দৈনিক আজাদী চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক

মৃণালিনী চক্রবর্তী

| সোমবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামকে বিশ্বমাঝে তার রূপ কলা ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন দৈনিক আজাদী। এই পত্রিকার ভাণ্ডারালয়ে আছে লোক সংস্কৃতির ভাবগাথা ঐতিহ্য, কবি সাহিত্যিকদের বিস্তৃত সৃষ্টির অরণ্য, গবেষকদের গবেষণার তথ্য ভাণ্ডারের সমৃদ্ধ তত্ত্বনন্দন, শিল্পীদের শিল্পত্ত্বের বৈচিত্র্য বিচরণভূমি, যুদ্ধ ও স্বাধীনতার গর্বিত ইতিহাস বীরত্বের জয়ধ্বজা জয়গান, বিজ্ঞানী পাণ্ডিত্য মনীষীদের ভাবধারার অববাহিকার স্রোত, ক্রীড়ামোদীদের উদ্দীপনার রস উদগম, শিক্ষা ধর্ম রাজনীতির শুদ্ধ চর্চার সাতকাহন, ঋতুর রঙে বোনা প্রকৃতি জীববৈচিত্র্য, দিনাতিপাত জীবনের প্রেম বিরহ, জীবন মৃত্যু ও সুখ দুঃখের প্রাচীন ও আজির কিসসা কাহিনী, কবিতা গল্প ছড়া ছড়িয়ে দেয় তার বিস্তীর্ণ ভূমিতে বসন্তের দোলা।
এতো রঙ রূপ বর্ণাঢ্য বর্ণিল আজাদী প্রতিদিন সকালে উম্মুখীর স্বস্তি। এই ব্যস্ততম জীবনে অনেকের কাছে প্রথম শিক্ষা প্রেরণা নিয়ন্ত্রণের মুক্ত আলোর রশ্মি। আজাদীর অনেক দায়বদ্ধতা। সে অনেক সাংবাদিক তৈরি করেছে, জীবন ও জীবিকায় ভূমিকা পালন করেছে, অনেক সুপ্ত প্রতিভাকে লুপ্ত থেকে উদ্ধার করে জীবন দান করেছে। নিজেও পূর্ণতা পেল চট্টগ্রামকে সমৃদ্ধ করে তুললো। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইতিহাসের পাতায় নানা ভাবে ব কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করে তুললো।
কত কবি সাহিত্যিকদের বিচরণ ক্ষেত্র, সোনালী মাঠ এই আজাদী। শুরু থেকে আজও অবধি প্রেরণা ও সমপ্রীতির বন্ধনে সে চট্টলা ও মানুষের হৃদকোঠায় সুপরিচিত ও প্রীতিময়। আমার আমিত্ব তার ভালোবাসায় সৃষ্ট।
তার অঙ্গসজ্জায় মহিলা মহফিলের সারথি ছিলাম আমি। আমি চিরকৃতজ্ঞ। আজাদীর প্রয়াত সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত, ওবায়দুল হক, মানবেন্দ্র বড়ুয়া। তাদের উৎসাহ প্রেরণা প্রতি সপ্তাহে লেখা জমা দিতে হবে। এভাবে এক একজন নারীকে লেখক হওয়ার পথ উন্মোচন করার প্রয়াস ঘটিয়েছেন তারা। আজও সেই হালের পথিকৃৎ হিসেবে দৃষ্টান্ত দেখিয়ে চলেছেন বর্তমানের কর্ণধাররা। আজাদীর প্রায় প্রতিটি সাংবাদিক চট্টগ্রামের ঐতিহ্য লেখক। শুধু তাই নয় অনেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন দেশে শুধু নয় দেশের বাইরেও। এটা আজাদীর সৃষ্ট নান্দনিক বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব।
কতগুলো পাতায় গাছটি মহীরুহ সমৃদ্ধ। ‘আগামীদের আসর’ ছোটদের আনন্দালোকন। ‘মহিলা মাহফিল’ বর্তমানে নাম ‘নারী’। নারীদের মনের কথা ও সৃষ্টির ঐতিহ্যের কথোপকথনের আঙিনা। ‘সাহিত্যের পাতা’ সাহিত্যিকদের সৃষ্টি রসের উজ্জীবনের শক্তি। ‘আনন্দন’ শিল্পী সমাজ ও সংস্কৃতির পর্যালোচনা ক্ষেত্র। তেমনি খেলার পাতা, সম্পাদকীয়, প্রতিদিন, সংবাদ ইত্যাদি নামকরণে পাতাগুলো গুচ্ছ খবরে স্ববৈশিষ্ট্যে মানুষের মনে সমাদৃত ও প্রিয়। বেশ কিছুদিন পর পরিবর্তনের স্বাদে পাতার নামকরণে পরিবর্তন এক আকর্ষণের অন্যমাত্রা।
