ধরিত্রীকে মা অর্থাৎ নারী হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা বহু প্রাচীন। বিভিন্ন সভ্যতা এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাব নানা আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধরিত্রীর নারীত্ব উদযাপন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে পালিত হয় তেমনি একটি লোকাচার ‘অম্বুবাচী’ বা ‘রজঃপর্ব’। ‘অম্বুবাচী’ শব্দের অর্থ হল জল সুচনা। আষাঢ় মাসের শুরুতে ধরিত্রী বা বসুমাতা বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ঋতুমতি নারী হিসেবে গণ্য হন। কৃষিভিত্তিক সমাজের সাথে যার নিবিড় যোগসূত্র। রজঃস্বলা নারীকে যেমন সন্তান ধারণে সক্ষম মনে করা হয় তেমনি বসুধাও ঋতুমতি হয়ে জলসিক্ত হয়, হয়ে ওঠে শস্যশ্যামলা। উর্বরতা বৃদ্ধি এবং ভাল ফসল ফলার সাথে সম্পর্কিত এটি। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, সূর্য যে বারের যে সময়ে মিথুন রাশিতে গমন করে, তার পরবর্তী সেই বারের সেই কালে অম্বুবাচী হয়। এ-নিয়ে বাংলা প্রবাদও রয়েছে- ‘কিসের বার কিসের তিথি, আষাঢ়ের সাত তারিখ অম্বুবাচী’। মূলত আষাঢ়ের সাত থেকে দশ তারিখ এই তিনদিন বাংলাদেশসহ ভারতের বাংলা, আসাম, উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চলে অম্বুবাচী পালন করা হয়।
প্রাচীনকালে এই তিনদিন ধরিত্রীকে বিশ্রাম দিয়ে অম্বুবাচী নিবৃত্ত হওয়ার পর পুনরায় জমি চাষ শুরু করা হত। বঙ্গের বিভিন্ন অংশে আদিবাসী এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীর কৃষকরা অম্বুবাচীর এই তিনদিন লাঙ্গল চাষ থেকে বিরত থাকেন এখনও। তারা মনে করেন এই তিনদিনে জলসিক্ত হয়ে জমি পুনরায় চাষাবাদের উপযোগী হয়ে উঠবে। এ-কটা দিন মাটির চুলায় কোন আগুন জ্বালান না ব্রহ্মচারী, সাধু সন্ন্যাসী এবং বিধবা নারীরা। এমনকি জমিতে কোনরকম আঘাত করা হয় না এ সময়, যেহেতু ধরিত্রী ঋতুমতী।
উড়িষ্যায় নারী এবং ধরিত্রীর ঋতুস্রাব পালন করা হয় তিনদিন ধরে। উৎসবটি ‘রজ পর্ব’ নামে পরিচিত। এ- সময় নারী এবং কন্যাশিশুদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালিত হয় এবং কৃষির সাথে সম্পর্কিত সব ধরণের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। নারীরা এ সময় ঘরের কোন কাজ করে না। ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন, আয়োজন থাকে বিশেষ খাবারের । লোকবিশ্বাস অনুযায়ী এই তিনদিন ধরে ধরণীর রজঃস্রাব চলে এবং চতুর্থদিন আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে স্নান করান হয়। রজ পর্বের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিন ‘পাহিলি রজ’, ‘মিথুনা সংক্রান্তি’ এবং ‘বাসি রজ’ হিসেবে আচরিত হয়। চতুর্থ দিন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বসুমতি স্নান’ করিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
আসামে অম্বুবাচীকে কেন্দ্র করে অম্বুবাচী মেলা বসে কামাখ্যা মন্দিরে। শাক্তধর্মেও প্রধান উৎসব এই অম্বুবাচী মেলা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্ত ও পর্যটকদের ঢল নামে এখানে। মাতা ধরিত্রীর রজঃস্বলা হওয়ার প্রতীক হিসেবে বিশেষ পুজার আয়োজন করা হয়। পুরাণ মতে, শিবের স্ত্রী সতীর মৃত্যুতে মৃতদেহ নিয়ে প্রবল আস্ফালনে দাপিয়ে বেড়ান শিব। শিবের তাণ্ডবে জগত ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। ফলে সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণু জগতের মঙ্গল কামনা করে একান্ন খণ্ডে বিভক্ত করেন সতীর দেহ। দেহাংশগুলো এক এক করে ধরাধামে পড়তে থাকে এবং সেখানেই পাথরে পরিণত হয়। যেই স্থানে দেবীর যোনী পতিত হয়েছিল সেই স্থানকে বলা হয় তীর্থ চূড়ামণি। কামাখ্যাই হল সেই তীর্থ চূড়ামণি বা মহা গুরুত্বপূর্ণ পীঠ। উল্লেখ্য এই মন্দিরে চারটি কক্ষ রয়েছে। একটি গর্ভগৃহ এবং তিনটি