ধর্ম মেনে অনলস পরিশ্রম করা একজন মানবী যিনি ক্যামব্রিজের অধীনে ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে প্রথমবারের মতো ও লেবেল উত্তীর্ণ করান।
নাদেরা বানু বেগম যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সঠিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা। যার স্বপ্ন ছিল ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ছড়িয়ে পড়বে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে। শুধু বিশেষ এক শ্রেণিতে তা সীমাবদ্ধ থাকবে না। তার ইচ্ছে ছিল রিকশায় চড়ে এসেও তারা ইংরেজিতে কথা বলবে। শুধু ধনীক শ্রেণির ঘরে নয়, ইংরেজিতে কথা বলতে শিখবে সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা। এই চিন্তা–ভাবনা থেকেই তিনি তার স্কুলে আর্থিক সমস্যাগ্রস্ত অনেককেই বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। অনেকের কাছ থেকে ভর্তি ও মাসিক ফি নামে মাত্র নিয়েছেন। তিনি সবসময় বলতেন ‘বাংলা আমার অস্তিত্ব কিন্তু ইংরেজিতে আমার বেঁচে থাকা’। তিনি আরো বলতেন বাচ্চাদের অভাব দেখাও। চাইবার আগেই দিয়ে দিওনা যেন। তাহলে ওরা অভাবের মর্ম বুঝবে না। ২০০৭ সালে সারা দেশ যখন সিডরের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল সেই দিনে নাদেরা বানু বেগম পরিবারকে উপেক্ষা করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে আসেন শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য। তাদের পরবর্তী অবস্থা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। যদিও সৃষ্টিকর্তার অপার অনুগ্রহে আমরা অনেকটা রক্ষা পেয়েছিলাম। একটা স্কুলকে প্রতিষ্ঠা করানোর জন্য এমন দিনও গেছে তিনি কলা ও মুড়ি খেয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত স্কুলে রয়ে গেছেন। নাদেরা বানু বেগম একজন লড়াকু নারীর নাম। এ লড়াই শিক্ষার জন্য, এ লড়াই শিক্ষিত করার জন্য। লড়াই করেছেন প্রতিকূল পরিবেশের সাথে। কখনো সমাজ, কখনো পরিবেশ, কখনো সমাজের মানুষগুলোর সাথে। কিন্তু জয়ী হয়েছেন প্রতিবারই। প্রচার বিমুখ এই মহীয়সী নারী ছিলেন দানশীল। কাউকে দান করতে পারলেই যেন তিনি তৃপ্তি বোধ করতেন। তাইতো নিজের এবং বাবার সম্পত্তি সবই দান করে গেছেন। চিকিৎসা করতে অপারগ কিংবা ভারত থেকেও বিমুখ হয়ে ফিরতে হয়েছে অথবা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে এমন রোগীকেও তিনি লাখ লাখ টাকা দান করে গেছেন। চট্টগ্রাম শহরের মসজিদ, মন্দির মাজার এবং অনাথদের তিনি দান করতে কখনোই কার্পণ্যবোধ করেননি। নিজের প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মচারী থেকে শুরু করে কর্মকর্তা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল তার দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা। তবে সবাইকেই এর জন্য দিতে হত নামে মাত্র ১০ টাকা করে। তিনি মনে করতেন বিনা পয়সার চেয়ে ঐ ১০ টাকা নিলে প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা হীনম্মন্যতায় ভুগবে না। বাংলাদেশে একমাত্র তিনিই বোধহয় এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আজ শুধু চট্টগ্রামে নয় বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নামিদামি অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নাদেরা বানু বেগমের হাতে গড়া সেই চারা গাছটির কলিগুলো। আজ তারা ফুল হয়ে সারা বিশ্বে এই প্রতিষ্ঠানের সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। নাদেরা বানু বেগম একজন শক্তিশালী ও সহনশীল মানুষের নাম। অনুপ্রেরণা শব্দটি যেন তারই জন্য সৃষ্টি। না বোধক শব্দ তার অভিধানে নেই। জীবনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন এবং সবাইকে জীবনের ইতিবাচক দিকটি দেখিয়েছেন। শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্যে তিনি একনিষ্ঠ প্রাণ। তিনি অন্যায়ের কাছে আপস করেননি। একমাত্র স্রষ্টা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করেননি। ধর্মপ্রাণ, স্বল্পভাষী হাসিমাখা মুখশ্রী এই পরম কল্যাণময়ী ব্যক্তি জীবনে চার সন্তানের জননী। তার পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ, জামাতা সবাই জীবনের প্রতিটি ধাপে নিজেদের অধিষ্ঠিত করেছেন স্বীয় যোগ্যতায় এবং মর্যাদাপূর্ণ আসনে। ঘরে যেমন আদরের নাতি নাতিন তেমনি প্রতিষ্ঠানে স্নেহের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাথে রয়েছে অফিস স্টাফ আয়া দারোয়ান সবাই। সবার প্রিয় ম্যাডাম। শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একই আবর্তে নিয়ে আসার এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তিনি। জীবনের এই প্রান্তে এসে আজ অনেকেই জানতে পেরেছেন এই মহীয়সীর অসামান্য কীর্তি। ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সোসাইটি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আজ নাদেরা বানু বেগমকে যথাযোগ্য সম্মান দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। যদিও তিনি অনেক আগেই তা পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। বেঁচে থাকুন আমাদের আলোকবর্তিকা নাদেরা বানু বেগম। আমরা তার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। পরিশেষে বিখ্যাত উক্তি দিয়েই শেষ করছি– ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেবো।’ নেপোলিয়ান বোনাপার্ট।
লেখক : কবি–গল্পকার ও শিক্ষক