ধরা পড়ার দিনটি

অনিক মাহতাব মুশফি (৩১,৭২২) | বুধবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

স্কুল পালিয়ে সেদিন রাহাত বেশ খানিকটা সময় পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে কাটিয়ে দিল। বেরিয়ে আসার সময় ঘড়িতে দেখল সবে তিনটা বেজেছে। স্কুল ছুটি হয় পৌনে পাঁচটায়। এখনও হতে ঢের সময়। এ সময়টা কি করে কাটানো যায় ভেবে না পেয়ে সে ঠিক করল রাস্তায় ঘোরাঘুরি করেই কাটাবে। সে হাঁটা শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে একসময় স্কুলের সামনে চলে এলো। স্কুলের ঘণ্টা পড়ল এমন সময়। গেট খুলে গিয়ে ক্লাস ফাইভের একদল ছেলেকে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। ছো্‌ট ছোট ছেলেরা দল বেঁধে ছুটে আসছে পিলপিল করে। অন্যান্য ক্লাসের ছুটি পরে হবে। রাহাত বাচ্চা ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় অন্যমনস্ক হয়ে গেল। অন্যমনস্ক রাহাত হঠাৎ ধুলো মাটির পৃথিবীতে ফিরে এলো। তার চোখ বিস্মিত হয়ে গেল। পা দুটো ক্ষণিকের জন্য সাঁড়াশির মত মাটির সাথে আটকে গেল। বুক ঝিম করা এক ভয় তাকে ঘিরে ধরল। কারণ ক্লাস ফাইভের বাচ্চাগুলোর পেছনে এক স্যারের মূর্তি। কোথা থেকে এই স্যারের আকস্মিক আগমন ঘটল বলতে পারবে না রাহাত। অন্য কোনো স্যার হলেও অসুবিধের কিছু ছিল না। কিন্তু ইনি যে তাদের ক্লাসটিচার সাফওয়ান স্যার।
পড়িমরি করে ছুটল রাহাত। কোথায় যাবে, কী করবে কিছুই মাথায় এল না তার। পাশে পিটিআই স্কুলের ভেতরে ঢুকে গেল সে। এই স্কুলে সে আগে পড়েছে। একটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে ঘাপটি মেরে নিঃশ্বাস আটকে বসে পড়ল। এখন সে নিশ্চিন্ত। সাফওয়ান স্যার এবার তাকে খুঁজতে এখানে চলে না এলেই হয়। কয়েক সেকেন্ড কিছু হল না। হঠাৎ মূর্তিমান আতঙ্কের ন্যায় স্যারের আগমন ঘটল খানিকক্ষণ গাছের গুঁড়িটার দিকে গভীর নিরীক্ষা চালালো রাহাত প্রাণপণে নিজেকে সংকুচিত করার চেষ্টা করল। পারলে একেবারে গাছের সাথে মিশে যায়। স্যার এবার পিটিআই স্কুলের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। রাহাত অবাক হয়ে ভাবল, পিটিআই স্কুলের দিকে কেন যাচ্ছেন স্যার? অবশ্য বেশি ভাবল না। পেছন ফিরে ভোঁ দৌড় দিল। পরদিন রাহাত স্কুলে গেল না। বৃহস্পতিবার পেরিয়ে শুক্রবার এল। শুক্রবার পেরিয়ে শনিবার এল। তাদের ক্লাসটিচার হয়ত রাহাতের স্কুল পালানোর ব্যাপারটি ভুলেই গিয়েছেন এই ভেবে রাহাত শনিবার স্কুলে গেল। ক্লাসটিস্যার সাফওয়ান স্যার ক্লাসে এসে রোল কল শুরু করলেন। রোল ডাকতে ডাকতে একসময় ডাকলেন ‘রোল ৫৬?’
‘ইয়েস স্যার’ স্যার এবার মুখ তুলে সাড়া দানকারীর মুখ পানে চেয়ে দেখলেন। হুঙ্কার দিয়ে ডাকলেন, ‘এই রাহাত এদিকে আয়’।
রাহাত শঙ্কিত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল। ‘তুই এখানে দাঁড়া। আমি রোল কলটা শেষ করে নিই’ রাহাত স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে কুল কুল করে ঘামতে লাগল। স্যার রোল কল শেষ করে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘তুই ঐদিন স্কুল পালিয়েছিলি কেন?’
রাহাত আশ্চর্য হওয়ার ভান করে বলল, ‘কই না তো স্যার।’
স্যার এবার কড়া গলায় বললেন, ‘তুই বৃহস্পতিবার স্কুল পালাইছিস। তোরে ক্লাসে দেখি নাই আমি। পিটিআই স্কুলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিলি। মিথ্যা বলবি না।’ রাহাত এবার স্পষ্ট বিপদে পড়ল। তারপরও শেষ চেষ্টা করল ‘স্যার ওটা আমি না।’
হঠাৎ রাহাতের বন্ধু তাহমিদ দাঁড়িয়ে গেল। সাক্ষী দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘স্যার বৃহস্পতিবারও স্কুলে এসেছিল’ স্যারের মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল, ‘এসেছিল নাকি? তাহলে বাপধন আমারে এইটা বুঝা রাহাতের নাম বৃহস্পতিবারে অ্যাটেনডেন্স লিস্টে নাই কেন?’
তাহমিদ আমতা আমতা করে বলল, ‘স্যার ও প্রেজেন্ট দিতে ভুলে গিয়েছে।’
স্যার মুখ ভেংচি দিয়ে বললেন, ‘ভুলে গিয়েছিল, তুই বেরিয়ে আয়। মিথ্যা বলার জায়গা পাস না, তাই না? আজ হতচ্ছাড়ার পিঠে বেত ভাঙব। বন্ধুত্ব ফলাতে এসেছ?’ তাহমিদ ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল। স্যার বেতটাকে হাতের কাছে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, ‘আর মিথ্যা বলবি?’ তাহমিদ প্রাণপণে মাথা নেড়ে বলল,‘না স্যার।’ তাহমিদ স্বীকার করে ফেলায় স্যার দু ঘা বেতের বাড়ি দিয়েই তাকে ছেড়ে দিলেন। এবার স্যার আবার রাহাতকে চোখ লাল করে জিজ্ঞেস করলেন ‘তুই বৃহস্পতিবার স্কুল পালিয়েছিলি কেন?’ রাহাত এবার হাল ছেড়ে দিল। সত্য না বললে এবার আর বাঁচতে পারবে না।
‘স্যার বৃহস্পতিবারে পালাই নাই। বুধবারে পালিয়েছিলাম’ রাহাতের অকপট স্বীকারোক্তি শুনে স্যার হেসে ফেললেন। ততক্ষণে সারা ক্লাস তাদেরকে দেখছে। স্যার সারা ক্লাসের উদ্দেশে বললেন, ‘তোরা দেখছিস ও কিন্তু অপরাধ করে স্বীকার করে নিয়েছে।’
সারা ক্লাসে মৃদু এক ধরনের উল্লাসধ্বনি বয়ে গেল। তারা কেউই ক্লাসে এরকম নাটক দেখেনি। স্যার আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাহাত খান, তুমি আমাকে দেখে পিটিআই স্কুলের ভেতর হাইড এন্ড সিক কেন খেলছিলে?’
রাহাত হেসে ফেলল। বিপদ কেটে গিয়েছে। হাসি থামিয়ে বলল, ‘স্যার ইয়ে ওটা আমার আগের স্কুল’ স্যার হাসিমুখে বললেন ‘তাই আমাকে দেখে সেখানে লুকিয়ে গিয়েছিলি?’
রাহাত মাথা নাড়ল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, স্যারের স্ত্রী পিটিআই স্কুলের শিক্ষিকা। স্যারকে সে কথা বলতেই স্যার লজ্জামাখা হাসি দিলেন। বললেন, ‘আমি সেখানে গিয়েছিলাম আমার ছোট মেয়েকে আনতে। রাস্তায় হঠাৎ দেখলাম তোকে’। রাহাতের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে স্যার স্নেহমাখা গলায় বললেন, ‘আর স্কুল পালাবি না, বুঝলি?
রাহাত মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতোমরা অমর
পরবর্তী নিবন্ধ২নং জালালাবাদ ওয়ার্ডে অগ্নিদুর্গতদের ত্রাণ বিতরণ