উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে জাতীয়তা- মানবতাবাদ – সাম্যের যে জয়গান শোনা গেছে তাতে তিনজনের কণ্ঠস্বর বারবার মানুষের কানে বেজেছে। এই তিনজন হলেন মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ভাষায় ‘জৈষ্ঠ্যের ঝড়’। জন্ম উনবিংশ শতাব্দীতে। তবে ঋদ্ধি বৃদ্ধি বিংশ শতাব্দীতে। ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা অ্যালবার্ট হলে যখন নজরুলকে জাতীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয় -তখন তিনি বলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরি অভিযান -সেনাদলের তূর্য বাদকের একজন আমি–এই হোক আমার সবচেয়ে বড়ো পরিচয়।’
একুশ শতকে জ্ঞান বিজ্ঞানের বদৌলতে কল্পনাতীত সাফল্য এলেও পুরো বিশ্বে লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। বাক স্বাধীনতা বন্দি প্রহসনের গণতন্ত্র, সামপ্রদায়িক বিষের ছোবল এবং ফিলিস্তিনের মানুষের উপর ইসরায়েল কর্তৃক হত্যাযজ্ঞে পুরো উন্নত বিশ্বের নির্লিপ্ততা এবং বর্ণবাদের এ অবক্ষয়ের সময়ে অনুভবে নজরুল যাঁর কাছ থেকে মানবাধিকারের পাঠ পেয়েছি আমরা যিনি শোনালেন অবহেলিত কৃষক, মুটে মজুর জেলেদের কথা-চোর ডাকাত ও পতিতা-বারাঙ্গনার প্রতি শ্রদ্ধা আর জোরালো ভাবে বললেন নারী স্বাধীনতার কথা।
তাঁর স্বাধীনতা চেতনা জাতীয়তাবোধ, মানবতার অহংকার স্পষ্টদৃপ্ত উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদী। তাঁর কবিতা ও গানের ছন্দ ও সুরের আঘাতে সারা দেশ ও সমাজ যেমন জেগে উঠলো তেমনি শংকিত হলো বিদেশি শাসকগোষ্ঠী। বাজেয়াপ্ত হলো তাঁর বই ও পত্রিকা। কারাদণ্ড হলো তাঁর। স্বাধীনতা ও সাম্যের এবং বিদ্রোহ চেতনার প্রভাব জনমন হলো প্রত্যক্ষ।
নজরুলের পূর্বসূরীরা বলেছেন –জাগো দেশ, জাগো জাতি। নজরুল বললেন –জাগো নিপীড়িত, জাগো কৃষক, জাগো শ্রমিক, জাগো নারী। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট –এবং এখানেই তিনি যুগোত্তর। উৎপীড়িত অবহেলিত শোষিত মানুষের বিদ্রোহী চেতনার জ্বালা নজরুল চেতনায় দেদীপ্যমান। এই বৈপ্লবিক সমাজ চেতনা বাংলা সাহিত্যে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান।
এই চেতনায় সময়কে অতিক্রম করে একই সাথে ভারতীয় ও ইসলামি ঐতিহ্যকে গ্রহণ করলেন। হিন্দু মুসলিম ঐক্যের জন্য পবিত্র ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা মহররমের সাথে হিন্দু সমাজের দুর্গাপূজা সরস্বতী পূজা কালীপূজা বিষয়েও কবিতা ও গান রচনা করলেন। সব ধর্মের সব সমপ্রদায়ের ঐতিহ্যকে কবিতার রূপক উপমায় ব্যবহার করে তাঁর ভাবনা চিন্তাকে সর্বজনীন করে তুলেছেন -তথা উপমহাদেশের রাজনৈতিক চেতনার সবচেয়ে দুর্বলতা যে সামপ্রদায়িকতা তা অতিক্রম করেছেন।
তিনি তাঁর কল্পনায় এই পৃথিবীকে সাম্যবাদী তথা মানুষের বাসস্থান হিসেবে কল্পনায় রেখে শুধু লেখনীতে নয় প্রত্যক্ষ ভাবে সাম্যবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন দেশের প্রথম সাম্যবাদী পত্রিকা লাঙল –কৃষক মজুরের মুখপত্র।শুধু ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি না-ধুমকেতু পত্রিকায় ঘোষণা করেছিলেন —‘বলো কারুর অধীনতা মানিনা–স্বদেশীর ও না বিদেশীর ও না।’
ফরাসি তাৎপর্য উপলব্ধি করে তিনি লিখলেন–কৃষাণের গান, শ্রমিকের গান, কুলি মজুর, রাজা-প্রজা নারী-ফরিয়াদ প্রভৃতি কবিতা এবং একই দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস।
স্তালিনের ভাষায়–নারীদের অংশগ্রহণ ব্যতীত মানবজাতির ইতিহাসে নিপীড়ত জনগণের কোন রকমের আন্দোলন সফল হয়নি আর এর প্রতিধ্বনি নজরুলের কবিতায়–‘কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি -প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয়ী লক্ষী নারী’।
নজরুল দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য মানবপ্রেম যে কারণে রোমান্টিক মানস প্রবণতা ও স্বপ্ন -সৌন্দর্যের রূপকার হলেও তাঁর অসংখ্য কবিতা গান ও অন্যান্য রচনায় দেশের মানুষের সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, স্বপ্ন -সাধনা,আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রামী প্রেরণা এবং শোষণ বঞ্চনা অত্যাচার নিপীড়ন, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, সামপ্রদায়িকতা,সংকীর্ণতা তথা সবধরনের মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সাহিত্যকে সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে পুরো বিশ্বের মানুষের সপক্ষে সহযাত্রী হয়েছেন।
রাজতন্ত্রের যুগে শ্রেণী বৈষম্য মুক্ত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাকে কবি শেলী বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেছিলেন ওড টু লিবার্টি কবিতায়।
নজরুল তাঁর ভাঙার গানে আরও তীক্ষ্ণ ভাষায় –কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট/ রক্ত জমাট বা শেষের দিকে – লাথি মার, ভাঙরে তালা / যতসব বন্দীশালায় আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।
কবিতার বাণীকে বুলেটের মতো ব্যবহারের দৃষ্টান্ত বিরল।
‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- চণ্ডীদাসের এই সত্যোপলব্ধি কবির মাঝে গভীর ছিল। এর সাথে নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা, বিপ্লবী দলের সাথে যোগাযোগ, প্রথম মহাযুদ্ধে যোগদান সবকিছু মিলিয়ে তিনি মানবতাবাদের গৌরবগাথায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম -বাংলাভাষার এক সার্বভৌম কবি, মানুষের কবি, পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার উচ্চারণকারী এক বিদ্রোহী কবি, হিন্দু মুসলমানের মিলনের কবি, বাংলা ও বাঙালির সম্মিলিত সংস্কৃতির এক ঐকতানের কবি। নিপীড়িত মানুষের জন্য যে বেদনাবোধ, অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতি যে বিদ্রোহ সবই তাঁকে মানুষের অতি কাছাকাছি এনে দিয়েছিল। কবির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বলি–তিনি বাংলা ও বাঙালির কবি কালোত্তীর্ণ চির যৌবনের কবি এবং অসামপ্রদায়িক চেতনায় মানবতার কবি।তাঁর উচ্চারণে-‘আমি এই বিদ্বেষ জর্জরিত কুৎসিত সামপ্রদায়িকতা ভেদ জ্ঞান কলুষিত অসুন্দর অসুর নিপীড়িত পৃথিবীকে সুন্দর করে যাব।’ তবে তাই হোক তবে তাই হোক। মানবিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হোক পুরো বিশ্ব।