নগর পরিচালনায় মহিউদ্দীন চৌধুরী মডেল

জসীম চৌধুরী সবুজ | মঙ্গলবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী দীর্ঘ ১৭ বছর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সময়ে চট্টগ্রাম দেশে-বিদেশে সুন্দর পরিচ্ছন্ন একটি নগরী হিসেবে পরিচিতি পায়। কর্পোরেশনকে তিনি একটি স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থে। সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে তিনি বসে থাকেন নি। আয় বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করে কর্পোরেশনের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করেছেন। কাজ পাগল একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর সব কাজ সবসময় সবমহলে প্রশংসা পেয়েছে তাও নয়।

কাজ করতে গিয়ে তিনি অনেক সময় বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। পরে সেই কাজ থেকে সরে এসেছেন। গোঁ ধরে বসে থাকেন নি। কাজ করতে গেলে ভুল-ত্রুটি হতে পারে। মহিউদ্দীন চৌধুরী যেহেতু একজন মানুষ তিনিও এর উর্ধ্বে ছিলেন না। তিনি এখন আমাদের মাঝে নেই। চলে গেছেন আলোচনা-সমালোচনা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু ‘চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়’ কথাটাই মহিউদ্দীন চৌধুরীর ক্ষেত্রে এখন প্রযোজ্য। তিনি আগের চেয়ে আরও উজ্জ্বল দেদীপ্যমান হয়ে আছেন চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ে। তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে চির জাগরুক হয়ে থাকবেন। আগামী দিনগুলোতে তাঁর মত একজন তেজস্বী নেতার অভাবটা সাধারণ মানুষ আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনকে নিজেদের আয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি ( একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী মেয়র হিসেবে মহিউদ্দীন চৌধুরীর কর্মকাণ্ডকে স্মরণ করে বলেছেন, তিনি মেয়র থাকাকালীন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে আর্থিক ঘাটতি ছিল না, তার আমলে কর্পোরেশন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিল। তিনি মেয়র পদে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে নিজস্ব অর্থে চট্টগ্রাম সিটির অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হতো। কিন্তু এখন কেন সেটি করা যাচ্ছে না। মহিউদ্দীন চৌধুরীর দেখানো পথেই চলতে হবে বর্তমান মেয়রকে। সেদিন একনেক বৈঠকে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নিজে উপস্থিত ছিলেন নগরীর ‘বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন (২য় সংশোধিত)’ প্রকল্পটি আলোচ্যসূচিতে ছিল বলে। একনেক ১৩৬২ কোটি টাকার প্রকল্পটি শতভাগ সরকারি অর্থে বাস্তবায়নের ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছে। সিটি মেয়র এক্ষেত্রে লবিংয়ে সফল হয়েছেন। প্রকল্প বাস্তবায়নে চসিক তহবিল থেকে ২৫ শতাংশ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাই পেয়েছেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দেশের সকল সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের ঢাকার দিকে থাকিয়ে না থেকে নিজেদের আয় বাড়িয়ে নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করার তাগিদ দেন।
এর আগেও প্রধানমন্ত্রী ঢাকার দুই মেয়রকে মহিউদ্দীন চৌধুরীর মডেল অনুসরনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার প্রেক্ষিতে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম এসে সরজমিন ধারনা নিয়ে যান কিভাবে মহিউদ্দীন চৌধুরী কর্পোরেশনকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করেছিলেন।

আশার সংবাদ হচ্ছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে চসিকে আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। ২৬ টি খাতে কর-উপকর, টোল এবং ফি আদায় করে আইনসম্মতভাবে আয় বাড়ানোর বিষয়ে বিভাগীয় কর্মকর্তাদের খসড়া তৈরির নির্দেশনা দিয়েছেন।
আজকের লেখাটা শুরু করেছি মহিউদ্দীন চৌধুরীকে দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী কেন বারবার তার কথা স্মরণ করছেন, কোনোরকম ট্যাক্স-ফি না বাড়িয়েও কিভাবে তিনি আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করে কর্পোরেশনকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করেছিলেন সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।

আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী দীর্ঘ ১৭ বছর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কর্পোরেশনকে তিনি একটি স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠানেই পরিনত শুধু করেন নি চট্টগ্রাম সিটি তখন সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন নগরীর মর্যাদাও লাভ করেছিল। তিনি টাকার জন্য যেমন ঢাকার মুখপানে চেয়ে থাকতেন না তেমনি জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্প আমলাতান্ত্রিক লালফিতার কবলে আটকা পড়ে গেলে অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই তিনি কাজ করে ফেলেছেন। এখানে জাকির হোসেন রোড সম্প্রসারণ এবং আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি)। নগরীর অলংকার মোড় থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত জাকির হোসেন রোডটি ছিল একটি সংকীর্ণ সড়ক। ঢাকার যানবাহনগুলোকে পোর্ট কানেকটিং রোড হয়ে বন্দর- আগ্রাবাদ ঘুরে চট্টগ্রাম নগরীতে প্রবেশ ও বের হতে হত। মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরী উদ্যোগ নিলেন জাকির হোসেন রোডটিকে চার লেনে উন্নীতকরণের। প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হল। একের পর এক নানারকম জিজ্ঞাসা আসে মন্ত্রণালয় থেকে। অনেক বিল্ডিং ভাঙ্গতে হবে, জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে। অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে এসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তায় প্রকল্প আর অনুমোদন হয় না। মহিউদ্দীন চৌধুরী কর্মকর্তাদের বললেন, অনুমোদনের ক্যাথা পোড়- কাজ শুরু গরি দ্য। দিন তারিখ ঠিক করে তিনি চলে গেলেন ওমরাহ করতে। ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন সরাইপাড়া ওয়ার্ডের বিএনপিদলীয় কমিশনার সামশুল আলমকে। পরদিনই বুলডেজার গিয়ে শুরু করল ভাংচুর। প্রথমেই ভাঙ্গা হল হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালের সীমানা দেওয়াল। এটির মালিকানায় তখন যুক্ত ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং উপমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। এটি ভাঙার পর রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ একাডেমির অংশ ভাঙা হল। অন্যরা যাদের জমি সম্প্রসারণের আওতায় পড়েছে তারা দেখে ভাবলেন, প্রভাবশালীরা রেহাই পাচ্ছে না। আমরা বিরোধীতা করে কী হবে। একদিক ভাঙছে অন্যদিকে ফোরলেনের কাজও চলছে। এভাবে দ্রুততম সময়ে দীর্ঘ সড়কটির সম্প্রসারণ কাজ শেষ করায় এটিই পরিনত হয় নগরীর অন্যতম প্রধান ব্যস্ততম সড়কে। আগ্রাবাদ এঙেস রোডটি করার পরিকল্পনা অনেক আগের। জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছিল দেড়-দুই দশক আগে। সেসব জমির সবই অবৈধ দখলে। মহিউদ্দীন চৌধুরী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সেখানে দ্রুততম সময়ে করে ফেললেন সড়কটি। অর্থ এবং অনুমোদনের অপেক্ষা তিনি করেন নি। সেই অপেক্ষায় থাকলে সড়ক দুটি এতদিনেও হতো কিনা সন্দেহ। মহিউদ্দীন চৌধুরী এটা পেরেছিলেন তার বিশাল ব্যক্তিত্বের কারণে।

মহিউদ্দীন চৌধুরীর সময়ে নগরবাসীর হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়েনি। বরং ২৩ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স তিনি মওকুফ করে দিয়েছিলেন। রিকশার লাইসেন্স এবং রিকশা চালকের লাইসেন্স মওকুফ করে দিয়েছিলেন। নগরবাসীকে তুষ্ট রেখে তিনি কর্পোরেশনের আয় বাড়িয়ে তা দিয়ে অনেক জনহিতকর প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। বর্তমানে আগ্রাবাদে সিঙ্গাপুর- ব্যাংকক মার্কেটের জায়গাটি ছিল গণপূর্ত বিভাগের। মহিউদ্দীন চৌধুরী অনেক দৌঁড়ঝাপ করে মাত্র ১ টাকা প্রতীকে মূল্যে সেটি চসিকের নামে বরাদ্দ নেন। সেখানে মার্কেটটি নির্মাণ করে সেলামী বাবদ চসিকের তহবিলে জমা করেন ৪০ কোটি টাকা। ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সের জায়গাটি ছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(সিডিএ)র। সেটি পড়ে ছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। সিডিএ থেকে সেটি লিজ নিয়ে আধুনিক মার্কেট করে দোকান বরাদ্দের বিপরীতে চসিকের তহবিলে আয় করেন ৪০/৪৫ কোটি টাকা। নগরীর পতেঙ্গা, সল্টগোলা ক্রসিং, গোসাইলডাঙ্গা, পাহাড়তলী, কর্নেলহাট, বহদ্দারহাট, কালুরঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা জায়গাসমূহ উদ্ধার করে মার্কেট, হাসপাতাল ইত্যাদি করে কোটি কোটি টাকার তহবিল জোগাড় করেছেন। খুলশী এলাকায় বিস্তীর্ণ এলাকার জমি নিয়ে দু- তিন পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মামলা- মোকদ্দমা চলে আসছিল। মহিউদ্দীন চৌধুরী উভয়পক্ষের কাছ থেকে সেসব জমি চসিকের নামে কিনে নেন। সেখানে আবাসন প্রকল্প করে প্লট বরাদ্দ দিয়ে ১০০ কোটি টাকা আয় হয় চসিকের। এভাবে কর্পোরেশনকে স্বনির্ভর করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি নগরীর স্বাস্থ্য সেবায়ও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন।

চসিক পরিচালিত স্কুল- কলেজের সংখ্যা বাড়িয়ে তিনি এগুলোকে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছিলেন। চট্টগ্রামে যখন সিএনজি চালিত যানবাহন প্রচলন হয়নি তখন তিনি দামপাড়ায় নগরীর প্রথম সিএনজি স্টেশন স্থাপন করেন। এরপর নগরীতে দ্রুত সিএনজি চালিত যানবাহন বাড়তে থাকে। নগরীতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাশবাহী গাড়ি চালু করে তিনি স্বল্প খরচে তা ব্যবহার করতে পারার ব্যবস্থা করে গেছেন। রাতদিন তিনি নগরী চষে বেড়াতেন। ফলে কোথায় কোনো ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখলে তিনি ওয়াকিটকিতে হল্লাচিল্লা করে একশেষ করতেন। সংশ্লিষ্টরা তার ভয়ে তটস্থ থাকতেন। এভাবে নগরীকে তিনি পরিচ্ছন্ন নগরীতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন।

বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি বা গ্রুপিংয়ের কোনো অতীত ইতিহাস তার নেই। তার মেয়াদের একবছর চলে গেছে। বাকি সময়ের মধ্যে তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে চসিককে স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে। কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে। তিনি পারবেন এই প্রত্যয় ব্যক্ত করা যায়। তবে আয় বাড়ানোর চেষ্টায় যেন জনতুষ্টির দিকটি উপেক্ষিত না হয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে সে বিষয়টিও তাকে মাথায় রাখতে হবে। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে সেটি তার ভাবনায় নিশ্চয় থাকবে।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্যকর পৃথিবীতে অস্বাস্থ্যের অনুজীব-খাদ্যে ভেজাল
পরবর্তী নিবন্ধদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা বড়ই অবহেলিত