চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ‘ইনসিরেশন’ পদ্ধতি বা বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০১৯ সালে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে পদ্ধতিটি অনুসরণ করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন কার্যক্রম শুরুও হয়েছে। তবে ভূমির সংস্থান না হওয়ায় চট্টগ্রামে উদ্যোগটি থমকে যায়। তবে এবার সে বাধা দূর হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) অনুকূলে ৩০ থেকে ৩৫ একর খাস জমি বরাদ্দ দিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ‘ইনসিরেশন’ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চসিককে এ জমি দিতে হবে প্রতীকী মূল্যে। প্রসঙ্গত, ইনসিরেশন পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন। তবে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও চীনে এ পদ্ধতির প্রচলন আছে। চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম দৈনিক আজাদীকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বারবার জমি দেয়ার জন্য বলা হয়। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। সেটা আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এখন মন্ত্রলালয় থেকে জেলা প্রশাসনকে খাস জমি দেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে বলে জানতে পেরেছি।
জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর খাস জমি বরাদ্দের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ইনসিরেশন পদ্ধতিতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত সারসংক্ষেপ অনুযায়ী বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের জন্য সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক প্রয়োজনীয় জমির সংস্থানের বাধ্যবাদকতা রয়েছে। কিন্তু চসিক মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, সংস্থাটির মালিকানাধীন হালিশহর ল্যান্ডফিলে ৬ দশমিক ০২ একর জমি রয়েছে যাতে প্লান্ট স্থাপনের জন্য একেবারেই অপ্রতুল।
মন্ত্রণালয়ের চিঠি সূত্রে জানা গেছে, চসিকের হালিশহর ট্রেসিং গ্রাউন্ড ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রচুর সরকারি খাস জমি রয়েছে, যেখান থেকে ৩০ থেকে ৩৫ একর জমির সংস্থান করা সম্ভব। এ অবস্থায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষে চসিকের আওতাভুক্ত এলাকায় ৩০ থেকে ৩৫ একর খাস জমি চসিকের অনুকূলে প্রতীকী মূলে বরাদ্দ প্রদানের দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জমি পাওয়া গেলে দ্রুত বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কার্যক্রম শুরু করা হবে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করা হবে। প্রথম ধাপে হবে বর্জ্য সংগ্রহ। সিটি কর্পোরেশন উৎস থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে ‘সেকেন্ডারি স্টেশন’ (এসটিএস) এ নেয়া হবে। এসটিএস থেকে ‘ইনসিরেশন প্ল্যান্ট’ এ নেয়া হবে বর্জ্যগুলো। এক্ষেত্রে যে ব্যয় হবে তা সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব বাজেট হতে সংস্থান করতে হবে। ‘ইনসিরেশন প্ল্যান্ট’ স্থাপন ও পরিচালনা ব্যয় বেসরকারি উদ্যোক্তা বহন করবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, একটন কঠিন বর্জ্য থেকে ৫৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে বর্জ্য পুড়িয়ে তার পরিমাণ কমিয়ে ফেলা যায়। এই ক্ষেত্রে বর্জ্য পুড়িয়ে তার পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব। বর্জ্যগুলো পোড়ালে তাপ উৎপাদিত হবে। উৎপাদিত তাপ কাজে লাগিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি ফুটিয়ে বাষ্প উৎপাদন করা হবে এবং ‘টারবাইন’ ঘুরিয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, নগরে ২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সঙ্গে সমাঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বাবিউবো)। পরবর্তীতে দুই দফা দরপত্র আহ্বান করলেও প্ল্যান্ট নির্মাণে কোনো প্রতিষ্ঠান সাড়া দেয়নি। ফলে উদ্যোগটি আটকে যায়। এরপর ২০১৯ সালের ২০ জুন সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে সাত সদস্যের একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাদের প্রতিবেদনেই বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কর্মপরিকল্পনা উঠে আসে। সে আলোকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চসিকের কাছে ৩০ একর জায়গা চায়। যার সংস্থান করতে পারেনি চসিক।
চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চসিকের দুটি বর্জ্যাগার বা ল্যান্ডফিল আছে। এর মধ্যে ৯ একর জায়গায় হালিশহরের আনন্দবাজারে এবং ১১ একর জায়গার উপর গড়ে উঠে বায়েজিদ আরেফিন নগরের ল্যান্ডফিল। অর্থাৎ দুটো ল্যান্ডফিল মিলে আয়তন হচ্ছে মাত্র ২০ একর। চসিকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, হালিশহর বর্জ্যাগার ১৪ মাস এবং আরেফিন নগর বর্জ্যাগারে আর পাঁচ মাস বর্জ্য ফেলা যাবে।
জাইকার একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নগরের ৪১ ওয়ার্ডে দৈনিক ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৩০ টন গৃহস্থালি, ৫১০ টন সড়ক ও অবকাঠামোগত এবং ৬৬০ টন মেডিকেল বর্জ্য। উৎপাদিত বর্জ্যের মধ্যে কর্পোরেশন সংগ্রহ করে দুই হাজার টন। বাকি বর্জ্য নালা–নর্দমা, খাল–বিল, নদী ও উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকে। তবে সর্বশেষ ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত জাপান সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে দেশটির প্রতিষ্ঠান ‘জেএফই ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন’ এবং ‘ইয়চিও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন’ এর পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী, নগরে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ১০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে অন্তত এক হাজার টন বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।