৭০ এর দশকে দৈনিক আজাদী আগামীদের আসর থেকে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছেন। এই পদক্ষেপ দৈনিক আজাদী এই সময়ের সমাজে খবর তৈরি ও শিশুর মনন বিকাশে সংস্কৃতির লালন পালনে শিশু ও যুবক সমাজকে আলোড়িত ও আলোকিত করেছে। আমি ও একটি বিষয়ে অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করে গর্বিত হয়েছি।
আজাদী অকুণ্ঠ চিত্তে মানুষের অধিকার, অন্যায় বঞ্চনার প্রতিবাদ, মানবতার কথা বলে। সে সপ্তাহের প্রতিদিন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি চাহিদা ভোগ বন্টন বিনিয়োগ সঞ্চয় প্রভৃতি বিষয়গুলো তথ্য ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে। মৌলিক চাহিদার সম্পূরক ভাষার জাগরণ তোলে নেতৃত্বের ছায়ায়।
আজাদী স্বাধীন বাংলাদেশের ও যুদ্ধ ঘটনাচক্রের নিভৃত দলিল। এর আগে ইতিহাসের পাতার রেকর্ড কেউ রচনা করতে পারেনি। দেশমাতৃকার মুক্তির ও ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধু এই শুদ্ধ গুণগান আগেই লেখকদের কলমের ধারের লেখনী আজাদী বাহকের ভূমিকায় পালন করেছে। দেশের সামপ্রতিক ও অতীতের ভূমিকার মূল্যায়ন জনগণ ও বিশ্ববাসীর, ছাত্রসমাজের মধ্যে স্বচ্ছ জ্ঞানুধ্যায় আজাদী মেলবন্ধনে রচনা করেন। দেশের উন্নয়ন অনুন্নয়ন, দেশের মাইলফলক দৃষ্টান্ত অকপটে সে জনসমুদ্রে আলোড়ন তৈরি করে চলে।
সে আলোকবর্তিকা চৈতন্য মাধ্যমের প্রথম শিখা। সকালের সুপ্রভাত জানানোর ভোরের পাখি। আজাদী শুভ কল্যাণকর, বংশপরম্পরায় প্রোথিত গ্রথিত চট্টগ্রামের এক বটবৃক্ষের নাম। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের সুচিন্তিত স্বদেশের মায়ায় পোতা চট্টগ্রামের প্রথম দৈনিক পত্রিকার শেকড় আজ সগৌরবে বিশ্ব সভায়। ঐ শেকড়ের হাতটি ধরে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, এম,এ, মালেক, ওয়াহিদ মালেক, শিহাব মালেক উত্তরোত্তর সাফল্য ও সমৃদ্ধ হচ্ছে।
আজাদী শুধু সংস্কৃতি বিজ্ঞান পরিবেশ স্বাস্থ্য সেবা উৎপাদন উন্নয়ন শিল্পকলা সাহিত্যের বিষয় নয়। সামাজিক আন্দোলন রাষ্ট্রীয় আন্দোলন কর্মকাণ্ডে জনমত গঠনেও সমাধানে কার্যকর ও সার্থক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাঙালি সংস্কৃতি লালনে বাঙালির অস্তিত্ব ঐতিহ্য রক্ষায় বর্ষবিদায় নববর্ষবরণ কার্যক্রমের উদার বর্ণিল আয়োজনের, বাঙালির উন্নত শির বিশ্বসভায় আলোকজ্জ্বল করে প্রচারণায় পৃষ্ঠপোষকতায় আজাদী গর্বের সাথে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। সামপ্রতিক সি আর বি রক্ষার আন্দোলনে তার ভূমিকা অবদানিক। আর এই বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম, বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে বিশ্বমাঝে আলোকিত করেছে আজাদী। চট্টগ্রামে ‘চট্টগ্রাম একাডেমির’ জন্ম, বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি, স্বাধীনতার বইমেলা, কবিতা উৎসব, ছড়া উৎসব, প্রকাশনা উৎসব, ঋতুভিত্তিক বইমেলা, তাছাড়া চট্টগ্রামে একুশে বইমেলা, নানান সাংস্কৃতিক এসব কর্মকাণ্ড জড়িয়ে। এসব অনুষ্ঠান আরো সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠে আজাদীর পৃষ্ঠপোষকতায়। ছবির রঙিন ক্যানভাসের মূর্ত প্রতীকে। এখানে আঞ্চলিকতায় ভাষা সাহিত্য সমাহারে, লোকগাথা, পুঁথির সংরক্ষণ পাঠ, সমৃদ্ধ চট্টগ্রামে। নব উম্মোচিত হলো আঞ্চলিক ছড়ার কাগজ , পাহাড় নদী ঝর্ণাধারা সমুদ্র, সমুদ্র সৈকত বনাঞ্চল ঘিরে, সবুজ পাখি ফুলেল শোভিত চট্টগ্রামকে আলোকময় ও অগ্রণী ভূমিকায় তুলে ধরে এবং আজও প্রচারণায় আজাদী রাখে মূখ্য ভূমিকা।
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। চট্টগ্রামে প্রথম বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (কালুরঘাট)। বেতার কেন্দ্র, চট্টগ্রাম (আগ্রাবাদ)। বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম। শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, সংস্কৃতি চর্চার ও প্রসারের প্রাণকেন্দ্র। চট্টগ্রামে শুদ্ধ সঙ্গীত প্রসারে উপমহাদেশের প্রথম সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর্য্য সঙ্গীত সমিতি সহ আরও অনেক সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান নিয়ে সংস্কৃতির শিক্ষা ও চর্চার আবর্তনে আবৃত চট্টগ্রাম। তেমনি নৃত্যকলাধারা। আবৃত্তি সংগঠন। নাট্যচর্চার অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান। উৎসবে আনন্দে প্রকাশে বিকাশে চট্টগ্রাম সমৃদ্ধ। এসব ঘিরে আলোর প্রতিভার রশ্মিটি ছড়ায় দৈনিক আজাদী।
এই চট্টগ্রাম স্বাধীনতার সূতিকাগার। বীরকন্যা প্রীতিলতা, বীর মাস্টারদা সূর্যসেন, আরও অনেকের জীবন বলীদানে অবিভক্ত বাংলার স্বাধীনতা এবং ৭১ এর যুদ্ধেও অনেক মুক্তিযোদ্ধার জীবন বলীদানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ফটোগ্রাফি লেখায়, বাংলা ভাষা প্রয়োগে আজাদী দাঁড় করিয়েছে চট্টগ্রামের অবদান ও বাংলার ইতিহাস। দৈনিক আজাদী কর্তৃক প্রকাশিত ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ তত্ত্ব ও তথ্যের সমৃদ্ধ গ্রন্থ। এই গ্রন্থ চট্টগ্রামকে জানার মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিশ্বে মাইলফলক হবেই হবে। আলোকজ্জ্বল হয়ে উঠবে চট্টগ্রাম। তাছাড়া আজাদী বের করেছে আজাদীর ৬০ বছর পূর্তির এক বিশেষ প্রকাশনা। এই ভাবে আজাদী লালন করে চট্টগ্রাম সহ সকল কবি সাহিত্যিকদের। বীর চট্টগ্রামের, দৈনিক আজাদী, বীরত্বগাথা সকল মানুষের, শ্রমজীবী শিক্ষাজীবী, পেশাজীবীদের ভালোবাসার উঠোন।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক, লতিফা সিদ্দিকী ডিগ্রি কলেজ; প্রাবন্ধিক, সংগীত শিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদীর জন্য ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধশিশু কেন মারাত্মক অপুষ্টির কবলে পড়ে