নগর যন্ত্রণা : পায়ের নিচে ভিসুভিয়াস

মোস্তফা কামাল পাশা | শুক্রবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে সড়কের নিচে অসংখ্য হাবিয়া দোযখ! একটি আবিস্কার হলো কিছদিন আগে! সেখানে দোযখের সব ভয়াল উপাদান কিলবিল করছে মানুষ গিলার অপেক্ষায় ! ইসলামি ‘ভার্সিটির ট্রিপল ই বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী সাদিয়া আগ্রাবাদ জেকস মার্কেটের সামনে ড্রেনে পরে নিখোঁজ না হলে এমন দোযখ অজানাই থাকত। কখনো আবিষ্কার হতো না। আমরাতো ভুলেই গেছি! স্বাভাবিক নতুন ইভেন্ট পুরনোকে চাপা দিয়ে দেয়। কিন্তু ঘটনার জের মুছে ফেলাতো অসম্ভব।
মাস দেড়েক আগে মুরাদপুর মোড়ে ব্যবসায়ী ছালেহ আহমদের মত সাদিয়া স্রোতের টানে ড্রেনের পেটে হজম হয়ে গেলেতো ‘কম্মোকাবার’! রাস্তার ৭০ ফুট নিচের লুক্কায়িত দোযখের কথা কেউ জানতেই পারত না। সৃষ্টিকর্তার কী কুদরত! একটি সুস্থ, নবীন, তরতাজা প্রাণ গিলে নিয়ে দোযখ জানান দিল, সে আছে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে; মাটির ৭০ ফুট নিচে। দু’টন জঞ্জাল সাফ করে দমকল ও চসিকের দুটো ক্রেন দোযখের গহবর থেকে লাশটি তুলে আনে। সাদিয়ার লাশ উদ্ধার না হলে কী হতো বলা যায় না। মাটির ৭০ ফুট নিচে লুকিয়ে ফেলা আস্ত ড্রেন যে আছে, অন্তত এটা আবিস্কার হতো না, এত সহজে। কী অস্থির উন্নয়ন চট্টগ্রাম তথা দেশের!
যদ্দুর জানা গেছে, ক’যুগ আগে এরশাদ বা বেগম জিয়ার পছন্দের মনোনীত মেয়রদের মেয়াদে নগরীর প্রধান সড়ক শেখ মুজিব রোড উন্নয়নের সময় মূল নালাটি কবর দিয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার নতুন নালা তৈরি করে। এরপর বন্যার পানি থেকে বাঁচাতে দফায় দফায় সড়ক উন্নয়ন হয়। এভাবে কর্ণফুলী নদী সংযুক্ত কবর চাপা ব্ল্যাকহোলটির (আদি নালাটি) অবস্থান সড়ক লেভেলের ৭০ ফুট গভীরে চলে যায়। টনকে টন জঞ্জাল জমে ওটার রূপান্তর ঘটে হাবিয়া দোযখে। দোযখের বর্ণিত বিষাক্ত কীট ও সাপখোপের নিরাপদ আবাস হয়ে যায় নালাটি। সাদিয়া পা পিছলে পড়ে যাওয়ার পর সঙ্গে থাকা তার মামা বা নানা ঝাপ দিয়েও ভাগ্যাহত মেয়েটিকে বাঁচাতে পারেননি। স্রোতের তীব্র টান কেড়ে নিয়ে পাচার করে দেয়, কবর দেয়া নালার জঞ্জালের গভীরে। আহা, তলিয়ে যাওয়ার সময় কী অসহ্য কষ্ট ও যন্ত্রণা সইতে হয়েছে মেয়েটিকে। নিশ্চয়ই বেঁচে থাকতে-সামান্য অঙিজেন শুষে নিতে প্রাণপাত লড়েছে সাদিয়ার ফুসফুস। ডাঙ্গায় উঠা কাতলার মত খাবি খেয়েছে বহুক্ষণ! শব্দের আঁচড়ে মর্মান্তিক এই মরণ যন্ত্রণা আঁকা কী সম্ভব! কন্যাহারা পিতা-মাতাকে জীবনভর ভয়াল মৃত্যু বিভীষিকা তাড়া করে বেড়াবে। কদিন মিডিয়া কাঁপানোর পর আমরাতো ভুলে গেছি দ্রুতই। কারণ সাদিয়া বা ছালেহ আহমদ, এঁরাতো আমাদের কেউ না। তবুও কেন এত অস্থির লাগে! এক নগরের নাগরিক আমরা। ছালেহ আহমদ ভাই বা সাদিয়াতো আমারও মেয়ে হতে পারতো! বাস্তবে যদি তাই হতো, এমন ভয়ঙ্কর মৃত্যু আমরা কীভাবে সামলাতাম। ভাবতে গেলেই থেমে যায়, রক্ত প্রবাহ!
লক্ষ-কোটি টাকার উন্নয়ন হচ্ছে, চট্টগ্রামে। কিন্তু করছে কারা! এরা কী এত বিশাল উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ সামাল দেয়ার দূরদর্শীতা, যোগ্যতা, দক্ষতা রাখেন? আছে কী কোন মানবিক ব্রত? কর্পোরেট সংস্কৃতিতে দূরাশা মাত্র। কিন্তু কর্পোরেট সংস্কৃতিতে যোগ্যতমই উপরে উঠেন কেবল। অযোগ্য ঝরে যায়। এদেশে কেবল বেসরকারি ও বহুজাতিক সেক্টরের জন্য, সরকারি, আধা সরকারিতে নয়। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার অভাবসহ, অতিকায় প্রশাসনিক কাঠামোতে প্রচুর ফাঁকফোকর থাকায় যোগ্যতা, দক্ষতা বিকাশিত করার দায় দায়িত্বশীল কর্তাদের বড় অংশের নেই। স্বাভাবিক কারণে লেগে যাচ্ছে, উন্নয়ন জট। যেনতেনভাবে বড় বড় স্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। থাকছে অসম্ভব গলদ। চসিক, সিডিএ’র পারস্পরিক দোষারোপ, সমন্বয়হীনতা পরিস্থিতি আরো জটিল করছে। সাদিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যু ও উদ্ধারের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, সড়কের নিচে আরও কত কবর দেয়া নালা, নর্দমা আছে তা খুঁজে বের করা। এগুলো কতো গভীরে এবং কত আবর্জনার স্তূপ ধারণ করে আছে, তা নিশ্চিত হওয়া খুবই জরুরি। শুধু ম্যানহোলের ঢাকনা বা ফুটপাত লাগোয়া খোলা নর্দমা কংক্রিটের ঘেরাও মানে ভয়াল ক্ষতের চিকিৎসায় সাময়িক মলম ঘষা, আসল চিকিৎসা নয়। আসল চিকিৎসা হবে, নগরীর ভূ-অভ্যন্তরে বুজিয়ে ফেলা আরও কত নর্দমা আছে দ্রুত তা বের করা। সাদিয়ার লাশ উদ্ধারে আবিস্কৃত নালাটি অনেক দীর্ঘ। কর্ণফুলীর সাথে যুক্ত মুখটি খোলা না বন্ধ তাও অজ্ঞাত। খোলা হলেতো টনকে টন পচা জঞ্জাল পাওয়ার কথা না। বন্ধ হলে এটা একটা অরক্ষিত গ্যাসক্ষেত্র। আরো থাকলে ওগুলোয় কত পচা জঞ্জাল আটকে আছে, ধারণা করা কী সম্ভব! এ’ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বা দেশে কী কোন বিশেষজ্ঞ নেই! থাকলে তারা চুপ কেন? পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোই বা কই? চাপাপড়া নর্দমাগুলো আয়তনে বা দৈর্ঘে সন্ধান পাওয়াটির মত বা কাছাকাছি হলেও আমরাতো দোযখের উপর বাস করছি, সাথে ভয়ঙ্কর গ্যাসক্ষেত্রও। মাটির ৭০ ফুট বা আরো গভীরের নর্দমায় জঞ্জাল পচে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হবেই। এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। জমা গ্যাসের উর্ধ্বচাপে ঘটতে পারে বিস্ফোরণ। যা আগ্নেয়গিরির লাভাপাতের মত ভয়ঙ্কর হবেই। আশা করি চসিক, সিডিএসহ চলমান উন্নয়ন প্রকল্প, মহাপ্রকল্পে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেবেন। পাশাপাশি নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে সিটি মেয়রের উপযুক্ত ক্ষমতায়নের ফাইল আটকে থাকায় সমস্যার গিট আরও জটিল হচ্ছে।
দেশের রাজস্ব আয়ের মূলকেন্দ্র এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরীর মেয়র পদ একটি প্রতিষ্ঠান। বিষয়টার সাথে ব্যক্তি নয়, নগরীর ৭০ লাখ মানুষের মর্যাদা জড়িয়ে আছে। এটা ঝুলে থাকায় উন্নয়ন সমন্বয়ের নেতৃত্বও জট পাকিয়ে গেছে। সিডিএসহ অন্য সংস্থার প্রধানরাও নিজেদের সমমর্যাদাবান ভাবছেন। এতে উন্নয়ন কাজ সমন্বয়ে তালগোলসহ পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতি মাথাচাড়া দিচ্ছে বারবার। চট্টগ্রাম বাঁচাতে এবং উন্নয়ন অভিযাত্রা মসৃণ রাখতে বিশ্বাস, সরকারের শীর্ষ মহল জটিলতাগুলো অপসারণ করবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে ১.৩৬ কোটি শেয়ার হাতবদল