দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

ডিজিটাল সিল্করুট

ভালই লাগল, রাস্তায় হঠাৎ কর্নেলের মুর্গিভাজার দোকান দেখতে পেয়ে, পূর্বপরিকল্পিত ডিনারের মেন্যু বদলে ফেলার সিদ্ধান্তটি নিতে পারার চমৎকার ফলাফল দেখে। এ মুহূর্তে রুমজুড়ে মহানন্দে ব্যস্ত সবাই কেন্টাকির মুর্গিভাজা চিবানোতে। যদিও শুরুতেই কাগুজে বালতি ভরা মুর্গিভাজা দেখে, নিয়মের কোনো ব্যত্যয় না ঘটিয়ে যথারীতি তুমুল সন্দেহ প্রকাশ করেছিল লাজু আমার কাণ্ডজ্ঞান আছে কি না তা নিয়ে! বোঝার উপর শাঁকের আঁটির মতো করেছিল মৃদু ভৎসর্নাও এতো এতো খাবার নিয়ে আসার মতো অধমের অপচয়স্পৃহাটির কারণেও।
কিন্তু এ মুহূর্তে যখন সে নিজ চোক্ষেই দেখতে পাচ্ছে যে পুত্ররা ঘণ্টা এক দেড় আগে ভরপেট নুডুলস খাওয়ার পরও, পিছিয়ে নেই মোটেও মুরগিভাজা খাওয়ার ব্যাপারে; তাতে নিশ্চয় আমার কাণ্ডজ্ঞান ও অপচয়স্পৃহার ব্যাপারে ভুল ভেঙেছে তার। যদিও জানি ভুল ভেঙে থাকলেও তা স্বীকার করে স্বামী নামক বাঁদরকে লাই দেবার মতো ভুল সে করবে না। অতএব মিছে সে দুরাশা! তার চে বরং খাওয়া যাক মুর্গিভাজা, সেটাই ভাল মনে করে লেগে গেলাম তাতেই।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে বলে যে সূত্র আছে, সে সূত্রটির অব্যর্থ কার্যকারিতা প্রমাণ করে, মুর্গি চিবুতে চিবুতে এসময় ফের মনে উদয় হল আমার বিপণন ভাবনা। মনে হল, এ কি আচানক ক্ষমতা বিপণনের! কী সুচারুরূপেই না এটি বরাবর বদলে দিচ্ছে মানুষের নানান অভ্যাস। উনিশ শতকের তিরিশের দশকের গোটা দশকব্যাপী বিরাজমান অর্থনৈতিক মন্দার সময় কর্নেল স্যান্ডার্স যখন আমেরিকার কেন্টাকি শহরের রাস্তার ধারে রেস্টুরেন্ট খুলে মুর্গি ভাজা বিক্রি করা শুরু করেছিল, তখন কি উনি ভুলেও ভেবেছিলেন যে তার এই মুর্গিভাজা করবে বিশ্বজয়?
একইসাথে ফের মনে হল যেই চায়নিজরা বহু আগে থেকেই নানা দেশে গিয়ে শহরে শহরে ভাতের হোটেল মানে রেস্টুরেন্ট খুলে শুরু করেছিল ব্যবসা, বিপণনের কারিশমায় সেই চায়নারই রাজধানী শহরের পাঁচতারা হোটেলের অন্দরমহলে কিনা ঢুকে পড়েছে আম্রিকার রাস্তার ধারের রেস্টুরেন্টের মুর্গিভাজা! উপরন্তু এর সাথে যোগ হয়েছে গ্লোবালাইজেশনের মজমাও! কারণ এ মুহূর্তে পাঁচ বাঙালি বেইজিং এর হোটেলে বসে খাচ্ছে, চায়নিজ শেফের ভাজা আম্রিকান কেন্টাকি চিকেন! শুধুই কি তাই, আজকের গ্লোবালাইজেশনের কালে, ডিজিটাল সিল্করুট ধরে বিপণনের যাদুতে এতো হয়ে উঠেছে এ গ্রহের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেস্টুরেন্ট চেইন! আচ্ছা এ মুহূর্তে গ্লোবালাইজেশন নামের এ চমৎকার শব্দটির আড়াল থেকে মনে হচ্ছে এক উঁকি দিল আরেকটা বেশ আপত্তিজনক ব্যাপার, নাম যার সাম্রাজ্যবাদিতা। হঠাৎ করেই কেন জানি এই ব্যাপারটাকে আমার ছদ্মবেশী সাম্রাজ্যবাদিতা বলেই মনে হচ্ছে। সামরিক সাম্রাজ্যবাদিতার মতো একে কি তবে বলা চলে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদিতা?
‘মা, মা এই নুডুলসটা দিয়ে কিন্তু আমি সকালে নাস্তা করবো’। সাম্রাজ্যবাদিতা বিষয়ক আমার চিন্তার সাম্রাজ্যের তাল কেটে গেল এসময় দীপ্রর এই দাবীতে ‘তা করো, কিন্তু ঠাণ্ডা এই ঝোল নুডুলস খাবে কিভাবে? এই রুমে তো নুডুলস গরম করার কোনো ব্যবস্থা নাই’। পুত্রের আবদারের জবাব দিয়েই স্ত্রীর আদেশের নল ঘুরে গেল আমার দিকে- ‘এই, শোন সকালে কিন্তু এই নুডুলস গরম করার ব্যবস্থা করতে হবে। এদের রুম সার্ভিসকে বললেই তো করে দেবে তা, তাই না’।
পড়লাম মহাফাঁপরে। এরকম আচানক আবদার করা যায় কি না এরকম হোটেলের রুম সার্ভিসের কাছে, এ ব্যাপারে জ্ঞান আমার শুন্য; যদিও পেশাগত কারণে এ জীবনে বহুবারই থেকেছি এ ধরনের হোটেলে। তবে এ মুহূর্তে নিজের এই অজ্ঞানতা নিয়ে যতোটা না পড়েছি ফাঁপরে তারছে বেশি বিড়ম্বনায় পড়েছি, এ ধরনের একটা অনুরোধ এরকম একটা হোটেলে করা কতোটা ইজ্জতসংগত ব্যাপার হবে সে চিন্তায়। এমনিতেই এই ধরনের হোটেলের ভেতরেই থাকে তাদের নিজস্ব একাধিক নানা তরিকার রেস্টুরেন্ট। ফলে বাইরের রেস্টুরেন্টের খাবার নিয়ে হোটেলে ঢোকার ব্যাপারে তারা করতেই পারতো আপত্তি। যার কারণে ঐ কর্নেল ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে ঢুকছিলাম যখন হোটেলে, তুমুল নীরব সঙ্কোচে কুঁচকে ছিলাম নিজের ভেতরে। কপাল ভাল তারা করেনি তা। সিকিউরিটি আর লবিতে থাকা হোটেলের লোকজনের চোখমুখ দেখে মনে হয়েছিল, তারা ব্যাপারটি দেখেও না দেখার ভান করেছে আমাকে বিব্রত না করার জন্য। তারপর এখন যদি বলি বাইরের এই আনা খাবার গরম করে দাও, খাবো; তাতে যদি তারা আপত্তি জানায়! আবার নেহাতই চক্ষুলজ্জার কারণে আপত্তি না জানালেও যদি মনে মনে বলে, ‘পড়েছি তো দেখছি আজিব বাঙালের পাল্লায়’ তাহলে আমার ইজ্জতের কথা বাদই দিলাম, দেশের ইজ্জত যায় কোথায়?
আর যাই হোক দেশের ইজ্জত তো খোয়ানো যাবে না। এদিকে স্ত্রী আজ্ঞাই বা উপেক্ষা করি কিভাবে। পড়েছি তো দেখি এ মুহূর্তে শাখের করাতে! কী যে করি!
নাহ খুব বেশিক্ষণ লাগলো না এই মুশকিল থেকে আসান পেতে। কথায় আছে না যতো মুশকিল তত আসান? সে কথাটিরই হাতেনাতে সার্থক প্রমাণ হাতে ধরিয়ে দিয়ে এই চরম ইজ্জত সংকট মুহূর্তে আচমকা পেয়ে গেলাম একটা যাকে বলে ফুলপ্রুফ সমাধান। মহানন্দে তাই কিছুটা নাটকীয় ভঙ্গিতে করলাম এলান
কোনো সমস্যা নেই। পাওয়া গেছে সমাধান। রুম সার্ভিসকেও বলতে হবে না। সমাধান আছে এই রুমেই। দেখি তো কে বলতে পারো কিভাবে করা যায় এ সমস্যার সমাধান? ‘মানে কী? রুমে কি ওভেনও আছে নাকি? কোথায় সেটা?’ যুগপৎ অবাক ও অনিশ্চিত প্রশ্ন এলো হেলেনের কাছ থেকে
নাহ তা নয়। কিন্তু আছে সমাধান এর একটা। কে তা ভেবে বের করতে পারে দেখি?
দ্বিতীয়বার একই চ্যালেঞ্জ রুমের মধ্যে গড়িয়ে দিতেই সে ধাঁ ধাঁ’র সমাধানের চিন্তায় নীরবতা নেমে এল। মুর্গিভাজা চিবানোর শব্দ আর এয়ার কন্ডিশনারের হালকা শো শো আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই রুমে এখন। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না এ হিরণ্ময় নীরবতা।
‘অতো নাটক বাদ দিয়ে বলেই ফেল, কি সমাধান পেলে। ‘উত্তর খুঁজে না পাওয়ার ব্যর্থতায় নিজের না আমার উপর বিরক্ত হল লাজু তা বুঝতে না পারলেও, এটা পরিষ্কার হল যে আর বেশি হেয়ালি করা বিপদজনক। তবে মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে, হাতেকলমে উত্তরটা দেখিয়ে দেবার জন্য, সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে রুমের ছাদছোঁয়া দেয়াল ক্যাবিনেটের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কোমর সমান মিনিবারের উপরে ঠায় দাঁড়িয়ে, থাকা চা বানানোর ওয়ারটার হিটার কাম ফ্লাস্কটা হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে নাড়াতেই
‘আরে বলে কী ? ওটার ভেতরে এই চায়নিজ মশলা দেয়া ঝোল নুডুলস গরম করলে,পরে ওটাতে চা বানালে তো মশলার গন্ধে চা ই খাওয়া যাবে না। রাখো তোমার ফালতু বুদ্ধি’। স্ত্রীর এই অনিবার্য মুখঝামটা, স্বামীসুলভ ধৈর্য ও উদার্যে অবলীলায় উপেক্ষা করে বললাম, আরে আমাদের তো দু রুমে দু’টা আছে এরকম ফ্লাস্ক। ঐ রুমেরটা দিয়ে তো কোনো চা বানাতে হচ্ছে না। অতএব সেটাই না হয় ব্যাবহার করা যাবে। আর তাও যদি না হয়, তবে এই ফ্লাস্কে সরাসরি ঝোলসমেত নুডুলস না ঢেলে, আলাদা একটু পানি ঢেলে, সেটাই গরম করে ঠাণ্ডা নুডুলসে মিশিয়ে দিলেই তো কাজ হয়ে যাবে। তাতে নুডুলস ও গরম হল, আর ফ্লাস্কও গন্ধমুক্ত থাকল? বলেই ফের নাটকীয় ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম সবাইকে, কী বল?
‘আরে তাই তো! এ তো খুব সোজা! কিন্তু আমি যে এতো চিন্তা করলাম, তাও এই স্ল্যুশানটা পেলাম না কেন এতক্ষণেও! ধ্যাত! তুমি কিভাবে এটা বের করলে বাবা?’
শোন দীপ্র এটা হল গেরিলা চিন্তা। সোজা সাপটা চিন্তায় সব সমাধান আসে না। সে জন্য গেরিলা চিন্তা করতে হয়। অবশ্য এমনিতে আমরা দুইয়ে দুইয়ে চার, এরকম সোজা চিন্তা করতেই শিখি। তবে মাঝে মধ্যে নিজের ব্রেইন কে গেরিলা চিন্তার প্র্যাকটিসও করাতে হয়। তবে কারো কারো গেরিলা চিন্তার ক্ষমতা থাকে জন্মগতভাবে। আমি অবশ্য তেমন কেউ না। আমারটা ঝড়ে বক পড়লো আর কী ?
‘গেরিলা চিন্তা কী আবার? আর দুইয়ে দুইয়ে তো চারই হবে। অন্য কিছু কেন হবে বাবা?’ তুমুল উৎসুক দীপ্রর প্রশ্নের মুখে বললাম, শোন, গেরিলা চিন্তা যে বললাম, এই নামটাও হঠাৎই মনে এলো এখন। ইংরেজি তে সাইকলজিস্টরা ল্যাটারাল থিকিং, নন লিনিয়ার থিংকিং, ডাইভারজেন্ট থিংকিং ইত্যাকার নানান নামের চিন্তা পদ্ধতির কথা বলে থাকে না। আমি তো সাইকোলজিস্ট না তাই ঠিক জানি না এটাকে ঠিক কী বলবো, তাই গেরিলা চিন্তা বললাম আর কী ? ‘এই শোন, রাত কিন্তু সাড়ে দশটা বেজে গেছে’। লাজুর কণ্ঠে এসময় এলার্ম বেজে উঠতেই, মনে হল আরে তাইতো!
নাহ, মুরগিভাজা ডিনার যেহেতু এরই মধ্যে শেষ হয়েছে সবার, আর দেরী করা নয়। অতএব তাড়া দিলাম সবাইকে, ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে। আগামীকালকের লিস্টিতে গ্রেট ওয়ালযাত্রা ছাড়াও আছে সামার প্যালেস যাত্রা, যেগুলো নাকি শহরের বাইরে এবং একটা আরেকটার একদম বিপরীতে। ঐ দুটো দেখার পর পারলে আর কিছু দেখে নিতে হবে। কারণ তার পরেরদিন তো শপিং ডে। তার পরের পরের দিন তো দেবো উড়াল ‘সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি’র তরে। এদিকে আমার এখনও গোসল করা বাকি আছে। এছাড়া আজ সকলেরই গেছে মোটামুটি ভালই ধকল, বেইজং হিমে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে, অতএব টানা একটা ঘুম ও বিশ্রাম দরকার সবার।
‘বাবা, আমরা কিন্তু কাল আগে আগে ফিরে আসব হোটেলে, মনে আছে? অ্যাপেল স্টোরে যাবো কিন্তু’? হেলেনের পিছু পিছু রুম থেকে বেরুতে বেরুতে মনে করিয়ে দিল দীপ্র, যার জবাবে শুধু হাসলাম, যা অনুবাদ করলে অর্থ হয়, সে দেখা যাবে!
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনেশায় বুঁদ হয়ে যেন কেউ না থাকে
পরবর্তী নিবন্ধআধুনিক এনেসথেসিয়া ও এনেস্থেটিস্টদের ভাবনা