দ্রব্যমূল্যস্তর ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা

বাসুদেব খাস্তগীর | রবিবার , ৬ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:২০ পূর্বাহ্ণ

অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী জিনিসপত্রের মূল্য নির্ধারিত হয় চাহিদা ও যোগানের ওপর নির্ভর করে। যেখানে চাহিদা ও যোগানের স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান থাকবে এবং সেখানেই দ্রব্যমূল্য স্তর নির্ধারিত হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির এ যুগে দ্রব্যমূল্য স্তরের চরম উঠানামা মানুষের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। নিদির্ষ্ট আয়ের মানুষের জীবন যেনো নাভিশ্বাস হয়ে ওঠে। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখিতা কারণে সমাজের নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাহিদা ও যোগানের যে স্তরে দ্রব্য মূল্য নির্ধারিত হয় তাকে আমরা কাম্যস্তর বা ভারসাম্য স্তর বলি। চাহিদার তুলনায় পণ্যদ্রব্যের যোগান বেশি হলে জিনিসপত্রের দাম কমে যায় অর্থাৎ মূল্যস্তর কমে যায়। বিপরীতভাবে চাহিদার তুলনায় পণ্যদ্রব্যের যোগান কম হলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় অর্থাৎ মূল্যস্তর বৃদ্ধি পায়।এই দুটো বিষয়ই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। দ্রব্যমূল্য কমলে উৎপাদনকারী সাধারণ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন,আর দ্রব্যমূল্য বাড়লে সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ, সাধারণ নিম্নবিত্ত- নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। যাতে কোন পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে জন্য দ্রব্যমূল্য চাহিদা ও যোগান একটি নির্দিষ্ট ভারসাম্য স্তরে রাখতে হয়, যেটাকে আমরা কাম্যস্তর বা ভারসাম্য স্তর বলি। এই কাম্যস্তর বা ভারসাম্য স্তরটি খুব স্বাভাবিক নিয়মে নির্ধারিত হবার কথা। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চাহিদা ও যোগানের স্তরটি স্বাভাবিক নিয়মে অনেক সময় ঘটে না। এখানে একটি সিন্ডিকেট চক্র কাজ করে। তারা কৃত্রিম ভাবে পণ্যের চাহিদা- যোগানে প্রভাব বিস্তার করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দ্রব্যমূল্য স্তরকে ঊর্ধ্বমুখী করে। যার ফল ভোগ করে সাধারণ জনগণ। সরকারের সময়ে সময়ে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ দেখি কিন্তু কিছুদিন পর তা আবার মিলিয়ে যায়। শক্তিশালী এ চক্রকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আমাদের দেশে আমরা পেঁয়াজ নিয়ে অনেক তুলকালাম কাণ্ড দেখেছি। ত্রিশ চল্লিশ টাকার পেঁয়াজ দুইশত টাকা অতিক্রম করার উদাহরণ তো সামনেই আছে। অথচ সরকার বলেছিলো যথেষ্ট পেঁয়াজ মজুত ছিলো, কিন্তু কে শোনে কার কথা। বিভিন্ন সময়ে ঔষধ নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজিও প্রত্যক্ষ করেছি। চাল ও আলুর মত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়েও কত কাণ্ডই না ঘটে গেলো। অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মে এখানে পণ্যের যোগান এবং চাহিদা সৃষ্টি হয় না। ফলে দ্রব্যমূল্য স্তর কৃত্রিমভাবে বেড়ে যায় প্রতিনিয়ত। শাকসবজীর ক্ষেত্রেও এধরনের সিন্ডিকেট কাজ করে। সাধারণ কৃষক এ ক্ষেত্রে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। পেঁয়াজ মজুত রেখেছে, কিন্তু সে পেঁয়াজ গুদামে পচে গেছে, এরকম সংবাদও আমরা মিডিয়ার কল্যাণে দেখি, শাকসবজির ক্ষেত্রেও তাই। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারের কঠোর নজরদারী ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ। বাংলাদেশে মজুতদারী করে যারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় তাদের কয়জনকে ধরা হয়েছে? বা শাস্তি দেয়া হয়েছে? তার উদাহরণ তেমন একটা নেই। ফলে এ চক্রটি সময়ে সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং এ রকম ঘটনা পুনরায় ঘটাবার সাহস পায়। পরিবহন সেক্টরের মত এখানেও শক্তিশালী একটি চক্র কাজ করে তার শিকড় ধরে টানতে গেলেই সরকারকে নানা ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলা দেয়া হয়। আমরা দেখেছি একটি ভালো সড়ক পরিবহন আইন করতে গিয়ে সরকারকে আবার পিছিয়ে যেতে হয়েছে এ চক্রের কারণে। মজুতদারী সিন্ডিকেটও সহজে ভাঙা যায় না। বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ কোন সুদূরপ্রসারী ফল বয়ে আনে না। উন্নত দেশে দ্রব্যমূল্য এক টাকা বাড়তে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, আর সেখানে রাতারাতি জিনিসের দাম যে বেড়ে যাবে, তা কল্পনাতীত। কোন সভ্য দেশে এত দ্রুত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার কল্পনা করা যায় না। সাধারণ জনগণের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। সমাজ ব্যবস্থায় তারা সবচেয়ে ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী,অথচ তারাই সবচেয়ে সংখ্যায় বেশি, কিন্তু নিষ্পেষিত। আর আমাদের চাহিদা ও রুচির বোধের মধ্যে পার্থক্যও প্রবল। অল্প পরিমাণ জিনিস দিতে বা বিক্রয় করতে বিক্রেতাদের এক ধরনের অনীহা। অল্প পরিমাণ জিনিস ক্রয় করতে চাইলে বিক্রেতারা বাঁকা চোখে দেখে। অথচ পার্শ্ববতী দেশে এক টুকরো মাছও কিনতে পাওয়া যায়। এ দেশে এটা কল্পনা করা যায় না, আপনাকে মনে মনে বিক্রেতারা নিম্ন আয়ের লোকের শ্রেণিতে বিবেচনা করে বসবে। সময়ে দু’একটি কটূ কথাও শুনিয়ে দেবে। অর্থাৎ আমাদের দেশের এক শ্রেণির ধনিক গোষ্ঠীর জন্য যে সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে, তার থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। এ দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে ধনীক গোষ্ঠী যাদের অর্থ বিত্ত অঢেল তাদের হয়তো কিছু আসে যায় না, কিন্তু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। সাধারণ মানুষ, যাদের ক্রয় ক্ষমতা অনেক কম, তারা পড়েন সংকটে। মানুষের আয়ের সাথে ব্যয়ের তারতম্য নির্ভর করে। সময়ে সময়ে অস্থির করে তোলা হয় নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায় প্রতিটি পণ্য। সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষের এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নজরদারী প্রয়োজন। অসৎ ব্যবসায়ীদের অতি লোভী মানসিকতার কারণে সাধারণ জনগণ অধিক মূল্যে পণ্য কিনতে বাধ্য হয়। সরকারের তথ্য অনুয়ায়ী বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের কোন ধরনের সরবরাহ সংকট নেই বলা হয়। তারপরও জিনিসের দাম বাড়ে হু হু করে। দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থায় সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায় নিত্য পণ্য। মধ্যস্বত্বভোগী, ফড়িয়া, সিন্ডিকেট চক্র তাদের দৌরাত্ম্য এতই প্রবল যে তাদের হাতে জিম্মি খুচরা ব্যবসায়ী ও সাধারণ ভোক্তা। বাজার যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না। সবচেয়ে কঠিন সময় পার করে মধ্যবিত্তরা। মাঠ পর্যায়ে টিম গঠন করে বাজার মনিটর করা দরকার। ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য প্রকট। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামেই বসবাস করে। যাদের অনেকেই দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। তাদের কথা রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। ক্রমাগত দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করা মানুষগুলোর জন্য প্রতিনিয়ত বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দেয়। বিশ্বের সার্বিক মন্দা অর্থনীতির ঢেউ মোকাবেলায় সব দিক বিবেচনা করেই অগ্রসর হতে হবে। নানা ক্ষেত্রে যে সাবসিডি বা ভর্তুকি দেয়া হয় তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দ্বারে ঠিকমত পৌঁছে না। টিসিবির মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে যে পণ্য সরবরাহ করা হয়, তার সুবিধাও সকলে ভোগ করতে পারেন না। শুধুমাত্র দৃশ্যমান উন্নয়ন দিয়ে জীবন যাত্রার মান নির্ণয় করা যায় না। রাষ্ট্রের সকল মানুষের সার্বিক উন্নয়ন সূচকই উন্নয়নের সঠিক মাপকাঠি। দ্রব্য মূল্যের চাপে পড়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সার্বিক মান উন্নয়নে দ্রব্যমূল্যকে স্থিতিশীল রাখা জরুরি। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে কম বেশি দরিদ্র জনগোষ্ঠী আছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের এ রকম উর্ধ্বগতি কিংবা কিংবা সিন্ডিকেট বাণিজ্য কোথাও চোখে পড়ে না। সরকারের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নয়। সাধারণ জনগণের স্বার্থে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী ও অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে সৎ ব্যবসায়ীরাও অনেক সময় কোণঠাসা হয়ে পড়েন। দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশের আয় ও ক্রয় ক্ষমতার হার নিম্নগামী এবং তা উদ্বেগজনকও বটে। ক্রয় ক্ষমতা নির্ভর করে দুটো জিনিসের ওপর। একটি হলো আয়, অন্যটি দ্রব্যমূল্যের বাজার ব্যবস্থা। একদিকে আয় কম অন্যদিকে এক শ্রেণির লোভী ব্যবসায়ীর কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ার প্রবণতা। সরকারের কঠোর পদক্ষেপে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই জনগণের ক্রয় ক্ষমতা আয়ত্তে আসতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধচরম্বায় ইটভাটা থেকে কাঠ জব্দ