দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৪ জুলাই, ২০২১ at ৭:০৪ পূর্বাহ্ণ

সস্তার পাঁচ অবস্থা
নাহ যত দ্রুত ফিরতে পারব বলে মনে করেছিলাম হোটেলে, তা পারিনি। তারপরও এইমাত্র নিজেকে হোটেলের সামনে আবিষ্কার করে, এতোক্ষণ যে হাঁসফাঁস করতে করতে হাঁটছিলাম, তা থেকে আসু মুক্তির আনন্দে হাঁফ ছাড়লাম। হ্যাঁ হাঁফই ছাড়লাম। দোকানটি থেকে বেরিয়ে দ্রুত ফেরার জন্য আশেপাশে তাকিয়ে সময় নষ্ট না করে, সামনের স্থিরলক্ষ রেখে, বেশ দ্রুতই এগুতে শুরু করেছিলাম শুরুতে। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারলাম, দিতে হবে নিজের বোকামির, না বোকামির না বলা উচিৎ লোভের খেসারত!
ব্যাপার হচ্ছে ঐ যে দোকান থেকে জেলিবন,আর টুকটাক বাদাম বিস্কিট নিয়েছিলাম, ওইসময় তো আধা ডজন পানির বোতলও নিয়েছিলাম। ঐগুলো ঝুড়িতে নেয়ার সময় ভাবিনি যে, এগুলো তো আমাকেই বহন করে নিয়ে যেতে হবে। তাই অতিলোভের ফেরে পড়ে, লাভের আশায় নিয়েছিলাম প্রতিটা দেড় লিটারের বোতল! প্লেন থেকে পানি খেয়ে নামার পর, সারাদিন কারো খুবএকটা তৃষ্ণা না পেলেও, সারাক্ষণ জলহীন অবস্থায় থাকার কারণে মনের ভেতরে যে একটা অস্বস্তিজনিত চাপ জমা হয়েছিল, তার কারণে ভুলেই গিয়েছিলাম যে, রুমে ঢুকে রুমে দেয়া পানি সবাই খেয়ে ফেলায় এখন রুমে পানির কমতি থাকলেও, সকালে যখন হোটেলকর্মীরা রুম গোছগাছ করতে আসবে তখন তো তারা আবারও পানি দিয়ে যাবে। আর আগামীকাল রুমে তো আমরা ফিরবো সন্ধ্যায় বা বিকেলে, সেক্ষেত্রে রাতের এই ক’ ঘণ্টার জন্য পাঁচ ছটা আধা লিটারের পানির বোতল নিলেই চলে। কিন্তু তা না করে, কেন জানি প্রথমেই হাত বাড়িয়েছিলাম এক লিটারের বোতল গুলোর দিকে। এবং নিয়েও ছিলাম তার কয়েকটা। কিন্তু হঠাৎই নজর গিয়েছিল পাশেই সাজিয়ে রাখা দেড় লিটার ওজনের পানির বোতলে লাগানো দামের স্টিকারটির দিকে। তাতেই মনে হল আরো এক লিটার বাদ দিয়ে যদি দেড় লিটারের বোতল নেই, তবে তা দামে বেশ সস্তা পরে। কারণ ঐ মাপের বোতলের পানিগুলোতে সেল চলছে , যদিও তা ভিন্ন কোম্পানির। কিন্তু তাতে কি আসে যায়? মাত্র তিরিশ সেন্ট মানে রেন মেন বির হিসাবের তিরিশ সেন্ট বেশি দিলে পাওয়া যায় দেড় লিটারের এক বোতল, যেখানে আধা লিটার বোতল গুলোর দাম হল ব্র্যান্ড ভেদে দেড় থেকে দুই রেন মেন বি! হাতের কাছের এ বিরাট লাভ ছাড়ব কেন? ঝটপট তাই এক লিটারের বোতল গুলো নামিয়ে তুলে নিয়েছিলাম দেড় লিটারের বোতল গুলো! ফলে এই হিমেও গলদঘর্ম হতে হচ্ছে ১০ কেজির বেশি ওজন নিয়ে হাঁটতে গিয়ে।
অতএব বহুল প্রচলিত কথা, সস্তার তিন অবস্থা জানা থাকা সত্ত্বেও, সস্তা দেখে ঐ ছয় ছয়টা বোতল ভর্তি ব্যাগ হাতে নিয়ে এক কিলোমিটারের মতো পথ হাটতে গিয়ে মুখোমুখি হলাম কী না সস্তার চতুর্থ অবস্থায়। হাড়হিম করা এই ঠাণ্ডায় ওজনদার ঐ ব্যাগ টেনে হাঁটতে গিয়ে হাত টন টন করা শুরু করেছিল অচিরেই! তাই কিছুক্ষণ পর পরই সওদাপাতির ব্যাগটিকে করেছি হাত বদল, তারপরও উঠছিলাম হাঁফিয়েও এতোটুকু পথ হাঁটতে গিয়ে। বেশ ক’বারই ওগুলো হাত থেকে রাস্তায় নামিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার তীব্র ইচ্ছা জাগলেও, সে ইচ্ছাকে পাত্তা না দিয়ে, এই তো এসে পড়েছি বলে নিজেকে নিজে প্রবোধ দিয়ে হেঁটেছি সামনে। হাত কে বিশ্রাম দেয়ার জন্য কিছুক্ষণ হেঁটে, ঐ সওদাপাতি ভরা পলিথিন ব্যাগটি পিঠের উপর ফেলে, সামনে থেকে হাত দিয়ে টেনে ধরেও কিছুক্ষণ হেঁটেছি। তবে তাতে যেহেতু মনে হয়েছে এভাবে নিয়ে যাওয়ার কারনে, পলিথিন ব্যাগটার হাতলের উপর বেশি চাপ পড়ার কারণে যদি ছিঁড়ে যায়! তবে তো সব জিনিষ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, গিয়ে বাজবে বারোটার জায়গায় তেরোটা চৌদ্দটা। অতএব দ্রুত পীঠে ব্যাগ বয়ে বেড়ানো বাদ দিয়ে, ওটা হাত বদল করে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে এই বলে সাহস দিয়েছি যে; আরে এভারেস্টে উঠার সময় লোকেরা তো এর চেয়ে ঢের বেশি ওজন নিয়ে ওঠে উপরের দিকে। আর এখানে তো হাঁটছি আমি সমতলভূমিতে, এ নিয়ে অতো হয়রান হবার কি আছে? আর ওখানে তো ঠাণ্ডাও বেশি, আর হাঁটতেও হয় বরফের উপর দিয়ে। এখানে তো হাঁটছি আমি খটখটে কংক্রিট রাস্তার উপর দিয়ে ।
যতোই নিজেকে নিজে হাইকোর্টের বদলে এভারেস্ট দেখাই না কেন, হাঁটছিলাম নিজের উপর তুমুল বিরক্তি আর ঐ খাম্বার উপর রাগ নিয়ে। সেই রাগে মনে মনে না এক্কেবারে শব্দ করেই দিয়েছি খাঁটি বাঙালি গালি, যেটি কি না হল ঢাকার আদি বাসিন্দা কুট্টিদের মুখের সাধারণ বুলি। যেই গালি কি না সারাক্ষণই তারা যার সাথে কথা বলছে , তার সাথে একটা মধুর আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি করে। তবে এই নির্জন হিমঠাণ্ডা রাস্তায় দেয়া সেই ‘খাম্বা শালা’ গালিটা বেশ জোরেই নিজের কানে বাজতেই, প্রমাণ পেলাম যে রাগে মানুষ অন্ধ। কারণ ঐ মুহূর্তে ভুলে গিয়েছিলাম যে, দারাপুত্র পরিবারসহ কয়েক দিনের ভ্রমণে এসে গালি দিয়ে হলেও যদি আমি এই ধরনের সম্পর্ক তৈরি করি এখানে, লাজুর কানে গেলে তা, রুমে আমার জায়গা হবে না এই রাতে তা নিশ্চিত। তার উপর আরো কি কি যে দুর্গতি নেমে আসবে কপালে, তা জানেন না স্বয়ং অন্তর্যামী। অতএব আর দেয়া যাবে না গালি।
কিন্তু এ তে সমস্যা হল, কমছিল না রাগ ঐ খাম্বা চায়নিজের উপর। মনে হচ্ছিল তুই বেটা একটু বুদ্ধি করে দুইটা ব্যাগে তো ভরে দিতে পারতি আমার মালামাল। তাহলে তো এক হাতের উপর এতো চাপ পড়তো না। এতোটুকু বুদ্ধি না থাকলে তোর, চালাস কি করে এই দোকানটা এমন প্রশ্ন মনে আসতেই, মনে হল, আরে না; ও খাম্বা হলেও বুদ্ধু না। এ বেটা আসলে এক ঘড়েল চায়নিজ শাইলক। সেজন্যই বেটা একটা ব্যাগের খরচ বাঁচানোর জন্য সবগুলোই ঢুকিয়ে দিয়েছে একটাই ব্যাগে। এতে আমি বঙ্গসন্তানের যতোই অসুবিধা হউক, তাতে তার কিছু যায় আসে না। আমি তো আর তার রেগুলার কাস্টমার না। আজ হঠাত উদয় হয়েছি তার দোকানে। এটা সে ভাল বুঝেছে।
ঠিক আছে, এই যদি তোর চিন্তা হয়ে থাকেরে খাম্বা, তবে আগামী ক’দিনে ভুলেও যাব না আমি আর তোর দোকানে। এইসব জিনিষ আমি আগে থেকেই কিনে রাখবো অন্য কোন দোকান থেকে। আজ না হয় রাতের অন্ধকারে এসে নামার পর বুঝতে পারছি না, আশে পাশে কি আছে কোথায়। বরং অন্ধের মতো হেঁটে গিয়ে হাজির হয়েছি তোর দোকানে। জেনে রাখ ভুলেও মাড়াচ্ছি না আর তোর দোকানের পথ আগামীকাল থেকে।
আচ্ছা, হোটেলের গেটের সামনে এসে, গেট দিয়ে না ঢুকে পাশে দাঁড়িয়ে শুধু শুধু ঠাণ্ডা খাচ্ছি কেন এতোক্ষণ! ঢুকছি না কেন ভেতরে? এ কথা মনে আসতেই গেটের ঠিক বাইরে, ডান পাশে হোটেলের সূর্যছাদ, মানে সানসেইডের নীচে ধুমপায়িদের জন্য রাখা বড় ছাইদানিটার পাশে দশসেরি ব্যাগটা নামিয়ে যে এতক্ষণ বিশ্রাম করছিলাম সেটি খেমা দিয়ে, পুনরায় ব্যাগ হস্তগত করে ঢুকে পড়লাম ঘূর্ণায়মান গেইটের ভেতরে।
ভেতরে ঢুকতেই ওম ওম গরমের আরাম জড়িয়ে ধরতেই খোলতাই হল মন কিছুটা। লিফটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম, একটু জরিপ করে যাই, ডানদিকে বার লাগোয়া যে রেস্টুরেন্টটি আছে তা। দেখি ফাঁকা আছে কী না ওটা । আর ওখানে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাখাবারের, মানে ইন্টারন্যাশনাল বাফেট ডিনারের ব্যবস্থা আছে কী না, তাও বুঝে নিই। তাহলে সবাইকে নিয়ে, এখানেই আসব অচিরেই। কিন্তু নাহ, হাতের ব্যাগের ওজনের কারণে সেদিকে আর পা বাড়াতে ইচ্ছে না করায় গেলাম সোজা লিফট লবিতেই।
নাহ এবারেও খুব দেরি হল না লিফট পেতে। অতএব লিফটে ঢুকেই আবারো মেঝেতে হাতের জগদ্দল পাথরটি সমর্পণ করে নিজেদের ঠিকানার বোতামে চাপ দিতে দিতে, মনে মনে তারিফ করলাম হোটেলের এই লিফট সার্ভিসের।
বেশ দ্রুতই ১৫ তলায় উঠে লিফট স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা খুলে দিতেই, মেঝে থেকে জগদ্দল পাথরটি ফের হাতে নিয়ে, আবারো সন্তোষ প্রকাশ করলাম নিজ মনে লিফটের সার্ভিসের। কারণ এতো দ্রুত উঠলেও কোনরকম দুলুনি বা ঝাঁকুনিতে মাথা গুলিয়ে উঠে নি, যা হয় অনেক সময় আমার এ ধরনের দ্রুতগামী কোন কোন লিফটের ক্ষেত্রে। রুমের সামনে এসে ফের সেই জগদ্দল ব্যাগ মেঝেতে সমর্পণ করে পকেট থেকে চাবিকার্ড বের করে দরজার তালায় ছুইয়ে, হাতের আলগোছে দেয়া ধাক্কায় দরজা খুলে যেতেই, পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সেই জগদ্দল পাথরকে ঢোকাতে চাইলাম রুমের ভেতর । কিন্তু কাজ হল না। সওদাপাতির সেই ব্যাগ, সে আসলেই এবার জগদ্দল হয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে রইলো মেঝের কার্পেটের উপর , অতএব ফের বাড়াতেই হল হাত।
‘এসেছ নাকি খাবার নিয়ে? এতো দেরি হল যে? দেখ, তোমার পুত্ররা কিন্তু এখনো বের হয়নি বাথরুম থেকে। আমি কিন্তু আর কিছু বলতে পারব না। আমার মাথা ব্যথা হয়ে গেছে! খেয়ে দেয়ে ঘুমাব আমি।’ দরজায় আমার উপস্থিতি আন্দাজ করে বলে উঠল লাজু এসময়ে।
তড়িঘড়ি রুমের ভেতরে ঢুকে ব্যাগটিকে মিনিবারের সামনে মেঝেতে রাখতে রাখতে, প্রথমেই একটু কপট রাগ করে গলা ভারী করে দীপ্র অভ্রকে বাথরুম থেকে বের হতে বললাম দ্রুত। তাতে এতোক্ষণ যে তাদের কথাবার্তা আর বাথটাবে পানি নিয়ে তাদের হুটোপুটির যে শব্দ আসছিল, থেমে গেল তা।
‘কি ব্যাপার! অমন যাওয়া আসার পথে রাখছো কেন খাবারের প্যাকেটটা? অবশ্য জিনিষপত্র এলোমেলো করে রাখার ব্যাপারে তুমিও তো দীপ্র অভ্রর চেয়ে কম না!’
নাহ নিজের লোভের কারণে সৃষ্ট এতক্ষণের দিদদারী, আর ঐ চায়নিজ শাইলক খাম্বার সামান্য একটা অতিরিক্ত ব্যাগ না দেবার চরম মুনাফাখোরী আচরণে যতোই বিরক্ত থাকি না কেন মনে মনে, খুব সচেতনভাবেই গায়ে মাখলাম না তীরের মতো ছুটে আসা বহুবার শোনা স্ত্রীমুখনিঃসৃত ঐ বাক্যশর। বরং একান্ত বাধ্যগত সুবোধ বালকের মতো ব্যাগটি মেঝে থেকে তুলে, মিনিবারের উপরের খালি জায়গায় রাখতে রাখতে বললাম, আমরা সবাই নিচে যাব খেতে।
‘নাহ আমি আর বাইরে যাবো না। বলেছি তো আগেই। আর এই ব্যাগে করে তা হলে কি নিয়ে এসেছ?’ সোফায় বসে টিভির পর্দায় চোখ রেখে বলল লাজু।
বাইরে যেতে হবে না। এই হোটেলেই খাব, নিচতলার কোন না কোন রেস্টুরেন্টে। এখানে আশেপাশে কোন রেস্টুরেন্টই পাইনি এতক্ষণ হেঁটেও। শুধু একটা মুদি দোকান পেয়ে, সকালের জন্য কিছু নাস্তা আর দুই রুমের জন্য পানি এনেছি। ‘এই হোটেলের রেস্টুরেন্টে খেলে তো অনেক বেশি দাম দিতে হবে’ সোফা ছেড়ে উঠে এদিকে হেঁটে আসতে আসতে বলল লাজু। বেশি হলে হবে। করার তো কিছু নাই। না খেয়ে তো থাকা যাবে না। আর কুনমিংএ তো আমরা হোটেলের রেস্টুরেন্টেই খেয়েছি। ঐরকমই দাম হবে এখানে। এ আর কি । বললাম আমি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে হাজী মো. জাকারিয়া
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু হচ্ছেন ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ আর জহুর আহমদ হলেন ‘আর্টিস্ট অব পলিটিক্স’