মণ্ডপ। গর্ভ গৃহটি ছোট এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। ভিতরে কোন মূর্তি নেই বরং ঢালু পাথরের যোনী আকৃতিবিশিষ্ট একটি পাথরখণ্ড রয়েছে। যেখানে দশ ইঞ্চি গভীর একটি গর্ত রয়েছে। একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে গর্তটি সব সময় ভর্তি থাকে। এই গর্তটিই কামাখ্যা নামে পূজিত। অম্বুবাচীর দিনগুলোতে দেবি রজঃস্বলা হয়েছেন এই লোকবিশ্বাসে মন্দিরের দুয়ার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে এই সময় সত্যি প্রসবণের জল লাল রঙ ধারণ করে। কেউ বলেন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের মাটি অতিরিক্ত আয়রন সমৃদ্ধ হওয়ায় বর্ষার প্লাবনে জলের রঙ লাল হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, মন্দিরের পণ্ডিত জলে সিঁদুর মিশিয়ে রাখেন এই কয়েকটা দিন। সে যাই হোক না কেন চতুর্থ দিন স্নান এবং পুজা শেষ করে দেবী দর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়। মন্দিরের পাণ্ডারা ভক্তদের উদ্দেশ্যে রক্তবস্ত্র উপহার দেন। ভক্তদের বিশ্বাস এই বস্ত্র ধারণ করলে মনস্কামনা পূর্ণ হবে। সন্তানহারা অনেক দম্পতি সন্তান লাভের আশায়ও এখানে ভিড় জমান।
ভারতীয় উপমহাদেশে এই নারীত্বের উদযাপনটা যেন দ্বিচারি! একইসাথে নারীর উর্বরতা নারীর রজঃস্রাব নিয়ে উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি মাসিকের দিনগুলোতে নারীকে যেমন অশুচি মনে করা হয় ঠিক তেমনি ধরিত্রীকে অশুচি মনে করে যাবতীয় মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠান যেমন- গৃহপ্রবেশ, বিবাহ ইত্যাদি বন্ধ রাখা হয়। মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। একদিকে উদযাপন অন্যদিকে অশুচি জ্ঞান!
পাশাপাশি গভীরে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাব ধরিত্রী বা দেবীকে নারী হিসেবে কল্পনা করে সেটা উদযাপন করা হচ্ছে কিন্তু যখনই নারী রক্তমাংসের মানুষ তখন তার রজঃ ট্যাবুতে পরিণত হচ্ছে। নেপালে এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মাসিক চলাকালীন সময় নারীদের অপবিত্র মেনে ঘর থেকে দূরে রেখে আসা হয়। বিশেষত নেপালে ‘ছোপড়ি’ প্রথা পালিত হয়ে আসছে বহু প্রাচীন কাল থেকে। রজঃস্বলা নারীকে ছোট ঝুপড়িতে থাকতে বাধ্য করা হয়। বাধ্য করা হয় ভাত, লবণ আর শুকনো ফলমূল খেতে। মাংস, দুধ, ফলমূল খেতে দেওয়া হয় না এই ভেবে যে, এগুলো খেলে এ-সকল পণ্যের উৎপাদন ব্যহত হবে। যদিও ২০০৫ সালে নেপালের সুপ্রিম কোর্ট এই ‘ছোপড়ি’ প্রথাকে বেআইনী ঘোষণা করেছে তারপরও প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে এটা পালন করা হয়।
বাংলাদেশেও ধর্ম নির্বিশেষে রজঃস্বলা নারীদের অপবিত্র জ্ঞান করা হয়। এটি লুকিয়ে রাখা হয় যেন খারাপ কিছু। এমনকি মাসিক হলে বলাই হয় ‘শরীর খারাপ’ করেছে। কয়দিন আগেই স্যানিটারি ন্যাপকিনের একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে তোলপাড় হয়ে গেল এটা নিয়ে যে, নিজের পরিবারের পুরুষগুলোর থেকেও মাসিকের ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে হবে। আর এই যে লুকোচুরি খেলা এটার কারণে মাসিক চলাকালীন সময় বেশীরভাগ নারীই আড়ষ্ট হয়ে চলাফেরা করেন। পাশাপাশি নানারকম সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ আরোপিত হয় নারীর উপর। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নেওয়া যাবে না, মাছ-মাংস খাওয়া যাবে না, গোয়ালঘরে গেলে গবাদি-পশুর ক্ষতি হবে, পিঠা তৈরির সময় সামনে থাকলে পিঠা নষ্ট হবে ইত্যাদি নানা সংস্কার। এখনও বেশিরভাগ কিশোরী নারীর রজঃপ্রাপ্তির পরপরই তাদের শেখানো হয় তুমি পুরুষের সংস্পর্শে আসলেই গর্ভবতী হয়ে পড়বে। অথচ এই সংস্কারগুলো মাথায় না ঢুকিয়ে প্রতিটি কিশোর-কিশোরীকেই এই বয়সে সঠিক যৌন শিক্ষা দেওয়া দরকার ছিল পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উভয়ভাবেই। সেটা না দেওয়ার ফলে নারীরা এই সময় গা ঘিনঘিনে অস্বস্তিকর মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে যেহেতু তার মাথার ভেতর আগেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তুমি অপবিত্র। অপরদিকে এ-সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা না পেয়ে বা ভুল শিক্ষা পেয়ে অনেক পুরুষই এই সময়টা নিয়ে মজা করে। কেউ কেউ রক্ত দেখলে উত্যক্ত করে নারীকে। ফলত নারীরা নিজের শরীরকে নিজের শত্রু জ্ঞান করে এক ধরণের হীনমন্যতা নিয়ে কুঁকড়ে থাকে। এ-সময় ঘর থেকে বের হতে চায় না। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে সামাজিক কুসংস্কার, বিধিনিষেধ এগুলো নিয়ে নারী বেড়ে তো উঠছেই, তাদের বাইরে চলাফেরাও নির্বিঘ্ন করতে পারি নি আমরা। ২০১৯ সালের জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি পরিসংখ্যান বলছে ৩০ ভাগ কিশোরী মাসিক চলাকালীন সময় স্কুলে যেতে পারে না বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা না থাকায়। ন্যাশনাল হাইজিন জরিপ ২০১৮ এর মতে, ৬৪ শতাংশ বিদ্যালয়ে নারী শিশুদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোন ধরণের শিক্ষা দেওয়া হয় না। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৪ দিন করে সময়ও যদি মাসিক চলে একজন কিশোরী এক বছরে প্রায় ৫০ দিন শিক্ষাজীবন থেকে হারিয়ে ফেলছে। বিদ্যালয়গুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন, বিনামূল্যে বা নামেমাত্র মুল্যে স্যানিটারি প্যাড বিতরণ, সঠিক যৌন শিক্ষার মাধ্যমে মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর জোর দিয়ে সহজেই কিন্তু এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা যায়।
ভারতে নারীর এই মাসিককালীন সময়ে সামাজিক এবং ধর্মীয় নানা বিধিনিষেধ তো রয়েছেই পাশাপাশি সামপ্রতিক সময়ে একটি ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে। মহারাষ্ট্রের হাজার হাজার ঋতুবতী নারী অস্ত্রোপচার করে জরায়ু ফেলে দিচ্ছেন। এমনিতেই কর্মক্ষেত্রে নারীরা নানা ধরণের নিপীড়নের শিকার হন তার উপর মাসিককে কেন্দ্র করে এক ধরণের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু জেলায় প্রচুর পরিমাণ আখের খেত রয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষরাই সেখানে আখ কাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। স্থানীয় ঠিকাদাররা নারীদের মাসিকের দোহাই দিয়ে অনেক সময় কাজে নিতে চান না অথবা কম পারিশ্রমিক দেন। আবার দূর থেকে আসা শ্রমিকদের বসবাসের জায়গাও অস্বাস্থ্যকর, থাকে না কোন শৌচাগার। এরকম পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে অনেক নারীই জরায়ুর বিভিন্ন সংক্রমণে আক্রান্ত হন। এমতাবস্থায় তারা ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হলে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার বদলে জরায়ু ফেলে দেবার পরামর্শ দেন অতিরিক্ত লাভের আশায়। এই নারীদের জানানো হয় না জরায়ু না থাকলে তারা কি ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এভাবে মহারাষ্ট্রের বেশকিছু গ্রাম ‘জরায়ুবিহীন নারীদের’ গ্রামে পরিণত হয়েছে।
এই উপমহাদেশে ধরিত্রী বা দেশকে মা হিসেবে মহিমান্বিত করে নারীত্বের উদযাপন আমরা দেখি। এর আড়ালেই লুকিয়ে থাকে বন ধ্বংস, নদী ধ্বংস, উর্বরতার সমস্তটুকু নিংড়ে নেওয়ার গল্প। তেমনি একদিকে নারীর উপর নারীত্ব, মাতৃত্ব ইত্যাদি সুন্দর-সুন্দর বিশেষণে ভূষিত করে নারীর সমস্ত মেধা, শ্রম শুষে নেয়। অন্যদিকে যে রজঃস্রাবের কারণে এই বিশেষণগুলো দেওয়া হয় সেটিকেই ট্যাবু হিসেবে আড়াল করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলা হয় অসংখ্য নারীকে।
লেখক: প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক