গৃহী সন্ন্যাসী, সাধক কবীর দাস প্রাচীন ভারতের একজন মরমী কবি। কবীরের বাণী, গান মৌখিক পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে সময়কে অতিক্রম করেছে, ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দিকে। কবীর দাস ধর্মকে কোন নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বাঁধতে চাননি। তিনি তাঁর কবিতায়, গানে ছড়িয়েছেন মানবতার কথা, প্রেমের কথা। বর্ণবৈষম্য, ধর্মের বিভেদকে তিনি সমালোচনা করেছেন।
দ্বাদশ শতাব্দীর কবি কবীর দাসের দর্শন, তাঁর কবিতা পরবর্তীতে ভক্তি আন্দোলনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। যদিও কবীর মানবপ্রেমের গান গেয়েছেন, গেয়েছেন জীবনের গান। তাঁর গান, কবিতা পরবর্তীতে মরমিবাদ, সুফিবাদ ধারায় যুক্ত করা হয়।
শবনম ভিরমানী, ভারতীয় তথ্যচিত্র নির্মাতা ও সুফি গায়ক, ২০০২ সালে কবীর দাসকে নিয়ে শুরু করেন ‘দ্য কবীর প্রজেক্ট।’ কবীরের মরমীবাদ, তাঁর দর্শন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শবনম প্রবেশ করেন এর গভীরে, তৈরি করেন একের পর এক তথ্যচিত্র। কবীরের উপর শবনম চার চারটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন।
ভারানসীর এক মুসলিম দরিদ্র তাঁতি পরিবারে জন্ম গ্রহণকারী কবীর দাসের ধর্ম পরিচয় নিয়ে আছে বিতর্ক। অনেকে মনে করেন তিনি হিন্দু ছিলেন যদিও কবীর নিজেকে হিন্দু, মুসলমান ধর্ম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে রেখেছেন। তিনি তাঁর কবিতায় যেমন ধর্মে বিদ্যমান পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সমালোচনা করেছেন তেমনি উচ্চবর্ণ নিম্ন বর্ণের ভেদাভেদের সমালোচনা করেছেন। তাঁর এই দর্শন নিয়ে কাজ করেন সাংবাদিকতা দিয়ে জীবন শুরু করা শবনম ভিরমানী।
পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণকারী শবনম ভিরমানী পড়াশোনা করেন সাংবাদিকতা নিয়ে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় কাজ করার সময় জয়পুরের রূপকুমার কানয়ারের সাতি নিয়ে আর্টিকেল লিখে তিনি একটা তোলপাড় করে দেন। এই আর্টিকেলের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে এক মুভমেন্ট। পরবর্তীতে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ফিল্ম মেকিং শুরু করেন। তাঁর নির্মিত তথ্যচিত্র বিভিন্ন পুরস্কার জিতে নেয়। ২০০২ সালে তিনি কবীর দাস প্রজেক্ট শুরু করেন এবং এই তথ্যচিত্র নির্মাণ তাঁর জীবন পাল্টে দেয়। তিনি ভক্তিবাদ, সুফিবাদ আর মরমীবাদ নিয়ে কাজে মনোনিবেশ করেন।
শবনম ভিরমানী ভারতের বেঙ্গালরে অবস্থিত সৃষ্টি আর্ট, ডিজাইন এবং টেকনোলোজি ইন্সটিটিউটের একজন অধ্যাপক এবং সেখান থেকেই ‘দ্য কবীর প্রজেক্ট’ শুরু। সেখানেই তিনি বিপুল রিখিকে পান যিনি কবীরের কবিতা অনুবাদ এবং কবীরের বিভিন্ন কাজ সংগ্রহ ও সংকলন করেন। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে তাঁরা কেবল কবীরের গান, কবিতা নয় সাথে অন্যান্য সুফি, সাধক, মরমী বাউলদের কাজেরও আধ্যাত্মিক ও সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার একটা সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন।
শিল্পী শবনম ভিরমানী নিজেও বিভিন্ন জায়গায়, দেশে- বিদেশে কবীরের গান গেয়ে, তাঁর মর্মবাণী প্রচার করেন। যখন থেকে কবীর প্রজেক্ট শুরু করেছেন তখন থেকেই শবনম কবীরের দর্শন সাথে অন্যান্য মরমী কবিদের মুখে মুখে প্রচলিত যে ঐতিহ্য তা আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। এই ধারার কবিতা, গানে যে প্রজ্ঞা তার প্রতি মুগ্ধতা শবনমকে তথ্যচিত্রটিকে একটা দারুণ শেইপ প্রদানে সাহায্য করে। এর ডিজিটাল আর্কাইভ, গান, পারফর্মিং, অনুবাদ, কিউরেশন সব মিলিয়ে শবনম ভিরমানী ‘দ্য কবীর প্রজেক্ট’ দারুণভাবে উপস্থাপন করে। বিভিন্ন নাগরিক অনুষ্ঠান, আঞ্চলিক যাত্রায় কবীরের কাজগুলো তুলে ধরা হয় সাথে অতি সমপ্রতি যোগ হয়েছে ছাত্রদের মরমী ও সুফি কবিতার চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে তাদের এর দ্বারা আক্রান্ত করার পন্থা।
শবনম তথ্যচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি লিঙ্গ ইস্যুতেও কাজ করেন। তিনি সাংবাদিকতা, রেডিও এবং ভিডিও মাধ্যমে এই কাজগুলো পরিচালনা করেন, উপস্থিত থাকেন বিভিন্ন সভা সেমিনারে।