দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৮ জুলাই, ২০২১ at ৬:৫৭ পূর্বাহ্ণ

‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’
এরই মধ্যে স্নানঘর থেকে অভ্র বেরিয়ে আসায়, সস্তার সেই পঞ্চ দশাটি আমার দীর্ঘায়িত না করে লাজুর যাবতীয় মনোযোগ চলে গেল পুত্রদের দিকে। অভ্রকে হাতে ধরে, সোফার দিকে টেনে নিয়ে যেতেই বুঝলাম চলবে এখন ক্রিম লোশন সহযোগে ওর শরীরের দলাই মলাই পরিচর্যা, যে গুলো পরিপাটী করে সাজিয়ে রাখা আছে এরই মধ্যে জানালার কাছে পেতে রাখা সোফার পাশটেবিলে। ছোটপুত্রকে নিয়ে ঐদিকে যেতে যেতে অবশ্য এরই মধ্যে দীপ্রর উদ্দেশ্যে জারী করা হয়েছে ৯ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত, যেন সে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসে স্নানঘর থেকে । সুবর্ণ এই সুযোগের এই ফাঁকতালে বললাম যাচ্ছি ফের নিচে, রেস্টুরেন্টগুলো দেখে আসতে। ফিরে এসে তোমাদের নিয়ে যাব ওইখানে । বলেই নিজেদের রুম থেকে বেরিয়ে, অন্যরুমের দিকে গিয়ে বেল বাজাতেই হেলেন দরজা খুলতেই, দিলাম তাকে আমার খাদ্যাভিজানযাত্রার ব্যর্থতার বার্তা। চোখ কপালে তুলে হেলেন বলল “এখন কি হবে তাহলে?”
ওর কথার ভাবে মনে হল, ঘটনা বুঝি এমন যেন এ শহরের আদি বসিন্দা পিকিং মানবরা যেমন খাদ্যান্বেষনে বেরিয়ে কোন কোন দিন সারা দিনেও খাদ্যের খোঁজ না পেয়ে কাটাত অভুক্ত নিশা, তেমনি বুঝি হবে আজ রাতে আমাদের অবস্থা! ওর এরকম ভাবের কি কারণ? তার সুলুক সন্ধানে আর সময় ব্যয় না করে ঘুরে লিফটমুখি হাঁটা দেবার আগে শুধু বললাম, এখন এই হোটেলের রেস্টুরেন্টেই খাওয়া হবে।
এবারেও এদের লিফট সার্ভিস তার মানসম্মান বজায় রেখে, দ্রুতই সসম্মানে আমাকে নিচে নিয়ে আসতেই, লিফট থেকে বেরিয়ে ডানে মোচড় দিয়ে চলে এলাম চমৎকার আলোআঁধারিতে ঢাকা বার সংলগ্ন সেই রেস্টুরেন্টটির দিকে, আর ভাবছি মনে মনে যদি থাকে ওইখানে আজ আন্তর্জাতিক খাবারের স্বেচ্ছা নির্বাচনের পসরা মানে ইন্টারন্যশনাল বুফে ডিনারের ব্যবস্থা, তবে যেন অন্তত চারজনের হলেও একটা টেবিল যেন ফাঁকা পাই। বাড়তি একটা চেয়ার টেনে ওটাতেই বসে যেতে পারব পাঁচজন।
নাহ, পিকিং মানবের দেশে প্রথম পা রেখে প্রথম দিনেই দেখছি অভিজ্ঞতা সেরকমই অনিশ্চিত হতে যাচ্ছে। প্লেন থেকে নামার পর দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ পাইনি জলের খোঁজ! তারপর ব্যর্থ হল আমার খাদ্যাভিজান যাত্রা। আর এখন? না এই রেস্টুরেন্টে খাবার নাই, তা বলছি না। বলছি এর বাইরের করিডোরে পেতে রাখা চেয়ার আর সোফাগুলোতে অপেক্ষমাণ লোকজন দেখে বুঝলাম ভেতরের অবস্থা হলো “ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই”।
এছাড়া ঐ জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরের যতোটা দেখা যায়, তার আবহ দেখে ধারণা করলাম যে আজ অন্তত এখানে কোন বুফে ডিনারের ব্যবস্থা নাই। খেতে হবে আ লা কার্তে । যার মানে এখানে লাইন ধরে যদি ভেতরে জায়গাও করে নিতে পারি আধা বা এক ঘণ্টার মধ্যেও, তারপরও আরো কমপক্ষে আধা ঘণ্টা বা একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে টেবিলে খাবার পৌঁছুনর। এছাড়া আমি এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে, বাকীদের খবর দেব কিভাবে ? নিজের ফোনে দাপ্তরিক প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক রোমিং সুবিধা থাকলেও, লাজু বা হেলেনের ফোনে তো কোন চায়নিজ সিমও ঢোকানো হয় নি এ কয়দিনে। অতএব লাইন ধরতে হলেও ওদেরকে নিয়ে আসার জন্য ফের উঠতে হবে উপরে। আর আমি গেলেই যে তারা সবাই, সাথে সাথে লেফট রাইট করতে করতে নেমে আসবে তাও তো নয়। আবার আমি যাওয়ার পর পরই, যদি আরো লোকজন এসে লাইনে দাঁড়ায় টেবিল পাওয়ার জন্য তাহলে তো ঝক্কি বাড়বে আরো। যার মানে হল এখানে খাওয়া মানে কমপক্ষে দু ঘণ্টার মামলা, তাও যদি কপালগুণে পাওয়া যায় জায়গা ভেতরে!
কিন্তু এতো অপেক্ষা তো কারো এ মুহূর্তে সইবে না। আবার অতোক্ষণ এই রেস্টুরেন্ট খোলা যে রাখবে তারও তো কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সুতরাং এখানে অনর্থক অপেক্ষায় সময় খুইয়ে লাভ নেই; ভেবেই হাঁটা ধরলাম ফের লিফটের দিকে, কারণ একটু আগে উপর থেকে নামার সময় তার দেয়ালে সাঁটানো ছোট্ট একটা চমৎকার বিলবোর্ডের ছবি আর লেখায় সম্ভবত দেখেছিলাম যে এ হোটেলের চারতলায় একটা, ছয়তলায় একটা করে আরো মোট দুটো স্পেশালাইজড রেস্টুরেন্ট আছে, যার একটা হল ইটালিয়ান। আরেকটা যে কি দেখেছিলাম তা মনে নাই। কেন মনে নাই তাও বলতে পারছি না। অথচ দুটোই তো দেখেছিলাম। আর কোনটা যে কয় তলায় আছে, তাও মনে করতে পারছি না। নাহ, মাথা আমার গেছে এক্কেবারে ! এদিকে ততোক্ষণে লিফট লবিতে এসে আবারো উপরে উঠার জন্য বোতাম টিপতেই, বাঁয়ের লিফটটা খুলে যেতেই, ভেতরে ঢুকেই সেই বিলবোর্ডে নজর ফেলেই হদিস পেলাম যে, ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টটাতে যেতে চাপতে হবে চার নম্বর বোতাম। ঐটি টিপে, বিলবোর্ডে ফের নজর দিলাম বাকী রেস্টুরেন্টটা কোন তলায় আছে তার হদিস আর সেটা কোন ধরনের বিশেষ রেস্টুরেন্ট তা জানার জন্য।
হ্যাঁ, আছে ওটা ছয় তলায়। ওটা হলো চায়নিজ সিচুয়ান ধারার রেস্তোরাঁ। এদিকে লাজু আর হেলেনের কথা মনে রেখে, আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম চায়নায় এসে আর যেই রেস্টুরেন্টেই ঢুকি না কেন, চায়নিজ রেস্তোরাঁয় ঢোকা যাবে না। কারণ তাদের আতঙ্ক আমরা যাই অর্ডার দেই না কেন, এরা তাতে ইচ্ছে করে না হলেও ভুলেভালে পোকামাকড় বা ব্যাং টিকটিকি যদি দিয়ে দেয়! এখন বুঝলাম একটু আগে নামার সময় যদিও দুটো রেস্টুরেন্টের নামই দেখেছিলাম এবং পড়েওছিলাম মনের অজান্তেই, তারপরও অবচেতন মন কেন শুধু মনে রেখেছে শুধুমাত্র ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টের খবর, বাকিটা মুছে দিয়েছে মনের স্লেট থেকে !
চার তলায় পৌঁছে লিফট থেকে নেমে সামনের দেয়ালের তীর চিহ্ন মোতাবেক লিফট লবি থেকে বাঁয়ে গিয়ে ফের বাঁয়ে থাকা লম্বা করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, এখানে আসতে পারলে নিশ্চয়ই পুত্ররা খুবই আনন্দিত হবে । আর বাকী দু’জন অতো আনন্দিত না হলেও পিঁজা খেতে তাদের খুব একটা আপত্তি থাকবে না । নাহ , নিচের ঐ আন্তর্জাতিকে জায়গা না পেয়ে আখেরে ভালই হল। কিন্তু হায়! করিডোরে মাঝামাঝি আসতেই দেখি, একটা স্ট্যান্ডে পোস্টার সাইজের একটা বিল বোর্ডে পরিষ্কার করে ইংরেজিতে লেখা আছে “উই আর ফুল” যে দেখে আমি নিজে হয়ে গেলাম ফুল! অবশ্য নীচে আশার বাণীও আছে ছোট করে লেখা, যা হলো ওখানে টেবিল বুক করতে, কতো নম্বরে ফোন করতে হবে , সেই নম্বর!
থ মেরে দাঁড়িয়ে ভাবছি এ কি অবস্থা! এখানেও দেখছি কবি গুরুর সেই “ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই” অবস্থা! কবিগুরু যত দার্শনিক ভাবই প্রকাশ করে থাকুন না কেন ঐ কথায় আর সোনারতরী কবিতায়; আমার কিন্তু এই পিকিংমানবের দেশে খাবারের হদিস করতে গিয়ে হতাশ হয়েই মনে পড়ছে সেই কবিতা। কেন যে এমন হচ্ছে? এ নির্বোধ সেই কবিতা কবে পড়েছিল তা মনে নাই, অথচ এখন কি না এরকম একটা নিতান্তই তুচ্ছ জাগতিক কারণে কি না, মগজে রিন রিন করে বাজছে গুরুর সেই গুরুতর কবিতার চরণ! একেই কি বলে তবে বানরের গলায় মুক্তার হার? হে কবিগুরু, এই বেল্লিক অধমেরে ক্ষমা করবেন। কবির উদ্দেশ্যে জোড়হস্ত ক্ষমা চেয়ে ঘুরে হাঁটা ধরলাম ফের লিফটেরই দিকে!
কিন্তু এখন করবোটা কী? রাস্তাঘাটে লোকজন যেহেতু দেখি নাই, আর আশেপাশেও যেহেতু দেখি নাই কোন রেস্টুরেন্ট , সে জন্যই কি এ তল্লাটের যাবতীয় লোকজন এসে ভিড় জমিয়েছে এই হোটেলের রেস্তোরাঁয়? না কি এই হোটেলের মুসাফিরেরাই সব গেড়েছে আসন এখানে, আশেপাশে কোন রেস্টুরেন্ট খোলা না পেয়ে। না কি আজ কোন বিশেষ দিন এখানকার তাই চলছে কোন পার্টিফার্টি? যার ফলে এই অবস্থা?এমুহূর্তে অবশ্য এসব কারণের কোনটা ঠিক তা নিয়ে গবেষণা করে কোন কাজ নেই। কারণ যা ই হোক, তাতে আমাদের ভাগ্যে খাবার তো জুটবে না। মোদ্দা কথা হল রাতের খাওয়ার জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা নিতে হবে। দরকার হলে নিচে গিয়ে সেই কন্সিয়ার্জ ডেস্ক থেকে খবর নিয়ে, সে মোতাবেক গাড়ি ডেকে সবাই যেতে হবে দূরে, দূরে কোথাও; যদিও সে ব্যাপারে আগেই আপত্তি জানিয়ে রেখেছেন দলের জেনানা মহল।
লিফটে উঠে, রুমে যাওয়ার জন্য বোতাম টিপে কপাল কুঁচকে ভাবছি কি করে দেয়া যায় এই দুঃসংবাদ এই হিমরাতে, বাকীদের কাছে? ঠিক তখনই চট করে মনে হল, আরে বাইরে যেতে হবে কেন? এসব হোটেলে তো ২৪/৭ রুমসার্ভিস থাকার কথা। এ মনে হতেই অনেকটা ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতোই স্বস্তি পেলাম দেহে মনে । যদিও সাথেসাথেই মনে হল রুম সার্ভিসের মেনু তে তো তেমন বেশি আইটেম থাকে না । আর আইটেম কম থাকায় তাতে যদি মন মতো আইটেম না থাকে, সবার তবে তো গাই গুই শুনতে হবে। তার উপর লাজু নিশ্চিত বলবে বাসের জানালা থেকে রাস্তায় ভুল করে দেখা ভারতীয় রেস্টুরেন্টটি খুঁজতে যাওয়াতেই হয়েছে এ বিপত্তি। মানে যত দোষ দেবার জন্য আমি নন্দঘোষ তো আছিই, সামনে মজুদ। আর কোন স্ত্রীই বা কবে এরকম নন্দঘোষ সামনে থাকতে কোন দোষ তার ঘাড়েই তুলে দেয়নি? কিন্তু কি আর করা। দোষ চাপাক কিম্বা এরকম খবরে মহা আনন্দিত হয়ে আমাকে কাঁধে নিয়ে ধেই ধেই আনন্দে নাচুক, তাতে কি আর অবস্থার হের ফের হবে? আমার কাছে তো আর আলাদীনের চেরাগ নাই ও আবার গোপী বাঘার মতো ভূতের রাজার বরও নাই যে এ রাতে এখানে হাজির করবো যার যার পছন্দের খাবার! লিফট থেকে নেমে রুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঠিক করলাম, নাহ কে কি ভাববে; বা বলবে তা নিয়ে এমুহূর্তে চিন্তা করে লাভ নেই। এটা মোটামুটি একটা জরুরি অবস্থা। সবার মতামত নেয়া চলবে না এসময়। সোজা সাফটা রুমে ঢুকেই গম্ভীরভাবে আদেশ জারী করে দেব এই বলে যে, অনিবার্য কারণবশত আজ রাতে রুম সার্ভিসে যে খাবার আছে তার থেকেই কোন এক বা একাধিক ডিশ ঠিক করে নিয়ে অর্ডার করতে হবে এবং সেটাই খেতে হবে । এ নিয়ে সাত পাঁচ অজুহাত বা কারণ দেখিয়ে দুর্বলতা প্রকাশ করা যাবে না। এখন গণতন্ত্র খাঁটবে না।
রুমের দরজায় চাবিকার্ড ছুইয়ে হাতল ধরে ধাক্কা দিয়ে ঢুকতেই রুমের আবহাওয়া আঁচ করে বুঝলাম যে বাথরুম থেকে দেরি করে বের হওয়ার বরাবরের অভ্যাসমাফিক দীপ্র এখনো বের হয়নি স্নানঘর থেকে, তা নিয়ে রুমে আবহাওয়া মোটামুটি গরম। অতএব সেটিকে ঠাণ্ডা করার মানসে ,স্নানঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় ওকে বের হওয়ার তাগাদা দিয়ে, সোফায় গিয়ে বসে, মায়ের দলাই মলাইতে ফিটফাট হয়ে টিভির পর্দায় চোখ রেখে বিছানার মাঝামাঝি জায়গায় বসে থাকা অভ্রকে বললাম, বাবা তোমার ডান পাশের বেডসাইড টেবিলে ঐ যে মোটা ফাইলটা আছে হোটেলের, ঐটা একটু আমাকে দাও তো। “কি হল আবার? রেস্টুরেন্টে যাবো না আমরা?” বিছানার অন্যপাশে স্নানঘরের পর্দা ঢাকা কাঁচের দেয়ালের দিকে মুখ করে দীপ্রকে দলাই মলাই করার জন্য ক্রিম লোশন নিয়ে বসে থাকা লাজুর কিছুটা অবাক প্রশ্ন!
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রস্তাবিত এইচএসসি পরীক্ষায় ঐচ্ছিক বিষয় নিয়ে গভীর উৎকন্ঠায় শিক্ষার্থীরা
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর