বিপুল ঘটনা প্রবাহের সঙ্গত–অসঙ্গত পরিশিষ্ট নিয়ে ২০২৪ সাল অতিবাহিত হয়েছে। ২০২৫ সাল নিয়ে দেশসহ বিশ্ববাসীর প্রধান প্রত্যাশা হচ্ছে হত্যা–গণহত্যার কদর্য অভিপ্রায়ে যুদ্ধমুক্ত মানবিক ধরিত্রীর। বিগত কয়েক বছর আগে করোনা অতিক্রান্তের অব্যবহিত পরেই রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, টালমাটাল আবর বিশ্ব, পরিবেশ দূষণের নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত ও মানুষের নিত্যদিনের ভয়াবহ চিত্রপট পুরো মানবসভ্যতাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছিল। কোথাও নিরাপদ শান্তির বার্তা মানুষের কানে পৌঁছেনি। আধুনিক কথিত উন্নয়ন বিশ্বের ক্ষমতাধর কর্তৃত্ববাদী সরকার সমূহের যুদ্ধংদেহী মনোভাব বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করছে। একদিকে মানবতার চরম বিপর্যয়–মানবাধিকারের নির্লজ্জ লঙ্ঘনে হত্যা–গণহত্যার ঘৃণ্য দৃশ্যপট নির্মাণ; অন্যদিকে তাদেরই সৃষ্ট ভয়াবহ অস্ত্র প্রতিযোগিতা বিশ্বকে চরম পর্যুদস্ত করে চলছে। শতকোটি মানুষের মানবেতর জীবন যাপনে তাদের ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ নেই। মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই নতুন নতুন আধুনিক অস্ত্রের উৎপাদন–ব্যবহার এবং বিক্রি এক বিকারগ্রস্ত বিশ্ব তৈরিতে কুৎসিত ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অর্থলিপ্সুতা ও আধিপত্যবাদ সর্ব নিকৃষ্ট হিংস্রতাকে অবিরাম জাগিয়ে রাখছে। সত্য–সুন্দর–কল্যাণ–আনন্দের সকল অনুষঙ্গগুলোকে ঘৃণ্য উম্মাদনায় খুন করে বিশ্বকে লণ্ডভণ্ড করার ভয়ঙ্কর অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বিশ্বের সকল জাতিরাষ্ট্রে প্রচলিত ধর্মীয় ঐতিহ্য, রাজনৈতিক আচরণ ও আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারে সাংস্কৃতিক–অসাম্প্রদায়িক সৌহার্দ–সম্প্রীতির বন্ধন অক্ষুণ্ন থাকলেও শক্তিমত্তায় অন্ধ রাষ্ট্রগুলো তা পরিপূর্ণ অবজ্ঞা করে চলছে।
মানবাধিকার সুরক্ষার নামে বিপুল সংখ্যক দেশে গৃহযুদ্ধ বহাল রেখে প্রাকৃতিক সম্পদসহ সামগ্রিক লুন্ঠনে তাদের জুরি নেই। এসব হীন কাজে লিপ্ত সকল অশুভ শক্তিসমূহ ঐক্যবদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নির্মম নির্দয় অত্যাচার–অনাচার, হত্যা–গণহত্যা সভ্যতাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে তার নির্মোহ পর্যালোচনা জরুরি। স্বল্প পরিসরে বিশদ ব্যাখ্যা সম্ভব না হলেও এটুকু নিশ্চিত বলা যায়; লোমহর্ষক গাজা উপত্যাকা–সিরিয়া ও অন্যান্য দেশে এদের বর্বর অভিযানে বিশ্ব বিবেক প্রায় নিশ্চুপ। বিশ্ববাসী সম্যক অবগত আছেন, গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ ফিলিস্তিনের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘকাল ধরে পরিচালিত যুদ্ধের অংশ হিসেবে হামাসের ইসরাইল আক্রমণকে কেন্দ্র করে ইসরাইলের পক্ষ থেকে গাজা ও পশ্চিম তীরে নৃশংসতম হত্যা–গণহত্যার দৃশ্যাদৃশ্য ভয়ঙ্কররূপ পরিগ্রহ করেছে। বিশ্বের কতিপয় ক্ষমতাধর কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রনায়কের প্রত্যক্ষ মদদ ও আধুনিক সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখে নারকীয় তান্ডবের নজিরবিহীন দৃশ্যপট তৈরি করে চলছে।
সমগ্র ধরিত্রীর সভ্যসমাজ বোবা দৃষ্টিতে এহেন বর্বর কর্মযজ্ঞ শুধু পর্যবেক্ষণ করছে না; তীব্র ঘৃণা ও নিন্দার সাথে ইসরাইলি বেপরোয়া অপকৌশল প্রত্যাখান করছে। ইসরাইলকে সরকার প্রধানদের সমর্থন স্ব স্ব দেশে সাধারণ জনগণ কর্তৃক জঘন্য ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষ যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পক্ষাবলম্বন করা সত্ত্বেও কথিত প্রভাবশালী একটি দেশের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে তা নস্যাৎ হয়েছে। তথাকথিত মানবাধিকার সুরক্ষার সবক প্রদানকারীদের কঠিন হৃদয় এত বিশাল সংখ্যক শিশু–কিশোর–নারী হত্যায় মোটেও বিচলিত হচ্ছে না; বরং নিষ্ঠুর সংঘাতের মনোভাব নিয়ে পুরো ফিলিস্তিনকে পরিপূর্ণ ধ্বংসের হীন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ভোর পর্যন্ত গত ১৪ মাসব্যাপী ইসরায়েলি অভিযানে গাজায় নিহত হয়েছে ৪৫ হাজার ৩১৭ জন এবং আহত হয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৭১৩ জন। মন্ত্রণালয়ের বিৃতিতে আরও বলা হয়, নিহত ও আহতের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ ভবনের ধ্বংসস্তুপের তলায় অনেকে চাপা পড়েছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও জনবলের অভাবে তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্লেষকদের মতে, গাজার হতাহতের মূল চিত্র পাওয়া যাবে যুদ্ধ শেষ হলে।
আমাদের সকলের জানা, প্রধান পরিচালক হিসেবে জাতীয় কবি নজরুলের ‘লাঙল’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ২৫ ডিসেম্বর ১৯২৫। শ্রমিক–প্রজা–স্বরাজ পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্ররূপে পত্রিকার ১ম সংখ্যার শুরুতেই ছিল কবি চন্ডীদাসের অমর বাণী– ‘কুনহ মানুষ ভাই– সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ উল্লেখ্য পত্রিকার প্রত্যেক সংখ্যার শুরুতেই উক্ত বাণীটি লিপিবদ্ধ থাকত। পত্রিকাটির প্রধান লেখক–পরিচালক ছিলেন কবি নজরুল। তাঁর লেখার জনপ্রিয়তার জন্য পত্রিকার কোনো কোনো সংখ্যা একদিনের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যাওয়ায় আবার ছাপাতে হতো। মূলতঃ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সাম্যবাদী’ কবিতাতেই তাঁর কবিমানসের অসাধারণ বিশ্বজনীন স্বরূপ উম্মোচিত হয়। তিনি লিখেছিলেন, ‘গাহি সাম্যের গান– যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান। যেখানে মিশেছে হিন্দু–বৌদ্ধ–মুসলিম– খ্রিস্টান।’ স্মরণযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এই লাঙল পত্রিকার ত্রয়োদশ সংখ্যায় বিশ্বকবি রবীঠাকুরের ‘আশীর্বাণী’তে উপস্থাপিত হয়– ‘হাল ধর বলরাম, আন তব সরু–ভাঙা হল: বল দাও, ফল দাও, স্তব্ধ হোক ব্যর্থ কোলাহল।’ একই ধরনের উচ্চারণে রবীঠাকুর ‘সভ্যতার সংকটে’ মানুষকে সচেতন করার প্রয়াস চালিয়েছেন। সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, মানুষ আর মানুষের পর্যায়ে রয়েছে কিনা তা ভাববার বিষয়। মহান স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ তার মানবতা–মনুষত্বহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে যাচ্ছে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ–সংশয়ের উদ্রেক করছে।
দেশীয় প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় প্রতীয়মান যে, সীমাহীন দুর্নীতি–অপকর্ম–স্বৈরাচারী পন্থায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা নস্যাৎ করার লক্ষেই সংঘটিত হয় ছাত্র–জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান। ৫ আগস্ট ২০২৪ বিগত সরকারের পতন ঘটিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। দেশপ্রেমিক–মেধাবী তরুণদের ওপরেই নির্ভর করছে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ। মহান স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায় থেকে অদ্যাবধি অনেক দল–সরকার ও পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, রাষ্ট্র শাসনে দলসমূহ যথার্থ অর্থে আদর্শিক ঐতিহ্য তৈরি করতে পারেনি। জাতীয় আদর্শের প্রকৃত ভিত রচনাতেও কতটুকু সার্থক ছিল তা পর্যালোচনার দাবী রাখে। গণতান্ত্রিক–অসাম্প্রদায়িক–মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। বহিঃ ও অন্তঃ ঔপনিবেশিক শাসন–শোষণের যাঁতাকলে কঠিন নিষ্পেষিত ছিল এতদ অঞ্চলের মানুষ ও মানুষের জীবনপ্রবাহ। আর্থ–সামাজিক উন্নয়নের প্রচণ্ড অবহেলার শিকারে নিপতিত ছিল এই পূর্বাঞ্চল। দেশ বিভাগের পর থেকেই বিশেষ করে ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রজ্বলিত হয় বাঙালির স্বজাত্যবোধের মহিমান্বিত স্ফুলিঙ্গ।
স্বাধীকারের দীর্ঘ দীর্ঘ সংগ্রাম বাঙালিকে স্বাধীন সত্তার জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত করে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বিপুল প্রাণ বিসর্জন ও অজস্র জননী–জায়া–কন্যার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন মাতৃভূমি। প্রায় এক কোটি মানুষের শরণার্থীর জীবনযাপনের অবর্ণনীয় দুঃখ–দুর্দশা কখনো ভুলবার নয়। প্রতি মুহূর্তে হায়েনাদের আক্রমণ ও প্রাণহানির আর্তনাদ নিয়ে দেশে থাকা মানুষের আহাজারিতে দেশের বাতাস ছিল অসম্ভব ভারি। এত বিসর্জনের পরেও অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার প্রচেষ্টা কেন ব্যর্থতার কালোমেঘে ঢাকা পড়ল তারও বিচার–বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এটি সর্বজনবিদিত যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এর ভাঙ্গনের মূলে যে কারণগুলো বিদ্যমান ছিল তা হচ্ছে প্রধানত গণতন্ত্র বিবর্জিত কেন্দ্রীয় একদেশদর্শী শাসন ব্যবস্থা ও পূর্ব বাংলার প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ, এর ভাষার প্রতি অগণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং সর্বোপরি শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশকে রুদ্ধ করার অপচেষ্টা।
মূলতঃ ১৯৪৭ সালের প্রারম্ভে এই পূর্ব বাংলা ছিল একটি কৃষিভিত্তিক সমৃদ্ধ গ্রামীণ অর্থনীতি নির্ভর। কলকাতা কেন্দ্রিক শিল্প কারখানার জন্য পূর্ব বাংলা ছিল কাঁচামাল সরবরাহকারী ও উৎপাদিত দ্রব্যের বাজার মাত্র। ঢাকা ছিল একমাত্র শহর এবং এ অঞ্চলে জমিদারেরা ছিল প্রধানত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারা পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরে অধিকাংশই ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তরিত হন। অনেকের মতে, পূ্র্ববাংলায় জমিদার প্রথা তুলে দেওয়া সহজ হয়েছিল এই স্থানান্তরের কারণে। সামন্তপ্রথার বিলুপ্তির প্রভাবে সম্ভব হয়ে উঠেছিল এ অঞ্চলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বিকাশ। গণতন্ত্র–প্রগতিশীল ও অসাম্পদ্রায়িক মুক্ত চিন্তা–চেতনার ধারায় বিকশিত এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সক্রিয় কর্মকাণ্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবধারা প্রতিষ্ঠায় নতুন শক্তি সঞ্চার করে। পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থ–সামাজিক অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল বিধায় সেখানে সামন্ততান্ত্রিক পৃষ্ঠপোষকতা বেপরোয়া সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের উত্থানে বিশাল ভূমিকা পালন করে।
উল্লেখিত প্রচণ্ড বৈষম্যের প্রতিকূলে নানা ঘাত–প্রতিঘাতে বাঙালির সচেতনতা–প্রতিবাদী রূপ পরিগ্রহ করে। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের শক্তি পুঞ্জিভূত হয়। ক্ষোভের মাত্রা অপরিমেয় পর্যায়ে পৌছে গেলে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বাঙালির চেতনাবোধ নবতর অধ্যায় রচনা করে। সার্বিক ফলশ্রুতিতে সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সকল প্রকার বিরোধ–বিচ্ছেদ–দমন–পীড়ন–নিপীড়ন–নির্যাতন সংহার করে প্রতিহিংসা–প্রতিশোধহীন নিরাপদ দেশমাতৃকাই নতুন বছরের অত্যুজ্জ্বল প্রত্যাশা। মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা এবং জুলাই ২৪ এর বিপ্লবের অনুপম অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই গণতান্ত্রিক–অসাম্প্রদায়িক–বৈষম্যহীন মানবিক সমাজের নতুন করে গোড়াপত্তনে প্রিয় মাতৃভূমি হোক অগ্রগণ্য। সৌহার্দ–সম্প্রীতি–পরমতসহিষ্ণুতার উজ্জ্বল উপমায় উদ্ভাসিত থাকুক আবহমান বাংলার ঐতিহ্য–সংস্কৃতি ও বাঙালির সাবলিল জীবনধারা।
লেখক
শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী