বেতন না উপরি কত?
আমাদের হোটেলমুখী বাস ছাড়ার সময় আর বাস ছাড়ার স্থান নিয়ে যাবতীয় অনিশ্চয়তা একটু আগে মন থেকে বিদায় হয়ে যাওয়াতে, বেশ নিশ্চিন্ত মনে সপুত্রক ফলাহার করতে করতে ফের মনে হল, নাহ টিকিট কিনতে গিয়ে টিকিট বাবুর সাথে গলদঘর্ম অবস্থার সৃষ্টি হবার প্রাক্কালে, হঠাৎ করে নাজিল হওয়া সেই বাহলুল চায়নিজ ভার্সনকে আমার আসলে টিপস দেয়াই উচিত ছিল। ওটাকে সে ঘুষ মনে করতে পারে বলে যে আশংকাটি করেছিলাম, তা আসলে একদমই অমূলক। কারণ চায়না নিশ্চয়ই ঘুষমুক্ত অতিমানবিক পবিত্র ভূমি নয়। তাই যদি হবে তাহলে মাঝে মধ্যেই চায়নিজ কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় চাইদের ঘুষ বিষয়ক কেলেংকারির কথা কাগজে আসে কেন? আবার আমাদের এই পারিবারিক ভ্রমণটির জন্য ভিসা আবেদনের সাথে বাড়তি পয়সাই বা গুনতে হয়েছিল কেন?
জানি দেশের ব্যাপারে যারা অষ্টপ্রহর দুর্মুখের ভূমিকা পালন করেন, তারা হৈ চৈ করে বলবেন ওটা হল সঙ্গদোষ। মানে বাংলাদেশের চায়নিজ এম্বেসির লোকজন, বাংলাদেশে থেকে ঘুষভক্ত হয়ে তাদের সেখানকার ভিসা সেকশনটিকে ঘুষভুক্ত করে ফেলেছে। অতএব এ হল সঙ্গদোষ! তা ঐ সকল ভাই বোনদের প্রতি আমার জিজ্ঞাসা, তা হলে একটা প্রশ্নের জবাব দেন আপনারা আর তা হল, এই যে চায়নায় জাল নোটের এতো ছড়াছড়ি , তার পেছনে কি ঘুষের, দুর্নীতির কারসাজি নাই না কি? চায়নিজ সরকার বা আইনশৃংখলা বাহিনী কি ইচ্ছে করলেই বন্ধ করতে পারে না এই জালটাকা? এ পর্যন্ত যতোটা দেখেছি, আর বুঝেছি নানা দেশে; তাতে এতটুকু অন্তত বুঝেছি যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অজানিতে কোন দেশে বা সমাজেই বেআইনি কাজ সংঘটিত হতে পারে না। অতএব চায়না এসব ব্যাপারে একদম ধোয়া তুলসি পাতা, তা বলা যায় না। কথা হলো এখানে হয়তো ঘুষ লেনদেন হয় ভিন্ন পদ্ধতিতে।
এই যেমন, কেউ ঘুষ খায় না, এমন কথা যখন আমাদের দেশে কারো ব্যাপারে বলা হয় , তখন যে এক দুটো প্রচলিত প্রশ্ন করে থাকেন সন্দেহবাতিকগ্রস্তরা তার প্রথমটি হল “কত ঘুষ খান না উনি?” আর দ্বিতীয়টি হল “কোন ভাবে খান না?” তেমন প্রশ্ন এখানেও করা যেতে পারে। তবে তাই বলে আমার দেশের ঘুষের মতো ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধিটিকে আমি জাস্টিফাই করছি, তা কিন্তু না। বাংলাদেশের মতো ঘুষের এরকম খোলাখুলি বিস্তার আর একটা দেশেই আছে বলে জানি, তা হল ইন্দোনেশিয়া। এ ব্যাপারে আরো ভয়ানক সত্য হল এই যে, এই অপরাধটি আর সেই অপরাধকর্মটি সুচারুরূপে সম্পাদন করা ব্যক্তিটি,এই দুটি দেশেই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গেছে! যেমন ছোট বেলা থেকেই নানা জনের আলাপ আলোচনা থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম যে বিয়ে শাদির ব্যাপারে পাত্রীপক্ষের মুরুব্বিরা, পাত্রের বেতনের খোঁজের চেয়ে ‘উপরি আয়’ এর খোঁজ নিতেন বেশি। আর এ ব্যাপারটি শহুরে মুরুব্বিরা আকারে ইংগিতে বা ঠারে ঠুরে নিলেও, গ্রামের মুরুব্বীদের কিন্তু সরাসরি জিজ্ঞেস করতে শুনেছি ‘আরে বেতনের কথা বাদ দেও, জামাইর উপরি আয়ের সুবিধা কেমন হেইডা কও’। ঘটনা এমন আর কি, যেমন একসময় আমাদের দেশে টাকা লগ্নিকারী কাবুলিওয়ালারা নাকি টাকা তুলতে এসে বলতো ‘আছল নেহি ছুদ মাংক্তা’। তেমনি আমাদের পাত্রবাজারে পাত্রী পক্ষের মুরুব্বীদের জিজ্ঞাসা ‘বেতন না উপরি কত?”
তবে ইন্দোনেশিয়ার পাত্রীপক্ষ এভাবে পাত্রের ঘুষপ্রাপ্তিযোগের খবর নেয় কি না জানি না; তবে ওখানে ওটা লেনদেন হয় একদম খোলাখুলি কোন রকম লুকোছাপা না করে, চক্ষুলজ্জা না করে। আমাদের দেশের ঘুষখোরদের যতটুকু চোখের পর্দা আছে তাও নেই ওদের। বিদেশিরা সহজেই ঐ রকম খোলাখুলি ঘুষের লেনদেন প্রত্যক্ষ করতে পারেন জাকার্তা বিমান বন্দরে পা রেখেই। ওখানে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পাসপোর্টে সিল মারার জন্য ভেতর নগদ নারায়ন গুঁজে দেয়াই নিয়ম, না হয় সিল তো পরবেই না পাসপোর্টে; শুরু হবে নানান ধানাই পানাই। আর রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশকে আমাদের এখানে যেমন ঘুষ দিতে হয় রাস্তায় থাকা বিশেষ কোন বস্তু বা মানুষের মাধ্যমে, ওটাও ওখানে হয় এক্কেবারে খোলাখুলি।
চায়না বা অন্যান্য দেশের সমাজে যে ঘুষের লেনদেন হয় ওটা খোলাখুলি হয় না, বা ওটার নেই সামাজিক মর্যাদা। যার কারণে উন্নত বিশ্ব বিশেষত পশ্চিমা বিশ্ব, যেগুলোকে খালি চোখে ঘুষ দুর্নীতি এসব মুক্ত মনে হলেও, আসলে তারা ঐটিকে নিয়ে গেছে এক্কেবারে উচ্চমার্গের শিল্পের পর্যায়ে, যার বিপরীতে আমাদের আর ইন্দোনেশিয়ার সমাজের পরতে পরতে ব্যাঙের ছাতার মতো গছিয়েছে ঘুষ, অনেকটা কুটির শিল্পের মতো!
