নগরীর খালগুলো পরিকল্পিতভাবে পুনরুদ্ধার করা জরুরি

| মঙ্গলবার , ১৩ জুলাই, ২০২১ at ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম শহরে ঠিক কতোটি খাল ছিলো এবং আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান কোথাও সংরক্ষিত আছে, এমন খবর পাওয়া যায় না। যদিও নানা সময়ে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলে আসছেন চট্টগ্রাম শহরে ১৪৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ১৭টি প্রধান খাল থাকার কথা। এই প্রধান খালের বাইরেও ছোটো বড় আরো কয়েকটি খালের কথাও উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রতি বছর বর্ষাকে সামনে রেখে শহরের এসব খাল থেকে মাটি, ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করে থাকে। তখন নানাভাবে গণমাধ্যমে এসব খালের কথা উল্লেখ করা হয়, যেগুলো এখন মুমূর্ষু অবস্থায় আছে। বলা যায়, প্রতিটি খালই হারিয়েছে তার প্রশস্ততা, অনেকগুলো হারিয়েছে তাদের অস্তিত্ব।
গত ১১ জুলাই দৈনিক আজাদীতে ‘খনন হয়নি, উল্টো ভরাট’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে নগরের ৫৭টি খালের কথা বলা হয়েছে। সংবাদে বলা হয়, স্যুয়ারেজ মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের অংশ হিসেবে ২০১৬ সালে নগরের ৫৭টি খালের জরিপ করেছিল চট্টগ্রাম ওয়াসা। এতে শহরের পানি নিষ্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ রাজাখালী খালকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়। খালটি থেকে ৩৮ হাজার ৫২০ বর্গমিটার মাটি উত্তোলনের প্রস্তাবনা করা হয়েছিল ওই জরিপে।
পরের বছর নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায় সিডিএর গৃহীত মেগা প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। প্রকল্পের আওতায় রাজাখালী খালকে ঘিরেও খননসহ উন্নয়ন কাজ করার কথা। ইতোমধ্যে খালটির দুই পাড়ে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। এ জন্য খালের মাঝখানে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয় রাস্তা। গতকালও খালের বিভিন্ন অংশে দেখা গেছে সে রাস্তা। অর্থাৎ ওয়াসার প্রস্তাব অনুযায়ী খনন তো হয়নি, ওল্টো ভরাট হয়েছে রাজাখালী খাল। খালটি ভরাট থাকায় সামপ্রতিক বর্ষণে পূূর্ব বাকলিয়া, দক্ষিণ বাকলিয়া, বাদুরতলা, পূর্ব ষোলশহর, পশ্চিম বাকলিয়াসহ বৃহৎ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছে।
শুধু রাজাখালী খাল নয়। শহরের পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম অন্যান্য খালের অবস্থাও প্রায় একই। অর্থাৎ ভরাট হয়ে আছে। অবশ্য সবগুলো খালে বাঁধজনিত সমস্যা নাই। তবে গৃহস্থালী বর্জ্য, পলিথিনসহ নানা ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে খালগুলো। অনেক খালের আবার দুই পাশজুড়ে আছে অবৈধ দখলদারদের আধিপত্য। দখল ও ভরাট হয়ে থাকায় খালগুলো হারিয়েছে তার আসল রূপ। এতে পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। ফলে অল্পবৃষ্টিতেই হচ্ছে তীব্র জলাবদ্ধতা। দ্রুত খনন করা না হলে ভারী বর্ষণ হলে আগামীতেও ডুবতে পারে শহর। চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রণীত মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী নগরে মোট ৫৭টি খাল রয়েছে। যার মোট দৈর্ঘ্য ১৬৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। এরমধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ হচ্ছে খন্দকীয় খাল। যার দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৪ কিলোমিটার। দ্বিতীয় দীর্ঘ ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটারের রাজাখালী খাল। নগরের পানি নিষ্কাশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রধান দুই খাল যথাক্রমে চাক্তাই খালের দৈর্ঘ্য ৬ কিলোমিটার এবং মহেশখালের দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার। এদিকে চলমান মেগা প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন কাজ চলছে ৩৬টি খালে। অর্থাৎ ২১টি খালে কোনো কাজই হচ্ছে না। ফলে ওসব খালের অবস্থা আরো বেহাল।
আসলে খালগুলোকে এখন চেনাই যাবে না। কেননা খালের জায়গায় তৈরি হয়েছে অন্য স্থাপনা। বেদখল হয়ে গেছে সব। এমনকি হারিয়ে গেছে অধিকাংশ খাল। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যমতে, বসতঘর, ঝুপড়ি, দোকানপাট, মিল-আড়ত, গুদাম, সুরম্য ভবনসহ হরেক অবৈধ স্থাপনা গেঁড়ে বসেছে। যা অবশিষ্ট আছে সেসব খাল-ছড়া, নালা-নর্দমাজুড়ে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। স্তরে স্তরে পলিথিন ও প্লাস্টিক অপচনশীল বর্জ্য। অপদখলের উদ্দেশে চলছে ভরাটকাজ। খাল-ছড়া-ঝরনাগুলোর চওড়া, গভীরতা, দৈর্ঘ্য কমে গেছে। মহানগরীর ৫৭টি খালেরই এমন মরণদশা।
আমাদের মনে রাখা জরুরি যে চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রকৃতির প্রাণ খাল-ছড়া। খালগুলোর অস্তিত্ব নষ্ট করে ছোট্ট নালায় পরিণত করা হয়েছে। অনেক জায়গায় খালও নেই, হারিয়ে গেছে। বেআইনি বা অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। বারবার খাল-নালা-নর্দমা অবৈধ দখলবাজদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের কথা শুনি, কিন্তু বাস্তবে কোনো অ্যাকশন দেখা যায় না। এক্ষেত্রে জনস্বার্থে চসিক, সিডিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসনসহ নাগরিক সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে সমন্বিত ভূমিকা রাখতে হবে।
নগরপরিকল্পনাবিদদের মতে, মহানগরীর খালগুলো পরিকল্পিতভাবে পুনরুদ্ধার করা জরুরি। যে কোনো বাধা-বিপত্তির ঊর্ধ্বে উঠে সমন্বিতভাবে তা করতে হবে। দখল-ভরাট-দূষণমুক্ত করে খাল-ছড়াগুলো স্বাভাবিক ও সচল করা না হলে চট্টগ্রামকে পুরোপুরি জলাবদ্ধতামুক্ত করা সম্ভব নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে