কবি নজরুল : অপূর্ণ এক জীবনতরঙ্গ

কমলেশ দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ২৮ মে, ২০২১ at ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ

কবি নজরুল ইসলামের একান্ত সঙ্গীত সহচর নিতাই ঘটক তাঁর একটি প্রবন্ধে বলছেন “আকাশে আমরা অসংখ্য তারকার মালা বিরাজমান দেখি। সেই তারকার মধ্যে এমন কিছু তারকা দেখতে পাই, যার উজ্জ্বল আলো আমাদেরকে মুগ্ধ করে। আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি।”
সঙ্গীত সাধক নিতাই ঘটক কবি নজরুলকে তারকার সাথে তুলনা করেছেন। এইসব নভোজগতে রহস্যময় আলো বা উজ্জ্বলতার উৎসমুখের অকস্মাৎ বা মর্মান্তিক নিভে যাওয়া ইতিহাসও আছে প্রচুর। তিনি আরো বলেছেন ‘শিল্পী জীবনের সবে শুরুতেই তিনি ঝরার মতো ঝরে গেলেন।’ আসলে এই মর্মবেদনা তাঁর একান্ত সঙ্গী, বন্ধু-বান্ধব এবং তৎকালীন সময়ের সব প্রগতিবাদী ও আধুনিক বাঙালি কবিরা সুদীর্ঘ সময় ধরে অনুভব করেছেন। কারণ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দেই কবি নজরুলের কাব্যজীবন ও সঙ্গীত জীবন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল; ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ অবধি সে ছিল প্রাণস্পন্দন। কবিতা, গান, পত্রিকা, সম্পাদনা, রাজনীতি। ‘সবকিছু নিয়ে যিনি বৃহত্তর বঙ্গে সদর্পে সম্পূর্ণ আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের পরেই যাঁর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে!
লিখেছেন আগুনমুখো সেইসব কবিতা, গান! ‘বিদ্রোহী’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট … কর রে লোপাট’, ‘জাতের নামে বহুজাতি সব, জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া’, প্রকাশ করছেন যৌথ সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ পত্রিকা। এমনকি সেই সময়কার ব্রিটিশবিরোধী সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মকাণ্ডেও তাঁর অংশগ্রহণ ছিল একে বারে পুরোভাগে। তিনি নাট্যকার মম্মথ রায়ের ‘কারাগার’ নাটকের জন্য লিখেছেন কী সব স্মরণীয় গান! ‘তিমির বিদায়ী অলস বিহা কৃষ্ণমুরারী আগত ঐ’ ‘জাগো জাগো শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী’। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অন্যতম ক্রীড়ণক কৃষ্ণকে আহ্বান জানাচ্ছেন পুনরায় আগমনের। ইংরেজরা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতাপান্বিত কৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বলছেন।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত (১ম বর্ষ ১৩শ সংখ্যা শুক্র বার ২৬ আশ্বিন ১৩৯২)। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখেছেন ‘পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে।… আর বিদ্রোহ করতে হলে সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারো কুর্ণিশ।’
সাহিত্যিক অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত তাঁর ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে বলেছেন ‘সপ্তাহান্তে বিকেলবেলা আরো অনেকের সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, হকার কতক্ষণে ‘ধূমকেতু’র বান্ডিল নিয়ে আসে। হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কাগজের জন্য। কালির বদলে রক্ত ডুবিয়ে লেখা সেইসব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ। …’
সুনামির মতোই সর্বদিকব্যাপী এক বিস্তার নিয়ে কবি নজরুলের আবির্ভাব হয়েছিল। যেখানেই গেছেন… সেখানেই বহুবর্ণের, বহুভাবের। বহু বিচিত্র রসবোধের উৎসমুখ হয়েছেন। স্বদেশ, মানুষ ও মানবিক বোধ থেকে সাহিত্যবোধ এমনকি দৈনন্দিন সাধারণ রসবোধেরও তিনি একজন সার্থক শিল্পী ছিলেন।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা ৩২, কলেজস্ট্রীটের বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে নজরুলের সশব্দ উপস্থিতি ও আলোড়ন অভূতপূর্ব সমস্ত আড্ডার রসদ, চলাফেরা সবাইকে আকর্ষিত করেছিল। এই সময় তাঁর সাথী ছিলেন স্কুলের সহপাঠী, বন্ধু সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়।
তাঁর অবিরল ধারায় উচ্চৈঃস্বরে হাসি, কথাবার্তা, কবিতা রচনার অজানা উদ্দাম স্রোত তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলো একদম সাধারণ মানুষ, মজুর কৃষকের ভেতরেও। তরুণ কবি নজরুল ইসলাম আকস্মিক আনন্দ, বেদনা, দ্রোহ বিদ্রোহের উপহারে সংবর্ধিত হলেন চূড়ান্তরূপে।
বিশের দশকেই কবি নজরুল খুব চমৎকারভাবে রবীন্দ্র কবিতার একজন অন্যতম ভক্ত এবং আশ্চর্যজনকভাবে একজন রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত কবি। এই সময়ের একটু পেছনে গেলে অর্থাৎ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে করাচিতে থাকাকালীন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেছেন ‘মুক্তি’ কবিতাটি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। উত্তর কলকাতার বাস বাজারে বন্ধু শৈলজারঞ্জনের মেসে ওঠেন। সেখানে হিন্দু মেস পাচকের আপত্তি থাকায় তিনি চলে আসেন কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির কার্যালয়ের পাশে মুজফ্‌্‌ফর আহমদের বাড়িতে। ওই বাড়ি থেকে কবি নজরুল ও মুজফ্‌্‌ফর আহমদ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যৌথভাবে প্রকাশ করেছিলেন ‘নবযুগ’ পত্রিকা।
তারপর তো বেরলো এক এক করে ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’ ও ‘গণবা’ এই সময়ের মধ্যেই কবি নজরুল ও মুজফ্‌্‌ফর আহমদ একে অপরের সহযোগী হিসেবে ছিলেন।
অবিভক্ত বঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনেও কবি নজরুল অন্যতম একজন উদ্যোক্তা। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না তবুও ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’র প্রথম ইস্তাহারটি প্রচারিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী কবিতার জনক নজরুল ইসলামের নামে। সচেতন পাঠক তাঁর জীবন ও সাহিত্যকে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন লেটোর দল, রুটির দোকানে চাকুরি মসজিদের খাদেম, ৪৯, বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে করাচী গমন, ফিরে এসে যুদ্ধ শিবিরে লাল ফৌজ দেখে প্রভাবিত হয়ে কম. মুজফ্‌্‌ফর আহমদের সমন্বয়ে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগসহ আরো কতদিকে যাতায়াত।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরের শেষ দিকে তিনি লিখেছেন তাঁর সেই অবিস্মরণীয় কবিতা ‘বিদ্রোহী’। এই কবিতাটি নিয়ে কম. মুজফ্‌্‌ফর আহমদ লিখেছেন যে ‘তখন নজরুল ও আমি নিচের তলা পূর্ব দিকের অর্থাৎ বাড়ির নিচেকার দক্ষিণ পূর্বকোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেছিলো রাত্রিতে… নজরুল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমাকেই প্রথম পড়ে শোনালো।’ কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ৬ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ‘বিজলী’ পত্রিকায় কবি নজরুল প্রায় একই সময়ে লিখছেন, গাইছেন সেইসব অবিস্মরণীয় স্বদেশী গান যা তৎকালীন সময়ের পরাধীন অবিভক্ত বঙ্গের স্বরাজ আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলনে বা এক কথায় বলতে গেলে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের মূলধারাকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি স্বকণ্ঠে গেয়েছিলেন ‘বল নাহি ভয়, নাহি ভয়’, ‘ভাই হয়ে ভাই চিনবি আবার’, ‘আমি রক্ত নিশি ভোরে’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু…’, সহ আরো অনেক গান।
অন্যরকমের এক স্বাতন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যে ও মহিমায় নজরুল হয়ে উঠেছিলেন সমুজ্জ্বল। স্বদেশী গানের সাথেই চলেছে গজল, ঠুংরী, বাউল ও ভাটিয়ালী। প্রচুর পারসী ও আরবি শব্দের প্রবেশও তিনি করালেন বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে। যেমন মোবারক, গোলার, খঞ্জর, মুসাফির, রওশন, খুন, বাগিচা প্রভৃতি। এই নতুন শব্দের প্রয়োগে বাংলা কবিতাও নতুন ব্যঞ্জনায়, ছন্দে ও অলংকারে হলো সজ্জিত। প্রায় সমসময়েই কবি নজরুল ড. শহীদুল্লাহকে সাথে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করতে। সুধাকান্ত রায় চৌধুরী কবিকে স্টেশন থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্ব ভারতী শান্তিনিকেতনের অতিথি ভবনে। সেদিন কবি নজরুল অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। কবিগুরুর সঙ্গে কাটিয়েছিলেন দীর্ঘ সময়।
এরই কিছুদিন পর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি। দীর্ঘ ৭৮ লাইনের কবিতাটি ব্রিটিশ শাসক ১৬ জানুয়ারি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে বাজেয়াপ্ত করে। কবি নজরুল একবছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করলেন। উৎসর্গের পৃষ্ঠায় লেখা ছিল ‘শ্রীমান কবি নজরুল স্নেহভাজনেষু।’
কাব্য সাহিত্য এবং সঙ্গীত রচনা ও সুর সৃজনের অভূতপূর্ব এক যুগপৎ সোপান নির্মাণে বোহেমিয়ান নজরুলের ভূমিকা সবাইকে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল। কিন্তু নজরুল গবেষক ড. হারাধন দত্ত বলেছেন সে ‘আসলে ভবঘুরে চঞ্চল সুদূরের পিয়াসী সদ্যমুক্ত পাখির মতো যাঁর চালচলন তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে বেঁধে রেখে সঠিকভাবে বুঝবার সুযোগ খুব কম লোকেরই ভাগ্যে জুটেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বয়সে নজরুল যাঁর কাছে যেভাবে প্রতিভাত হয়েছেন তিনি সেইভাবে নজরুলকে প্রকাশ করেছেন। পরিপূর্ণভাবে নজরুলকে দেখার সৌভাগ্য কারো হয়নি’। ড. হারাধন দত্তের উল্লিখিত মন্তব্যের সূত্র ধরে তা অনেকটা সঠিক বলেই মনে হয় যখন দেখি নজরুল অনুরক্ত বা সহযোগীদের বা বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের নজরুল সম্পর্কে বক্তব্যগুলো পাঠ করি।
উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতকার ও সঙ্গীত শাস্ত্রবিদ দিলীপ কুমার রায় কবি ও সঙ্গীতকার নজরুল বিষয়ে বলেছেন ‘কাজীর গান! সে একটা যুগ গেছে। মনে পড়ে- রামমোহন লাইব্রেরিতে সুভাষ ও দেশবন্ধুর পদার্পণ। তারপর কাজীর আবির্ভাব ও ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে গাওয়া:
‘এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবোরে বিকল’।
‘… দেশবন্ধু ও সুভাষের সুখ দীপ্ত হয়ে উঠলো এরপরে কাজীর মুখে বিদ্রোহী আবৃত্তি শুনেও:’
‘তখন আমাদের বুকের মধ্যে কিসের বান ডেকে যেত বলা ভার দুঃখ, খেদ না ভণ্ডামির প্রতি ক্রোধ, কুসংস্কারের অগৌরব? কেবল একটা কথা বলা যায় সে, আমরা সবাই অভিভূত হয়ে পড়তাম তার আশ্চর্য প্রকাশ-ভঙ্গিতে: এ ধরনের চরণ কি স্বভাব প্রতিভাধর ছাড়া আর কারও কলমে এমন স্বত্যোৎ বইতে পারে? কাজী বিদ্রোহী কবি বটে কিন্তু সেই সঙ্গে নির্ভেজাল কবি।’
অবিভক্ত বঙ্গের কিছু ব্যক্তির বাড়ি ও পরিবার কবি নজরুলকে দেখেছেন উদ্দাম হাস্যরসে পরিপূর্ণ একজন আমোদপ্রিয় কবি এইসব বাড়ির প্রায় সব সদস্যরাই কবি নজরুলের আকস্মিক স্ফূরণ, হাসি, গান এইসবের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতা প্রথম আশ্রয় ৩/৪ সি তালতলা লেনে কম. মুজফ্‌্‌ফর আহমদের বাড়ি, (যদিও এই আশ্রয়ে পারিবারিক আবহাওয়া ছিল না তবে অনেক ব্যক্তির উপস্থিতি ছিল প্রতিদিন) কুমিল্লা শহরের কান্দীরপাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়ি (এই বাড়ির কন্যা সন্তান প্রমীলা ওরফে দুলিকে তিনি বিয়ে করেন), বহরমপুরে ডা. নলিনাক্ষ সেনের বাড়ি, কলকাতার গোপী মোহন লেনে উমাপদ ভট্টাচার্যের বাড়ি, চট্টগ্রামের তামাকুমণ্ডি লেনে হাবিবুল্লাহ বাহারের বাড়ি, কলকাতার জেলেটোলায় নলিনীকান্ত সরকারের বাড়ি, ঢাকায় রমনা এলাকায় প্রতিভা বসুদের বাড়িতে (বরেণ্য সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী) তাঁর সরব ও সমুজ্জ্বল চেহারার উপস্থিতি ও কবিতা, গান রচনার সংবাদ পাওয়া যায়।
এমনকি কবি নজরুল যখন ফন্দিবাজ আলি আকবরের খপ্পরে পড়ে জনৈকা সৈয়দা খানের (নজরুলের দেয়া নাম নার্গিস) সঙ্গে প্রেমের ঘোরে বিবাহের পর্ব পর্যন্ত পৌঁছে যান তখনও তিনি দৌলতপুরে আলি আকবর খানের সেই বাড়িতে বসে লিখেছেন অনেক কবিতা ও গান। এসব আশ্রয়, বাড়ি ও ঘটনা, বন্ধুত্ব, প্রেম এবং আরো নানা অনুষ্ঠানের তথ্য ও খবরা খবর নিয়ে একটি বিশেষ গ্রন্থ প্রকাশ করা খুবই প্রয়োজন। কারণ অনেক সুযোগ সন্ধানী বাণিজ্যমনস্ক প্রকাশক এবং আত্মপ্রচার সর্বস্ব অসাহিত্যিক, লেখককুল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যুগন্ধর ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মিথ্যাচার ও বানানো গল্প ফেঁদে পাঠকদের বিকৃত মানসিকতা তৈরির রসদ যোগাচ্ছেন। পুঁজিবাদী সমাজে সাহিত্যচর্চায় এও এক দূষণের স্বাভাবিক লক্ষণ বৈ কি! যে সমাজকে নজরুল জীবনভর ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন সেই পুঁজিবাদী সমাজের বিকৃত রসনার উপাদান হয়ে গেল তাঁর এই দ্রোহ, বিদ্রোহে পরিপূর্ণ ও স্পষ্টভাবে প্রকাশিত জীবনপঞ্জী। সরল কবি নজরুল তাঁর বাইশ বছরের এক অভিনব এবং চূড়ান্ত অস্থির ও অস্থিতিশীল সৃজনমুখর জীবন অতিবাহিত করেছেন। এক সময় ব্যক্তিগত জীবনে পাহাড়সম অবরুদ্ধতার ভেতরে আর্থিক সংকট, সমস্যা এমনকি পুত্র শোকও তাঁকে অস্থির ও অতি আবেগাকুল অবস্থা থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।
কবি নজরুল ইসলামের এই বোহেমিয়ান চরিত্রের লক্ষণগুলি তাঁকে যেমন সৃজনের শক্তি ও অত্যুজ্জ্বল শব্দসম্ভার দান করেছে তেমন দিয়েছে এক অদ্ভুত দীর্ঘ নীরবতার জীবনও। অকস্মাৎ যেন এক মহাউৎসবের দীপ নিভে গেল!
আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির আধুনিক পর্বের ইতিহাসে কিম্বা জাতীয় জাগরণের ইতিহাসে এইরকম সাড়া জাগানো অভিন্ন ও ব্যতিক্রমী সমুদ্রসম্ভূত জলস্তম্ভের নাম… কবি নজরুল ইসলাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনজরুল চেতনায় মানবতা
পরবর্তী নিবন্ধসরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ইতহাস বিকৃত করছে