“বাবা আমরা কি একটু দেখে আসব আমাদের বাস এসেছে কি না?” বহুবচনে জিজ্ঞেস করা অভ্রের এই প্রশ্নে , ভাবনায় ছেদ ঘটতেই বুঝলাম , ফলাহার আসলে তারও ভাল লাগছে না । দীপ্রর যে তা ভাল লাগবে না তা তো জানাই । বললাম বাবা এই তো কিছুক্ষন আগেই তো দেখে আমি আসলাম যে আসেনি আমাদের বাস । আর আমাদের বাস কোনটা সেটাই বা কিভাবে বুঝবে, তোমরা ? এরকম ভয়াবহ ঠাণ্ডায় বাইরে যাওয়ার দরকার নেই এখন তোমাদের ।
‘কেন , তুমি না বললে যে গেইটের বাইরে বা দিকে দাঁড়াবে ওটা’। অভ্রকে দেয়া আমার জবাবের পিঠে ততক্ষণে দীপ্র মুখ খুলে বলল-“আমি জানি। টিকিটে দেখেছি ফিফটিন লেখা আছে, ওটাই তাহলে আমাদের বাস নাম্বার”।
তা ঠিক বলেছ । কিন্তু বাইরে যে ঠাণ্ডা- “আমরা তো আরো একটা সুয়েটার গায়ে দিয়েছি। আর বাইরে গিয়ে দেখেই তো চলে আসব” তড়িৎ জবাব দীপ্রর -আচ্ছা, এখন এখানে টেম্পারেচার কত, তা কি দেখেছ? জিজ্ঞেস করলাম একই সাথে দুই ভাইকে। কারণ বাইরের হিমচ্যানেলের হিমে জমে গেলেও ঐ হিম কতোটা হিম তা কিন্তু জানি না এখনও। আর নাতিশীতোষ্ণ দেশের লোক আমি, তাই ওটা ধারনা করার মতো বোধ শক্তিও আমার চামড়ার নাই।
“মাইনাস নাইন” সমস্বরে দুজনেরই কাছ থেকে একই জবাব আসায় বুঝলাম এরই মধ্যে তারা মায়ের হাতফোন বা নিজের হাতানো যন্ত্রে, বাইরের তাপমাত্রা জেনে নিয়েছে।
“বাবা আমরা কি এখানে স্নো ফল দেখতে পাব ?” জিজ্ঞাসা অভ্রর এবার
সে জন্যই তো ইউরোপ বাদ দিয়ে এখানে আসলাম। মনে নাই তোমরা স্নো ফল দেখতে চাও বলে আমি যখন ইউরোপে যাওয়ার কথা বললাম, তখন তোমাদের মা বলেছেন বেড়াতে গিয়ে বোমাবাজিতে পড়ার টেনশনে থাকতে চান না। আর গোটা ইউরোপেই তো আজকাল যখন তখন বোমা মারছে জঙ্গিরা, যা এখনও হয়নি চায়নায়। সে জন্যই তো তোমাদের নিয়ে চায়নায় আসা। কারণ বেইজিং এ যা ঠাণ্ডা পড়ে তাতে স্নো ফল দেখার সম্ভাবনা আছে। আচ্ছা তোমরা কে বলতে পার স্নো ফল কেন হয়? কখন হয় ?
“এটা তো জানা কথা, জিরো ডিগ্রি টেম্পারেচারে পানি জমে বরফ হয়ে যায়, তাই স্নো ফল হয় ‘তড়িৎ জবাব দীপ্রর
তা ঠিক এটা সোজা কথা, কিন্তু এখন তো এখানে স্নো ফল হচ্ছে না, যদিও বললে তাপমাত্রা এখানে এখন মাইনাস নাইন, এটা কেন? বল দেখি -“ওহ তাই তো? তাহলে মনে হয় এখানকার আকাশে এখন খুব বেশি মেঘ নাই সেই জন্য মনে হয়। বেশি মেঘ থাকলেই এরকম টেম্পারেচারে ওগুলো বৃষ্টির পানির ফোঁটা না হয়ে জমে বরফ হয়ে নীচে পড়ার কথা” বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করে দেয়া দীপ্রর এ উত্তরে ওকে উৎসাহ দিয়ে বললাম -চমৎকার বলেছ বাবা! অতঃপর অভ্রর দিকে তাকাতেই , ওই মুহূর্তে ব্যাগ সুটকেস টানতে টানতে সাত আট জন চায়নিজ, যারা সম্ভবত একটু আগে নামা ফ্লাইটে এসে নেমেছেন এয়ারপোর্টে; তাদের কে অবলীলায় গেইট দিকে এগিয়ে যেতে দেখে, তাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল -“শুধু আমরাই কেন বসে আছি এখানে বাবা? সবাই তো বেরিয়ে যাচ্ছে” -তারা তো বাবা সব এখানকার লোক। নিশ্চয় তারা ট্যাঙি করে চলে যাবে এই শহরের যার যার ঠিকানায়। আবার বাসে গেলেও তো তাদের টিকিট কাটতে হলেও বাইরেই যেতে হবে। “কেউ তো টিকিট কেটে আবার ফিরে এসে এখানে বসে থাকছে না আমাদের মতো,বাবা। আর আমরাই বা ট্যাঙি তে করে চলে যাচ্ছি না কেন?” প্রশ্ন এবার দীপ্রর -বুঝলাম দু ভাইয়ের এরকম একটা নিস্তরঙ্গ আর জাকজমকহীন মলিন চেহারার আগমনী লাউঞ্জে মোটেও বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। যার কারণে ছুতা খুঁজছে ওরা, বাইরের হিম চ্যানেলে যাওয়ার । বললাম যে, শোন কানমিংয়ের মতো এখানেও এক ট্যাঙিতে তিনজনের বেশি যাত্রী যেতে পারে না। অতএব যেতে হবে আমাদের দুইভাগ হয়ে দুই ট্যাঙি তে, যা আমি করতে চাইছি না। আবার ভাড়া করার জন্য বন্ড মিয়ার বড় ভ্যানটির মতো ভ্যানও দেখতে পাইনি এখানে। সেজন্যই যাব বাসে। আর আমাদের বাস যে ছাড়বে সাড়ে চারটায় তা তো তোমরা জানই। সে জন্যই বসে আছি এখানে এখন।
“আমরা কি একটু বাইরে গিয়ে দেখে আসতে পারি, আমাদের বাসটা এসেছে, কি না?” ঘুরে ফিরে তালগাছ আমার এরকম দাবির মতোই সেই একই দাবি পেশ করলো দু ভাই সমস্বরে ফের -ঠিক আছে যাও। তবে যাওয়ার আগে দুজনেই হাত মোজা পড়ে নাও। মুখের বাকি কথা আমার মুখেই রয়ে গেল। কারণ ততক্ষণে দুই ভাই, নিজ নিজ হাতের ম্যান্ডারিন আমার কোলের উপর সোপর্দ করে , তড়িঘড়ি রওয়ানা হয়ে গেল গেইটের দিকে। যেতে যেতে দীপ্র তার হাত মোজাগুলো পরে নিলেও, অভ্র দেখলাম সে ব্যাপারে মোটেও গা না করে, জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভাবনা এলো এসময় যে, এই লাউঞ্জে এসে বাধ্য হয়ে ঘণ্টা দুয়েকের আস্তানা গাঁড়ার সিদ্ধান্ত নেবার আগে, দুই ভাইয়ের হিম চ্যানেলের তীব্র ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, আমার সাথে বাইরে গিয়ে; তারপরও কেন সেই একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে চাইছে ওরা? আমার তো না হয় উপায় ছিল না। কিন্তু ওদের ব্যাপারটা তো তা নয়! এ কি শুধুই একটা আদ্দি আমলের জৌলুসহীন আর প্রাণহীন লাউঞ্জে বসে থাকার একঘেয়েমি থেকে বাঁচার জন্য করলো তারা? নাকিএ হলো আসলে মানুষের জিনে প্রকৃতিগতভাবে প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ করার যে সুপ্ত বাসনাটি আছে তারই প্রতিফলন।প্রকৃতিকে বুঝে, আধাআধি বুঝে কিম্বা একেবারেই না বুঝে নানান রকম চ্যালেঞ্জ করেই তো এগিয়েছে মানবসভ্যতা সেই আদিকাল থেকে, যখন এ গ্রহে প্রথম পা রেখেছিল মানুষেরই নানান, চাচাত, খালাত, মামাত ফুফাত ভাই বোনেরা। শিকারি আর সংগ্রাহক মানুষের কৃষি শিখে, কৃষি কাজ করতে শুরু করা, আর নিরীহজাতের বন্য পশু পাখিকে নানান প্রয়োজনে গৃহহপালিত প্রাণিতে পরিণত করাটাকেই তো আমার মনে হয়,মানুষের প্রকৃতিকে জয় করার প্রথম ধাপ। অন্যান্য প্রাণী আর উদ্ভিদ যখন প্রকৃতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে, সন্ধি করে, নিজের অস্তিত্ব কে রক্ষা করেছে এই গ্রহে। সে রকম একটা অবস্থায় মানুষ প্রকৃতিকে বদলে নিয়েছে সেটিকে নিজের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক