গুটেনবার্গের প্রিন্টিং প্রেসের আবিষ্কার, মানব সভ্যতায় আগুনের আবিষ্কারের চেয়ে কম প্রভাবের নয়। আমাদের সমাজের সমস্ত লক্ষণগুলোর উদ্ভব ও পরিবর্তন, আগুনের আবিষ্কারের ফল। এমনকি যে পরিবার-সমাজের একক, তার উদ্ভবও ঘটতোনা আগুনের ব্যবহার না জানলে। প্রযুক্তির উদ্ভব ও পরিবর্তন, আগুনের ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। আগুনের ব্যবহার না জানলে, মাংস, সবজি রান্না করে খেতে পারতাম? আগুন ও তার তাপ, আমাদের প্রকৃতি ও মানুষের সমাজের অস্তিত্বের এক বড় শর্ত। আমরা গভীর ভাবে চিন্তা করিনা বলে, এ ধারণা বোধে আসেনা। আমাদের এ বোধেও সহজে আসেনা যে, আমরা কখনোই উৎপাদন ও বণ্টনের অর্থনীতিক সমাজ তৈরি করতে পারতামনা যদি, আগুনের ব্যবহার না জানতাম। কিন্তু আগুনের সাথে অর্থনৈতিক সমাজ তৈরির আরেক বড় শর্ত ছিলো, যোগাযোগ ও এর উপায় ভাষা।
উৎপাদনের উপায় যদি হয়, জমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগঠন তাহলে সংগঠন, পুঁজি কখনোই গড়ে উঠেনা, মানুষে-মানুষে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা না পেলে। আর এই যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা পায়, ভাষায়। ভাষাহীন সমাজ কল্পনার বাইরে। ভাষায় যোগাযোগের জন্য চিহ্ন বা অক্ষর দরকার। অক্ষরের পরে অক্ষর সাজিয়ে, অর্থবহ শব্দ দিয়ে, আমরা অন্যের সাথে ভাব বিনিময় করি। সমাজে রীতি-নীতি, নর্ম, মূল্যবোধ, আইন-কানুন ভাষা ছাড়া অস্তিত্বহীন। মানুষে-মানুষে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ও সংহতি রক্ষায় মূল্যবোধ ও আইনী ব্যবস্থার কথা জানি। কিন্তু যা গভীর চিন্তা ছাড়া অনুমান করা যায় না, তা হলো, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যে চিন্তা, ধ্যান-ধারণার বিকাশ তা ভাষার সংরক্ষণের উপর নির্ভরশীল। আমাদের সমাজ কি আজকের প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক সমাজে উপনীত হতো, যদি না জ্ঞান, বিজ্ঞানের চর্চা, উদ্ভাবন ও প্রজন্মান্তরে তার ট্রান্সমিশন না হতো। এই ট্রান্সমিশনের শর্ত হলো, ভাষায় তার ধারণ ও পাথর, গাছের বাকল, প্যাপিরাসে বা কাগজে, ম্যাগনেটিক টেপ এ, হার্ড ডিস্ক, অপটিক্যাল ডিস্ক ইত্যাদিতে সঞ্চিত রাখা। জ্ঞানের সঞ্চয় ও প্রজন্মান্তরে বিতরণের সুযোগ না থাকলে সমাজের পরিবর্তন হতো না। আর এ জন্য যোগাযোগের প্রচারের উপায়ই শুধু নয়, তথ্য বা জ্ঞানের সঞ্চয়ের উপায়ও গুরুত্ববহ।
প্রাচীনকালে জ্ঞান বা চিন্তার সঞ্চয়ের উপায় ছিলো গুহাগাত্র বা পাথর। সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মের নৈতিকতা উৎকীর্ণ করেছিলেন পাথরে। আর তা ভাষায় লিপিবদ্ধ ছিলো। যোগাযোগের এই প্রযুক্তি কখনোই আধুনিক সমাজের ভিত্তি হতে পারে না। যদিও যোগাযোগের এ ও ছিলো ব্রডকাস্ট এর প্রাচীন উপায়। অর্থাৎ এক কেন্দ্র থেকে হাজারো বা লক্ষ জনের কাছে তথ্য পৌঁছানোর প্রক্রিয়া। এর আধুনিক প্রযুক্তিগতরূপ হলো, পত্রিকা, রেডিও এবং টেলিভিশন। পত্রিকা কখনোই তথ্য প্রচারের উপায় হতো না প্রিন্ট বা ছাপানোর প্রযুক্তি বা প্রিন্টিং প্রেস এর আবিষ্কার যদি না হতো। গুটেনবার্গ ছাপানোর প্রযুক্তি বা প্রিন্টিং প্রেস এর আবিষ্কারক। এই প্রিন্টিং পদ্ধতিকে যদি বিবেচনা করি, নক্ষত্র বা তারকা, তাহলে এই তারকাকে আবর্তিত করছে গ্রহ ও গ্রহকে উপগ্রহ। আবার নক্ষত্র সমূহের সমাহার তৈরি করে গ্যালাক্সি। আমাদের সৌর জগৎ মিল্কী ওয়ের অংশ। প্রিন্টিং প্রেসের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে, বিশ্ববিখ্যাত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাকলুহান পুরো সমাজের তথ্য নির্ভরতাকে গ্যালাক্সীর সাথে তুলনা করেছেন। গ্যালাক্সি যেমন হাজারো নক্ষত্রের সমাহার, নক্ষত্র যেমন গ্রহ, উপগ্রহের নিয়ন্ত্রক, আমাদের সামাজিক বন্ধনটাও তেমনি, তবে এর উপায় হলো প্রিন্টিং প্রেস বা আজকের ধারণায় প্রিন্টিং মিডিয়া। প্রিন্টিং মিডিয়ার কারণে, রাজনৈতিক আদর্শ খুব অল্প সময়ে বিস্তৃত ভৌগলিক সীমা অতিক্রম করতে পেরেছে। বলা হয়, পবিত্র বাইবেল মুদ্রণ করে প্রচার করতে পারায়, ইউরোপে খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য হয়েছে। পৃথিবীর কাঁপানো সমস্ত আদর্শগুলো আসলেই প্রিন্টিং মিডিয়ার ফল। মার্কসের রচনার একটা বড় অংশ প্রকাশিত হয় ‘নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন’ এ। দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকাগুলো শুধু তথ্য সংগ্রহ নয়, তার প্রচারেও বিশাল ভূমিকা রেখেছে। সমাজের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিফলন ও মোটিভেশনের কারণে পত্রিকাকে ‘সমাজ দর্পণ’ বলা হয়। আয়নায় নিজেকে দেখি বলেই নিজের অস্তিত্ব জানা যায়। নিজেকে পরিচ্ছন্ন করায়, আয়নার যে ভূমিকা, সমাজের সম্পর্কে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পত্রিকাও সে ভূমিকা পালন করে। পত্রিকা না থাকলে গ্লোবালাইজেশন অচল।
সমাজ আর অর্থনীতি বদলের সাথে সাথে পত্রিকার চেহারাও বদল হয়েছে। পত্রিকা এখন ইলেকট্রনিক ফরম্যাটে বেরুচ্ছে। আগে পত্রিকায়, সংবাদের ফিডব্যাক পাওয়া যেত না। এখন অনলাইনে ভার্সনে, ফিডব্যাক পাওয়া যায়। পত্রিকা আগে ছিলো অনেকটা স্থানিক, এখন অনলাইনে ভার্সনের কারণে আন্তর্জাতিক। পত্রিকার এমন বিবর্তনের শুরু, গুটেনবার্গের প্রিন্টিং প্রেসের আবিষ্কারের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি আর সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে দৈনিক আজাদীর ভূমিকা অনন্য। ‘কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস’ যেন গুটেনবার্গের মতো ‘দৈনিক আজাদী’ নামের এক নক্ষত্রমণ্ডল তৈরি করেছে। নক্ষত্রমণ্ডলে কোনো নক্ষত্র হারিয়ে গেলেও যেমন তার আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় অনেক পরে, আলো থাকে দীপ্তমান, আজাদীও অনেকটা তেমন। আজাদীতে ছিলেন অনেক গুণী সাংবাদিক। শ্রী সাধন কুমার ধর, অরুণ দাশগুপ্ত, জনাব ওবায়দুল হক, সিদ্দিক আহমেদ, আরো অনেকেই। ঐতিহাসিক, গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক আব্দুল হক চৌধুরীর প্রতিষ্ঠায়, আজাদীর অনন্য ভূমিকা ছিলো। তাঁর একুশে পদক প্রাপ্তি, আজাদীকে করে কৃতিত্বে উদ্ভাসিত। শুধু গুণী হলেই চলে না, তার প্রকাশ হতে হয়। আজাদী এ কাজটি করেছে সার্থকভাবে।
এই নক্ষত্রমণ্ডলে সর্বশেষ সংযোজন দৈনিক আজাদীর সম্পাদক জনাব এম এ মালেক-এর একুশে পদক অর্জন। এর আগে প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার, সহযোগী সম্পাদক জনাব রাশেদ রউফ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। শ্রী অরুণ দাশগুপ্ত পেয়েছিলেন চটগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সাহিত্য পুরস্কার। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ খালেক প্রতিষ্ঠিত এই গ্যালাক্সির নক্ষত্ররা আপন গুণে দেদীপ্যমান। প্রমিথিয়ুস স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে, মানুষের সভ্যতার সূচনার যে গল্প গ্রীক পুরাণে বর্ণিত আছে, তার চেয়েও ঢের বেশি করেছেন গুটেনবার্গ, প্রিন্টিং প্রেসের আবিষ্কার করে। চিন্তা করুনতো, প্রিন্টিং প্রক্রিয়া আর প্রযুক্তি মানুষ ভুলে গেলো, সভ্যতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
গ্যালাক্সিতে অনেক সৌরমণ্ডল আছে। প্রিন্টিং মিডিয়ার এক মণ্ডল, আজাদী। চট্টগ্রামের সমাজ, সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশে আজাদী- দৈনিক আজাদী’র ভূমিকা অনন্য।
লেখক : সমাজবিজ্ঞানী, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।