ধুলোয় ধূসর নগরী

মেগা প্রকল্পের চাপে বিবর্ণ ১২ সড়ক, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:০৬ পূর্বাহ্ণ

নগরীতে বাস্তবায়নাধীন বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পের কারণে ধুলোয় ধূসর হয়ে পড়েছে নগরী। এতে কমপক্ষে ১২টি সড়কের ধুলোবালির কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন নগরবাসী। বিশেষ করে নগরীর অধিকাংশ এলাকায় সড়কের পাশে ফেলে রাখা ড্রেন নির্মাণ কাজে খোঁড়া কাদামাটি ও আবর্জনা থেকে সৃষ্ট ধুলোয় বিপর্যস্ত করছে নগরীকে। বাতাসে ধুলোর দূষণ বন্ধে নিয়মমাফিক পানি ছিটানোর কথা থাকলেও মানছেন না প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ধুলোবালির কারণে শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশনে বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ধুলোবালির দূষণ মানবশরীরে অতিরিক্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, মানমাত্রার বাইরে ধুলোর দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। একই সাথে লালখান বাজার বিমান বন্দর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণও করছে সিডিএ। অন্যদিকে নগরীর ৬০ লাখ বাসিন্দাদের পানির সমস্যা নিরসনে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ওয়াসা। তাছাড়া নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়কের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কাজ করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। পুরো নগরীতেই চলছে এসব প্রকল্পের কাজ। সমন্বয়হীনতার কারণে ধীরগতিতে চলছে চলমান এসব উন্নয়ন কাজ। এতে এসব প্রকল্পের নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে নগরজীবনে। যার একটি ধুলোর দূষণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লালখান বাজার হতে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের কারণে ইপিজেড হতে ১৫নং পতেঙ্গা বিচ পর্যন্ত এবড়োথেবড়ো হয়ে পড়েছে সড়কের দুই পাশ। এতে ধুলোবালির কারণে নাভিশ্বাস উঠছে সড়কটি ব্যবহারকারীদের। ওই এলাকায় চট্টগ্রাম তথা দেশের বৃহৎ দুটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) থাকার কারণে লোকজনের ঘনত্বও নগরীর অন্য এলাকাগুলোর চেয়ে বেশি। ধুলোর কারণে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে সড়কটি ব্যবহারকারীদের।
তাছাড়া ওয়াসার পানি সরবরাহ প্রকল্প ও চসিকের সড়ক উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ কাজের কারণে নগরীর পোর্ট কানেক্টিং রোডের অনেকাংশে, সদরঘাট হতে মাঝিরঘাট বাংলাবাজার হয়ে রশিদ বিল্ডিং, কদমতলী শুভপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বারিক বিল্ডিং, বারিক বিল্ডিং হতে কাস্টমস মোড়, বহদ্দারহাট হতে কাপ্তাই রাস্তার মাথা হয়ে কালুরঘাট, দেওয়ানহাট হতে ঈদগাঁও কাঁচারাস্তা মোড় ও পাহাড়তলী বাজার হয়ে অলংকার (ডিটি রোড), নতুন ব্রিজ হতে মেরিনার সড়কের পুরাতন ফিসারিঘাট ব্রিজ পর্যন্ত, মুরাদপুর হতে পাঁচলাইশ, কদমতলী হতে ধনিয়ালাপাড়া হয়ে দেওয়ানহাট, চকবাজার কাঁচাবাজার হতে রাহাত্তারপুল, দেওয়ান বাজার কাঁচাবাজার হতে আফগান মসজিদ পর্যন্ত সড়ক ছাড়াও প্রবর্তক মোড়, বহদ্দারহাট মোড়সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ধুলোবালির কারণে হাঁটাচলাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, সড়কগুলোতে কোথাও কোথাও ড্রেন নির্মাণের জন্য মাটি খুঁড়ে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়েছে। ওই মাটি থেকে ধুলোবালি ছড়িয়ে পড়েছে পাশ্ববর্তী দোকানপাট, অফিস, বাসাবাড়িতে। ধুলোর দূষণ বন্ধে নিয়মিত পানি ছিটানোর কথা থাকলেও তা মানছেন না কেউ। নগরীর বন্দরটিলা এলাকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাস্তার মধ্যখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলার বসানো হচ্ছে। দুই পাশে রাস্তা থেকে প্রতিনিয়ত ধুলোবালি উড়ছে। নামকাওয়াস্তে মাঝেমধ্যে পানি ছিটানো হলেও বেশিরভাগ শুষ্ক থাকে।’
নগরীর ঈদগাঁও কাঁচারাস্তা এলাকার বাসিন্দা টিপু সুলতান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘দেওয়ান হাট হতে অলংকার পর্যন্ত পুরাতন ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডে দুর্ভোগের কমতি নেই। সড়কটি বেশিরভাগ স্পটে উঁচু নিঁচু গর্ত। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে ধুলোর আস্তরণ তৈরি হয়। কখনো পানি ছিটানো হয় না।’

নগরীর বহদ্দারহাট এলাকা দিয়ে নিয়মিত অফিসে যাতায়াতকারী নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘বহদ্দারহাট মোড়, কাপ্তাই রাস্তার মাথাসহ কালুরঘাট পর্যন্ত সড়কে ধুলোবালির কারণে যাতায়াতে দুর্ভোগে পড়তে হয়। নাকে মাস্ক ব্যবহার করেও ধুলো থেকে নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না।’
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শিমুল কুমার ভৌমিক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বাতাসে ধুলোবালির পরিমাণ যদি বেড়ে যায়, তাহলে অ্যাজমা, সিওপিডি রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাছাড়া শিশুরা শ্বাসযন্ত্রের ইনফেকশনে বেশি আক্রান্ত হয়। এখন যেহেতু করোনা প্রাদুর্ভাব রয়েছে, সেক্ষেত্রে ধুলোবালি শ্বাসরোগকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করে। এজন্য নগরীর বায়ু দূষণ যথটা সম্ভব কমিয়ে আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সচেষ্ট হওয়া উচিত।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আগাম ছাড়পত্র নিয়েই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হয়। কিছু কিছু উন্নয়ন প্রকল্প চলছে যেসবের কোনো পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। নগরীতে ধুলোবালির দূষণ নিয়ে আমরা কিছু কিছু অভিযোগ পাচ্ছি। এখন আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের গবেষণাগারের পরিচালকের সহযোগিতায় নমুনা সংগ্রহের পদক্ষেপ নেব। এরপর পরীক্ষায় পরিবেশ আইন ভঙ্গের প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘ধুলোবালির কারণে বাতাসে এসপিএম (সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটার) ১৫০ পিপিএম মাত্রার অধিক হলে পরিবেশ আইন ভঙ্গ হয়।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘চলমান প্রকল্পগুলোর কারণে যেখানে ধুলোর দূষণ হচ্ছে সেখানে নিয়মিত পানি ছিটানোর জন্য সংশ্লিষ্টদেরকে আমরা চিঠি দিয়েছি। দিনে তিনবার করে পানি ছিটানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা এ নির্দেশনা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ আইনী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘ধুলোবালির দূষণ থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করার জন্য ‘রোড ওয়াশ’ কার্যক্রম হাতে নিচ্ছি। রোববার (আগামীকাল) একটি সড়কে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে। পর্যায়ক্রমে পুরো নগরীতে তা ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধশখের বাইকে প্রাণ গেল ফাহিমের
পরবর্তী নিবন্ধঅস্ত্রের মুখে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীকে অপহরণের অভিযোগ