আজ পহেলা বৈশাখ। ১৪২৭ সনকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আজ যুক্ত হচ্ছে নতুন একটি বছর ১৪২৮। কোনো উচ্ছ্বাস, আনন্দ ও উদ্দীপনা না থাকলেও জাতীয় জীবনে নববর্ষের গুরুত্ব অত্যধিক। মনকে রাঙিয়ে দিতে পারে নতুন দিনের নতুন স্বপ্ন। এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আমাদের প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রথম স্বপ্ন হলো করোনাভাইরাস মুক্ত নতুন বিশ্ব- সোনার বাংলাদেশ । বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাঙালি করোনা মহামারি থেকে সহসা মুক্তির প্রত্যাশা নিয়েই আজ দ্বিতীয়বারের মতো নতুন বছরকে বরণ করে নেবে তেমন কোনো রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চন্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। তখন পয়লা বৈশাখ উদযাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সরকারি ছুটি বাতিল করেছিল। বাঙালির অমিত শক্তির সামনে সেই অবদমন ধোপে টেকেনি। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন তার অমিত শক্তির বিশেষ দিক। এই দিক বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সীমান্ত অতিক্রম করেছে। বৃহত্তর সামাজিক পাটাতনের পরিসর বাড়িয়েছে। সৃষ্টি করেছে উদ্যম ও ব্যাপ্তিতে জাতিসত্তার বলয়।
দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসামপ্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। স্বাধীনতার পর আমাদের জনজীবনে বাংলা নববর্ষ নবতর জাতীয় চেতনার সঞ্চার করে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার মধ্যেও বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সর্বজনীন উৎসবে।
পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উৎসব। অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের মতে, ‘বাংলা নববর্ষে মহামিলনের আনন্দ উৎসব থেকেই বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করবার আর কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার অনুপ্রেরণা পায় এবং জাতি হয় ঐক্যবদ্ধ।’
এবারে নববর্ষ এসেছে এমনি এক সময়ে, যখন সমস্ত জাতি ও সমগ্র বিশ্ব এক অজানা ভাইরাসে আতংকিত। বিদায়ী পুরো বছরটা গেছে মৃত্যু আর আতঙ্কে। অসুস্থতাকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে সমগ্র মানবকুলকে।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মতো আমরাও এদিনে প্রার্থনা করতে পারি, অগ্নিস্নানে শুচি হোক বাংলাদেশ। আমরা সব জনগোষ্ঠীর মানুষ এক হয়ে ফসল উৎপাদন করি, বনভূমি রক্ষা করি, নদী রক্ষা করি, সৃষ্টির যা কিছু মহৎ সুন্দর তাকে আহ্বান করে মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের সমন্বয়ে প্রিয় স্বদেশের ভূখণ্ডকে সুন্দর করি। আবারও সেই আহ্বান, এসো, এসো হে বৈশাখ। তোমার নতুন প্রাণের উজ্জীবিত শক্তিতে আমরা পাহাড়প্রমাণ সমস্যাকে দূর করব।
আমাদের আজ সেই প্রার্থনা। জীবনকে সুখী ও সুন্দর করতে আমরা যেন সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনা করতে পারি। গত এক বছরের জাতীয় জীবন আমাদের সামনে এ শিক্ষা বড় করে তুলেছে যে সংকীর্ণ হীনস্বার্থের ভাবনা নিয়ে মহৎ কিছু অর্জন করা যায় না। জাতি হিসেবে বাঁচতে হলে সমষ্টির কথা আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। সমষ্টিকে বাদ দিয়ে এগুতে চেষ্টা করা হলে সত্যিকার এগুনো হবে না। তাই আজকের নববর্ষে আমাদের প্রার্থনা : আমরা জীবনকে সুখী ও সুন্দর করবার জন্য অক্লান্ত সাধনায় আত্মনিয়োগ করবো। আমরা সমগ্র জনতাকে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাবো স্বাস্থ্যের পথে, এগিয়ে যাবো অগ্রগতির পথে- সেই কামনা আমাদের।