নাটকে দর্শকের গুরুত্বকে আমরা কিভাবে দেখি। কারা নাটক দেখে। কি জন্য নাটক দেখতে আসে। শুধু কি এক ধরণের বিনোদনের প্রত্যাশা থেকেই দর্শক মঞ্চনাটক দেখে। নাকি অন্য কোনো কারণ থাকে নাটক দেখার পেছনে।
আমরা যারা নাটক করি তারা কিভাবে দর্শককে দেখি। নাট্যকার, অভিনেতা, দর্শকের কাছে কি চায়। নাটকের সাথে দর্শকের সম্পর্কটা কিভাবে তৈরি হয়। কেমন এই সম্পর্ক। নাটক দেখে দর্শক যখন আবেগ, উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগে ভেসে যায়, তখন কি নাটক তার গুরুত্ব হারায়? তাহলে দর্শক নাটক দেখে কি নিয়ে ফিরতে চায়? ডিজাইন, অভিনয়, মেসেজ– কোনটা দর্শকের কাছে গুরুত্ব পায়?
আমরা যখন নাটক নির্মাণ করি তখন কি দর্শককে ভেবে তৈরি করি? কারা আমাদের নাটক দেখবে সেটাকে বিবেচনায় রাখি? আশি–নব্বই দশকের তরুণ কোনো নাট্য–দর্শক এমনকি সেই সময়ে যুক্ত নাট্যকর্মীরা বর্তমানের দর্শকসারিতে একেবারেই অনুপস্থিত। এমনটা ঘটে কেন? কোন কোন সময়ে এমনও ঘটতে দেখা যায়, দর্শক কোন একজন বিশেষ নির্দেশক কিংবা অভিনেতা–অভিনেত্রীর মঞ্চায়ন দেখতেই আসেন। সেই দর্শক আসলে নাটকের কাছে কি চায়? এই ব্যক্তিগত উপলব্ধিসমূহ নাটকের কলাকুশলীরা কি বুঝতে পারেন? কিংবা ক্রমাগত এমনতর বিষয়গুলো তারা মোকাবেলা করেন কিভাবে। আবার কখনও কখনও বিপুল পরিচিত নাট্যকারের নাটক যখন দর্শক দেখে তখন কেমন প্রত্যাশা কাজ করে দর্শকের। তিনি কি কিছু ভেবেই নাটক দেখতে যান? এসবক্ষেত্রে অভিনেতা অভিনেত্রীরা কখনও কখনও কোন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেন কিনা। হঠাৎ করে একটা নাটক বারবার প্রদর্শনী যখন হয়, নিশ্চয়ই প্রতি প্রদর্শনীর দর্শক তো একরকম থাকে না। এই তারতম্য তেমন সংকট তৈরি করে কিনা । নাট্য অভিনেতাদের ও নির্দেশকের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি করে কিনা। হলভর্তি দর্শকের মধ্যে নাটক দেখা আর সীমিত দর্শকের ভিতর বসে নাট্য প্রযোজনা দর্শককে মনোযোগী হতে সহায়তা দেয় নাকি বিপরীত পরিস্থিতি তৈরি করে?
আবার দর্শকের জন্য একটা নিখুঁত প্রযোজনা তৈরির লক্ষ্যে কি কি বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়। একটি প্রযোজনার প্রস্তুতি কতটুকুইবা দর্শক জানতে পারে। প্রথমত, দৃশ্যকল্প তুলে ধরা। দ্বিতীয়ত, দর্শক উপস্থাপিত দৃশ্যকে কতটা গ্রহণ করছে কিংবা তার চিন্তার সাথে সম্পর্ক নির্মাণ করতে পারছে কিনা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা।
নাট্য নির্দেশক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক অসীম দাশ বলেন, “দর্শক ছাড়া থিয়েটার হতেই পারে না। দর্শক থিয়েটারের প্রাণ। নাটকে দর্শকের সাথে অভিনেতার সেতুবন্ধন না হলে পরিপূর্ণতা আসে না। অভিনেতা, স্পেস ও দর্শক এই তিনের সমন্বয়ে থিয়েটার।”
এখন প্রশ্নটা এখানে একজন অভিনেতার সাথে দর্শকের সেতুবন্ধন তৈরির তকমাটা কি। কি করে অভিনেতা বুঝবেন তার সাথে দর্শকের কখন কোন মুহূর্তে সেতুবন্ধন তৈরি হলো। এমন কি পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যেমন, এই সেতুবন্ধনে নাট্যকার তার নাট্য রচনায় কিংবা নির্দেশক তার প্রযোজনায় এই বিষয়কে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে। দায়টা বেশি বেশি কার।
নবীন নাট্যনির্দেশক সুমন টিঙ্কুর ব্যাখ্যাটা এমন, “যদিও দর্শকের প্রকারভেদ আছে। তবে এই দর্শকই আমার কাছে শেষ বিচারক। যাঁর বা যাদের রায় আমাকে একটা নির্দিষ্ট রেখার সামনে দাঁড় করায়।”
দর্শকের প্রকারভেদের অবস্থানটা আমরা কিভাবে বুঝি; সামাজিক, রাজনৈতিক নাকি শ্রেণীগতভাবে? দর্শকের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকাটা কে রাখে; নাট্যকার, নাট্য নির্মাতা, নাকি অভিনয় শিল্পী? অথবা সীমারেখাটা সবার ক্ষেত্রে একই রকম কিনা।
অভিনেত্রী কঙ্কন দাশ বলেন, “দর্শক হচ্ছে জীবন্ত অনুভূতি। এই দর্শকই হচ্ছে হৃদস্পন্দন। আমরা মঞ্চে যা কিছু করি দর্শকের সাথে সম্পর্ক নির্মাণের জন্যই করে থাকি। দর্শক ও অভিনেতার সম্পর্ক হলো আদান প্রদানের।”
এই আদানপ্রদান মূলত কিভাবে ঘটে। কিসের আদান প্রদান। অনেক সময় অমনোযোগী দর্শককে নিয়ে প্রযোজনাটি যখন শুরু হয় তখন মনোযোগী করে তোলার দায়টাও কি অভিনেতার? নাকি নাট্যকার কোথাও গিয়ে সংযোগ ঘটাতে ব্যর্থ। তখন অভিনেতা কি দায়িত্ব নিতে পারে? সেখানে আদান–প্রদানের বিষয় এক তরফা ঘটে কিনা? তখন দর্শক কিভাবে মূল্যায়িত হবে? এই পর্যন্ত নাট্য কুশীলবদের সাথে দর্শকের সম্পর্ককে মিলনায়তনের ভিতর প্রদর্শিত নাটককে কেন্দ্র করে ভাবা হয়েছে।
১৯৮৩ তে অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায় থেকে যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সেলিম আল দীন রচিত ‘বাসন’ নাটকটি নিয়ে মুক্তমঞ্চে গ্রামে ও শহরে মঞ্চায়িত করা হবে। মঞ্চের বাইরে নাটক করার অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে এগিয়ে এলেন জামিল আহমেদ। তিনি খোলা জায়গায় অনেক মানুষের উপস্থিতিতে একটা উচ্চতা রেখে অভিনয়ের জন্য এমনভাবে পাটাতন তৈরি করলেন; পাশাপাশি রাতের বেলায় গ্রামে হাজার হাজার দর্শকের সামনে কিভাবে মঞ্চ আলোকিত করা যায় তারও একটা পরিকল্পনা সম্পন্ন করলেন জামিল আহমেদ ও মুনির হেলাল। তারপর অভিনয়ের প্রস্তুতি শেষে কয়েক হাজার দর্শকের সামনে পরিবেশিত হলো ‘বাসন’। নাট্য নির্মাতা হিসেবে আমার একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। এই বিশাল দর্শকের সাথে আদান–প্রদান, পূর্বের অভিজ্ঞতা কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন ঘটছে অভিনেতাদের স্বরপ্রক্ষেপণ, সংলাপ কিংবা অভিনয়রীতি। অভিনয়শিল্পীরা যেমন কামাল রেজা, আবুল কালাম তুহিন, ফরিদা নাসরিন, হাসান আহমেদ খান– তাঁদের অভিনয় দক্ষতা এমন একটা সংযোগ স্থাপন করলো যেখানে দর্শকের চরিত্রই পাল্টে গেল। তাই বলা যায় অভিনয়ের বিবর্তনের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের দর্শকের রুচি, অভিজ্ঞতা– যা অনেকাংশেই নির্ভর করে কিংবা নিয়ন্ত্রণ করে নাটকের বিষয়বস্তুকে।
নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা আহমেদ ইকবাল হায়দার বিষয়টিকে যেভাবে দেখেন, “দর্শক নাটকেরই একটা অংশ। নাটক বলতে বুঝি দুটো দল যেখানে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঘটে। একদিকে অভিনেতা ও নাটকের কলাকুশলী। অপরদিকে দর্শক। যখন উভয়মধ্যে ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া ঘটে তখনই নাটক তৈরি হয়।”
ভিন্ন ভিন্ন নাটকের ভিন্ন ভিন্ন দর্শক কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি? সাহিত্যনির্ভর পাণ্ডুলিপি, বিদেশি ক্লাসিক্যাল, নিরীক্ষাধর্মী বা রবীন্দ্রনাথের নাটকের দর্শকের ভেতর কোনো পার্থক্য তৈরি হয় কি? নাকি সব দর্শকই একইরকম? নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। যখন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘লালসালু’ মঞ্চে আনি তখন সবকিছুর আগে ছিল উপন্যাসের নাট্যরূপ কতটা গ্রহণযোগ্য হবে দর্শকের কাছে। উপন্যাসের মঞ্চায়নে যথেষ্ট জটিলতা থাকবেই। বলা যায়, দর্শকের অনেকেরই যারা নাটক দেখতে আসে উপন্যাস পড়া থাকে। এখানে দর্শক প্রতিক্রিয়া অনেকাংশে বিন্যাস, অভিনয়, প্রয়োগ পরিকল্পনার উপর নির্ভর করে। দর্শকের প্রথমেই উপস্থাপিত প্রশ্ন তৈরি হয় কেন এই নাটক। তারপর আসি চরিত্রের ব্যাখ্যায়। উপন্যাস পড়ার ভেতরেই দর্শকের চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হতে থাকে। মঞ্চে অভিনয়কালীন তার কল্পনার সাথে নতুন নির্মিত চরিত্রের পার্থক্যটিকে তারা কিভাবে গ্রহণ করে। এই কঠিন কাজটি করতে খুবই সংযত অভিনয়ধারাকে সামনে নিয়ে তৈরি হলেন আকবর রেজা, সাবিরা সুলতানা, ফরিদা নাসরিন, নেসার উদ্দিন দুলু। দর্শক গ্রহণ করলো। অতি নাটকীয়তার কোনো সুযোগ তৈরি হলো না। ‘নাটক’ তৈরি হলো। অমন কাজ এখন খুব চোখে পড়ে না।
এখন মৌলিক নাটক অনেক বেশি বেশি করার চেষ্টা হয়। দর্শকের সাথে আদান–প্রদান কিংবা দর্শককে কেন্দ্র করে নানা উপন্যাস, গল্প, প্রযোজনা আরও বেশি বেশি হতে পারে। দর্শকের চাহিদার কথা তাই বিবেচনায় রাখা খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।
নির্দেশক শুভাশিস সিনহা বলেন, “দর্শকের ভূমিকা নাটকে অনেক বড়। নির্দেশকের যেমন দায় আছে, দর্শকেরও দায় আছে। নাটকটি উপভোগের ক্ষেত্রে এবং গ্রহণের ক্ষেত্রে উভয়ই নিজের চিন্তা–ভাবনা উপলব্ধির জায়গাটা প্রশমিত করে। এভাবেই নাটকটি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।”
দর্শকের থিয়েটার কি এভাবেই তৈরি হয়? এই উপলব্ধির জায়গাটা আবিষ্কার কি আমরা নাট্য নির্মাতারা করতে পারি? থিয়েটার তো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। সারা পৃথিবীতে নাটক নিয়ে ঘটে থাকে প্রতিনিয়তই নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা। দর্শকও কিন্তু এক্ষেত্রে একজন অংশগ্রহণকারী। দর্শক অংশগ্রহণকারীর নানা ধরণ এখানে তৈরি করে থাকে। কিন্তু সূত্রপাতও করে নানামুখী থিয়েটার প্রযোজনার প্রবণতা। যেখানে দেখা কিংবা শোনার ভেতরেই কেবল তৈরি হয় না সম্পর্ক। অভিনয়ের ভেতরেও তৈরি হয় এক উজ্জ্বল বিশ্বস্ততার ঘটনা। যেমন বলতে পারি ‘নূরলদীন’ চরিত্রে প্রয়াত আলী যাকেরের নাম। এই ধরণের চরিত্র রূপায়নে ঘটে যায় চরিত্রকে দর্শকের সামনে তুলে আনা। তাই একজন অভিনেতার বিভিন্ন গোত্রের অভিনয়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপন জরুরি। সেখানেই গড়ে ওঠে দর্শকের সাথে নিবিড় সম্পর্ক। এরকম উদাহরণ আজকালের মঞ্চে খুব বেশি দেখা যায় না। এটা ঘটে না বলেই দর্শক অনেক সময় সরিয়ে নেয় নিজেকে। যুক্ত থাকতে চায় না থিয়েটারের নানা বিশ্লেষণে।
অভিনেত্রী নাজনীন হাসান চুমকী বলেন, “দর্শকদের উপস্থিতি আমার সবার আগে কনসার্ন। দর্শক আমার কাছে নমস্য। আমরা যা কিছু পারফরমেন্স করি, দর্শকের জন্য করি। দর্শক যে নাটকটি দেখতে আসবে তিনি তা যেন গ্রহণ করতে বা বুঝতে পারে এমন প্রস্তুতি নিয়ে যেন সে আসে।” দর্শকের প্রস্তুতির বিষয়টিকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। যখন একটি নাটক দেখার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে আসে তখন সে কি ধরণের ভাবনা থেকে আসে। নাটকের পূর্বে তার আগাম প্রস্তুতিটাই বা কিরকম হতে পারে। একজন আপদমস্তক দর্শক ক্রমাগত নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্যই নাটকের দর্শক হয়?
মঞ্চ নাটকের বাইরেও দর্শক হিসেবে যারা তাৎক্ষণিকভাবে হঠাৎ কোন প্রস্তুতি ছাড়াই হয়ে পড়েন নাটকের দর্শক। কিংবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুক্ত নাটক/ পথনাটকের দর্শক অনেকক্ষেত্রেই সত্যিকারের নাট্য দর্শকে রূপান্তর করেন নিজেকে। তবে এই নাটকের দর্শকদের নিয়ে হতে পারে আলাদাভাবে আলোচনা। তাদেরকে আমরা দর্শক হিসেবে কতটা ভাবি। এই পথের দর্শকরা নাটকের কোন বিষয়টি নিয়ে যায় সাথে করে। নাটক দেখার অভিজ্ঞতাই কেবল তাঁর প্রাপ্তি? এখানে মঞ্চের ভেতর যে নাটক তার মতো নেই কোন আলো, পোশাক কিংবা পরিচ্ছদ। শুধু কি নির্ভরতাই মানুষের মুখোমুখি করে এই নাটকের অভিনয়শিল্পীদের? কিসের ভরসায় তারা দাঁড়িয়ে যায় কিংবা ভিতরকার শক্তিটা পায়, কিংবা আদান–প্রদান সম্পর্ক তৈরি কতটাই বা টিকে থাকবে! একেবারে সাধারণ দর্শক যে আন্দোলিত হয়ে ঘরে ফিরে তার কাছে ‘নাটক’ কিভাবে আসে। তার দেখা কোনো একটি চরিত্র যদি চোখের সামনে উঠে আসে, তার অভিব্যক্তি তখন কিভাবে দেখে নাট্যশিল্পী কিংবা নির্মাতা? তেমন নাটকের কাজগুলো কি আমরা ধরে রাখি? এমন অনেক অভিজ্ঞতা আমাদের পঞ্চাশ বছরের নাট্যচর্চায় কতটাই বা লিপিবদ্ধ করা গেছে! এ–প্রশ্ন রেখে শেষ করা যায় আসলে দর্শক ও নাটক খুব কি কাছাকাছি? নাকি ক্রমে অনেক দূরত্বে তৈরি হচ্ছে এই দুইয়ের অবস্থান?