প্রথম পি আর চতুর্থ পি’র যোগসূত্র
এই সান্ধ্য হিমসাগরে এ মুহূর্তে দুই পুত্রের ব্যাগ পিছু ফেলে হঠাৎ হৈ চৈ সম্বলিত ভোঁ দৌড়ের কারণে, হতচকিত আমাদের তিনজনের মধ্যে একই সঙ্গে বেশ কটা ঘটনা ঘটলো, তার কোনটা আগে কোনটা পরে ঘটেছে, তা ঠাহর করা মুশকিল। যার একটি হলো ওদের উদ্দেশ্যে সকলেরই একযোগে, নানান স্বরে আর তাললয়ে সশঙ্কিত হৈ চৈ করে ওঠা।
এছাড়া পিঠে পিঠব্যাগ নিয়ে, দুহাতে দুটি ভোমা সুটকেস টেনে সামান্য এই পথটুকু হেঁটে আসতে আগেই থেকেই হচ্ছিলাম আমি যখন গলদঘর্ম, কারণ দু চাকার প্রতিটি প্রায় ত্রিশ কেজি ওজনের সুটকেস দুটোর হ্যান্ডেল ধরে উঁচু করে হাঁটতে গিয়ে তাল সামলাতে পারছিলাম না। রাস্তাটি তো যাকে বলে সিল্কি স্মুথ বা পেলব মসৃন না অবশ্যই, কিন্তু তা বলে খাইবার গিরিপথও তো না। অথচ মাঝেমধ্যেই দুটো সুটকেসেরই চাকা ক্ষুদ্রাদিক্ষুদ্র কোন খানাখন্দে পড়তেই, বা চাকার নীচে ছোটখাট নুড়িপাথর পড়লেই এমন ভাব করছে দুটো যেন পারি দিচ্ছে খাইবার গিরিপথ! আর এ করতে গিয়ে একটা কান্নি মারছিল যখন ডানে, ঠিক তখনই আরেকটা গোত্তা মারছিল বাঁয়ে। এমতাবস্থায় দ্রুত হাঁটা তো সম্ভব না, তারপরও ঠা-ার ঝাপটা থেকে বাঁচার জন্য এক্কেবারে ধীরেসুস্থে না হলেও, দুই সুটকেসের কান্নি গোত্তার তালসামলে মোটামুটি গতিতে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম যখন, নাহ চার চাকার সুটকেসই কিনতে হবে অচিরেই , যেগুলোর চাকা কিনা ঘোরে চারদিকে। ঐ ধরনের সুটকেস আগে দেখলেও কিনিনি, দু চাকার চেয়ে চারচাকার ঐ সুটকেসের দাম ঢের বেশী আক্রা বলে। তখন ভেবেছিলাম, দুটো চাকা বেশী, তাতেই দাম এতো বেশী হবে কেন? আর চারদিকে ঘোরে এমন চাকার দরকারই বা কি ? চাকা সামনে পেছনে ঘুরলেই হল। আর বাদবাকি সবই হল বেশী দাম নেয়ার জন্য বিপণনকারিদের ভুজংভাজং। কিন্তু এখন ওজনদার দুই সুটকেস দুহাতে টানতে গিয়ে, বেহাল টালমাটাল অবস্থায় পড়ে বুঝতে পারলাম যে আসলেই এরকম অবস্থায় পড়া যাত্রীদের ঐ রকম সুটকেস থাকলে ঝক্কি আসলে কমে কতোটা। মনের ভেতরে জ্ঞানগর্ভ ঐ সুটকেসভাবনা চলছিল যখন, ঠিক তখনই পুত্রদের এরকম আচমকা আচরণে, এতোক্ষন তাল সামলাতে পারলেও শেষ রক্ষা হলো না আর!
তারপরও এমন দুর্ভোগের ভেতরেও স্বীকার করতেই হয় কপাল নেহাতই ভাল আমার এ মুহূর্তে । যদিও শুরু থেকে স্ত্রীর সম্পত্তিটির প্রতি বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করছিলাম, তারপরও দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই। সে দুর্ঘটনাটি তো ঘটতে পারতো লাজুর সুটকেসের ব্যাপারেও। কিন্তু না, হাত থেকে হ্যান্ডেল ছুটে গিয়ে ধপাশ করে ভূমিশয্যা নিল নিজেরই সুটকেস। আর পড়লো তা এমনিভাবে যে, ভাগ্যিস দ্রুত পা সরিয়ে ফেলেছিলাম। না হয় , কি যে ঘটতো পায়ের ! পড়েই যখন গেছে , পুত্রদের কা- উেদ্বিগ্ন বিরক্ত আমার এ মুহূর্তে সেটিকে তোলার ফুরসৎ কোথায়? সুতরাং লাজুর সুটকেসটা ঠিকঠাক মতো মেঝেতে বসিয়ে, দিলাম দৌড় পুত্রদের লক্ষ করে, চকিতে একবার ডান দিকে তাকিয়ে, কারণ ঐ দিক থেকে ঢোকে হোটেলে যাবতীয় ব্যক্তিগত গাড়ি বা ট্যাঙি। কপাল ভাল একটু আগে অভ্র দীপ্র যখন অমন হুড়মুড় করে হোটেলে ঢোকার এই ড্রাইভওয়েটা পার হয়েছে, সে সময় বা এখন যে সে রাস্তাটা দৌড়ে পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম নিজে, এ দুটো সময়েই কোন গাড়িই ঢোকেনি এ রাস্তায়!
দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাচের দেয়ালে নাক ঠেকিয়ে, ওপাশে চুপচাপ ঝিমুতে থাকা টকটকে লাল ফেরারিটির মডেল, ইঞ্জিন, সিট এসব নিয়ে নানান টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন দু ভাই। অতএব দু ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে , তাড়া দিয়ে বললাম, চলো বাবারা, আগে আমরা চেক ইন করে নেই হোটেলে; তারপর যতো খুশি ইচ্ছা দেখো এই ফেরারি । এই শো রুমটি তো আছেই এখানে। শুধু দেখবেই কেন? কাল সকালে যখন এই শো রুমটি খুলবে, তখন ভেতরে গিয়ে হাত দিয়ে ধরেও দেখো । ছবিও তুলে দেব এটির সাথে তোমাদের।
দু’জন প্রায় একই সাথে মুখ ঘোরাতেই দুজনের হাসিমুখের মুখোমুখি হয়ে বুঝলাম যে কথাটি তাদের মনে ধরেছে।
“চলো যাই” বলে সাথে সাথেই দীপ্র ফিরতি হাঁটা শুরু করতে চাইতেই, ওকে থামিয়ে দিয়ে, দুজনকেই বললাম, রাস্তা কি এভাবেই পার হতে হয় নাকি বাবারা? একটু আগে তোমরা যে এইভাবে কোন দিকে না তাকিয়ে দৌড় দিলে, তখন যদি ঐদিক থেকে কোন গাড়ি এসে ঢুকত হোটেলে কি হতো তাহলে, বলো তো?
এ কথায় কাচুমাচু করা দু ভাইয়ের চোখ ঘুরে গেল ডান দিকে, হোটেলে ঢোকার ড্রাইভওয়েটির দিকে । আর ডান দিকেই তাকিয়ে ফের দুজনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠার সাথে সাথে চেঁচিয়ে দুজনেই ঐদিকে দৌড় দিতে চাইতেই , দুজনের কাঁধ ধরে নিবৃত করে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম, কি হল আবার ?
“বাবা, অভ্র ঐ যে দেখো, এস্টন মার্টিন” ফের তুমুল উত্তেজনায় দীপ্র চেঁচিয়ে ডান দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই
‘ভাইয়া, বাবা, মাজারাতি!’একই সাথে একই রকম উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠে অভ্রও একই দিকে নির্দেশ করাতে অবশেষে হোটেলে ঢোকার ডানদিকের রাস্তাটি, ঐ পাশের মূল যে রাস্তাটি থেকে এদিকে ঢুকেছে তার ওপাশে তাকাতেই হলো আমারো।
দীপ্র বলল “চলো না বাবা ওইদিকটায় একটু ঘুরে আসি, তাহলেই তুমিও বুঝতে পারবে কোনটা কোন গাড়ি”-না বাবা , এখন না । চল আগে হোটেলের রুমের দখল নেই । বলেই দুপুত্রকে টেনে নিয়ে হাঁটা ধরলাম একটু আগে পিছু ফেলে আসা আমাদের সুটকেস গুলোর দিকে, যেগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে লাজু আর হেলেন। ‘দিস হোটেল ইজ রিয়েলি কুল’এসময় হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠলো অভ্র! অভ্রর এ কথায় পেশাগত কারনে নিজের ভেতরে তৈরি হওয়া বিপণন ভাবনার ভাবুক মন চনমনিয়ে উঠলো খুশিতে, এই ভেবে যে, বাহ বিপণনের বিখ্যাত প্রথম পি, মানে প্রোডাক্টের সাথে চতুর্থ পি মানে প্লেসের চমৎকার যোগসূত্রটি তো ধরে ফেলেছে এরই মধ্যে আমার ছোট পুত্রটি, এ বয়সেই! দামী হীরা বিক্রি করার দোকান যে কেউ ঢাকার চকবাজার, ঠাটারি বাজার বা এমনকি গাউসিয়ায় খুললে যেমন চলবে না, তেমনি খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর বা সৈয়দ বংশের গাড়ির শো রুমের এলাকার এই রিজেন্ট হোটেলেও যে একই রকম উঁচু বংশের হতে বাধ্য, কী চমৎকারভাবে নিয়ে নিল অভ্র সে সিদ্ধান্ত! ‘এই এদিকে আয় তো দেখি তোরা দু জন ‘নিজেদের সুটকেসগুলো ফের হাতে নিয়ে দু ভাই প্রস্তুতি নিতেই, রাগতস্বরে হুকুম জারী করলো লাজু। বুঝলাম কপালে খারাবি আছে দু জনের এ মুহূর্তে লাজুর হাতের নাগালে গেলেই। নির্ঘাত লাগাবে ওদের দু তিন ঘা ও।
বুঝে গেছে তা ওরাও। ঘ্যান ঘ্যান করে তাই দীপ্র বলল ‘অভ্রই তো প্রথম দৌড় দিয়েছিল, আমি তো দেখিনি ফেরারি টা’। বড় ভাইয়ের কথার কোন প্রতিবাদ না করে ঘাড় নিচু করে চুপ করে থেকে অপরাধের স্বীকারোক্তি দিচ্ছে দেখছি অভ্র।
কিন্তু এই ঠা-ায় দাঁড়িয়ে নতুন কোন হাংগামায় পড়ার মেজাজ নেই এখন। সকলের উদ্দেশ্যে তাই বললাম বিচার আচার সব হবে পরে, চল আগে ঢুকি হোটেলে। বলেই ডানে একবার তাকিয়ে কোন গাড়ি আসছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে, হাঁটা ধরলাম হোটেলের গেইটের দিকে। সাথে সাথে পেছনে না তাকিয়েও নানান জনের সুটকেসের চাকার আওয়াজে টের পেলাম আসছে সবাই পেছনে পেছনে।
হোটেলের গেটের সামনে গাড়ি থামার জায়গাটিতে গিয়ে সুটকেসগুলো মেঝেতে রেখে দাঁড়ালাম পেছনের বাকি সবার আসার অপেক্ষায়। হোটেলে ঢোকার মূল গেইটটি অর্ধবৃত্তাকার, যাতে লাগানো আছে স্বয়ংক্রিয় বৃত্তাকার কাচঘর, যার দু দিক খোলা আর দু দিক কাঁচে ঘেরা। সারাক্ষণ ঘুরতে থাকা ঐ বৃত্তাকার কাচঘরের খোলা অংশটি, গেইটির মুখে মুখ লাগাতেই টুপ করে ঢুকে যেতে হয় ওতে, অতপর সেই কাচঘর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট সময় পর ঘুরে গিয়ে কাঁচ লাগানো অংশটি গেইটের মুখে লাগিয়ে দিলেই আপনি ঢুকে গেলেন ভেতরে। এই হল এই জাতীয় গেইটের তেলেসমাতি।
সুটকেসগুলো মেঝেতে রেখে বাকীদের আসার অপেক্ষায় সোজা হয়ে দাঁড়াতেই, এরই মধ্যে ঐ বৃত্তাকার মূল গেইটের পাশে থাকা ছোট্ট আরেকটি কাচের গেইট ঠেলে কেতা দুরস্ত স্যুট কোট পড়া এক চায়নাম্যান বেরিয়ে এসে মেঝেতে রাখা সুটকেস দুটোর হ্যান্ডেল ধরে চি চি করে চিংলিসে বললেন-“ওয়েল কাম তু লিজেন বেইজিং”। আর কিছুটা বো করে হাতের ইশারায় আমাকে ভেতরে যাওয়ার জন্য বললেন অত্যন্ত তমিজের সাথে। তাকে ধন্যবাদ বলে, হাতের ইশারায় পরিবারের বাকিদের দিকে ইঙ্গিত করে একটু অপেক্ষা করার জন্য বলতেই -সুটকেস ছেড়ে ‘ওকে’ বলে, মূল গেইটের পাশের যে কাচের দরজাটি ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল, সেটি ঠেলে ফের ভেতরে চলে যেতেই ভাবলাম, আরে আমি বললাম কি আর তুই বুঝলি কি ? তুই চিংলিশ বলার পরও তো, ডরে আমি কই নাই আমার বাংলিশ। বরং কইলাম কতা দেহভাষায়, তাও তুই বুঝলি উল্টা বেটা চেঙ্গিস খান, নাকি জিং পিং, না পিং পং। এতো দেখছি মহা মুশকিল।এ যদি হয় খোদ বেইজিং এর খানবাহাদুর, রায়বাহাদুর হোটেল রিজেন্টের বেলবয়ের অবস্থা, কপাল তো তাহলে ফিরছে না দেখছি সহসা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক