দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

চিত্রকল্প নয় সচিত্র
বাসের তলপেটে নিজেদের তল্পিতল্পা গুছিয়ে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দুজনের চেহারা মোবারক দৃষ্টিগোচর হতেই আনন্দিত হলাম। নাহ তাদের জামা কাপড় যে লিঙ্গেরই হোক না কেন, বা হোক না কেন তা ফ্যাশনের তৃতীয় লিঙ্গেরই , নিজেরা তারা যে তৃতীয় লিঙ্গের নন সেজন্যই আনন্দিত হলাম তা কিন্তু নয়। আবার সেটা যে একবারেই নয় তা’ই বা বলি কিভাবে? যতই চিন্তায় চেতনায় নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করি না কেন, তৃতীয় লিঙ্গ হল এক প্রাকৃতিক সত্য ও স্বাভাবিক ব্যাপার; কিন্তু সোজাসুজি না হলেও কেমন যেন ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে আশৈশব সমাজ আর ধর্ম থেকে তো শিখেছি যে তারা অস্বাভাবিক। এমন কি শুধুই অস্বাভাবিক নয়, তারা এক্কেবারেই অসত্য না হলেও চূড়ান্ত অভিশপ্ত ও অপবিত্র, অতএব অপাংক্তেয়। তাই এই বাসে এখন হঠাৎ দু’জন তৃতীয় লিঙ্গের কেউ উঠলে অন্যদের কি হবে জানি না, তবে বোন স্ত্রী-পুত্র সমেত বসে থাকা আমার যে কিছুটা অস্বস্তি লাগবেই, তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার না করলে তো হতে হবে মিথ্যাবাদী! নিজে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির এমন দাবি করেছ না, তারপরও এরকম অসত্য গলাবাজি যায় না। এছাড়া পাড়মিম্যুক ইংরেজিতে যাদের সম্ভবত বলে প্যাথলজিক্যাল লায়ার, তাদের কথা কিম্বা অন্যদের জানি না, নিজে তো নিজের কাছে বলা মিথ্যা হজম করতে পারি না মোটেই, হজমের অসুবিধার কারণে। অজানা ব্যাপারে মানুষের অকারণ ভীতি থাকে প্রবল, অতএব সে ভীতিটি যদি থেকেই থাকে আমার তাকে তো আর দোষ দেয়া যায় না। তবে মূল কথা হল চেহারায় বুঝলাম দুজনেই পশ্চিমা কোন দেশের । এঁদের দেখে আনন্দিত হবার সেটাই প্রথম কারণ।
না এর মানে এই নয় যে পশ্চিমারা আমার মতো বাঙ্গালের আপন কেউ, বরং ঘটনা তো উল্টা। শত শত বছর আমাদের ন্যাটিভ বলে হেয় জ্ঞান করে, ভয়াবহ শ্বেতসন্ত্রাস, অত্যাচার, অনাচার আর লুটপাট করে নিজেদের গোলাসমৃদ্ধ করে, নিজেরা সভ্য হওয়ার ভান করে এখন যতই তারা মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে ঘুরে বেড়াক না কেন, মনে মনে তারা যে এখনো আমাদের বলে ‘ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে’, এ ব্যাপারে এ বাঙ্গাল সম্যক অবহিত। আসল ঘটনা হলো এ কয়দিন মনে মনে অনেক খুঁজেছি ভিন্ন রং আর চেহারার লোক, দেখেছি যা খুবই নগণ্য। যার কারণে এখনকার ভ্রমণকারীদের ব্যাপারে একটা হাইপোথেসিস যে দাঁড় করিয়েছিলাম মনে, তা এক্কেবারে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাশ করে গেলে, জমে না তো খেলাটা। তাই এখন আবার ভিন্ন চেহারা আর রংয়ের মানুষ দেখে ভালই লাগল । মানে এ আনন্দ হলো ভিন্নতার আনন্দ, মানে ভিন্ন কিছু চোখে পড়ার আনন্দ। জানি না এই জন্যই কি প্রকৃতি প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি করে ভিন্নতা বা ইংরেজিতে যাকে সাধারণভাবে বলে ডাইভারসিটি, জীববিদ্যার ভাষায় ভ্যারিয়েশন। এ মুহূর্তে এখানকার এই ভিন্ন চেহারা দু’জন আমাদের দল সামান্য হলেও ভারী করার জন্য, নিজেদের ভারী অস্থাবর সম্পত্তিসমূহ বাসের তলপেটে সমর্পণ করে শুধু পিঠব্যাগ সম্বল করে অকুস্থল ত্যাগ করতে দেখে, আমারো চোখযোগ আর মনোযোগ দুটোই ফিরে এলো এসময় বাসের ভেতরে ।
আর দ্বিতীয় যে কারণে এই আনন্দের উদয় হলো মনে, তা হল ঐ যে বাসের তলপেটের ডালাটি অবশেষে খুলতে দেখা।
ইতোমধ্যে সেই হুসসস শব্দটির পিঠাপিঠি দরজার ধাতব ঘটাং শব্দটি কানে যেতেই সামনে না তাকিয়েও বুঝলাম-সেই পশ্চিমাযুগল উঠছেন বাসে। বাসে ওঠেই কোনদিকেই না তাকিয়ে আমার সামনের এক সিট আগের খালি সিটে বসে পড়লেন দুজনেই। ওরা দুজন বসে পড়তেই বাসের ভেতরটা দ্রুত একবার চোখ জরীপ করতেই বুঝলাম, একটু আগে ওঠা চায়নিজ দলটিও ইতোমধ্যে বসে পড়েছে যার যার পছন্দের সিটে।এদিকে বাসের তলপেটে অবস্থানরত আমাদের মালামালের নিরাপত্তার ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চয়তা পেয়ে যাওয়ায়, নিজেও আইলের ওপাশে অভ্র আর লাজুর সামনের খালি সিটে বসার জন্য উঠতেই, অভ্র মনে করিয়ে দিল তার পাওয়ার ব্যাংকের আবদারটি। অতএব ওর আবদারটি পূরণ করেই আসন নিলাম ওদেরই সামনের সিটে ।
‘কি ব্যাপার ? ঐ দিক থেকে চলে আসলে যে? যদি কেউ নিয়ে যায় আমাদের কোন ব্যাগ বা সুটকেস’ পেছন থেকে লাজু হাহাকার করে উঠতেই ভাবলাম, আচ্ছা শাখের করাত বাগধারাটার প্রতিবাগধারা স্ত্রী অনুযোগ হওয়া উচিৎ। শাখের করাত তো আসতেও কাটে যেতেও কাটে, তারমানে হলো সামনে পেছনে কাটে ; কিন্তু স্ত্রী অনুযোগ তো দেখছি স্বামী যেদিকে যায় সেদিকেই ধায়। সামনে পেছনে, পূর্বে পশ্চিমে, উত্তরে দক্ষিণে, ঈশানে নৈঋতে, অগ্নিতে বায়ুতে, ঊর্ধ্বে গিয়ে বা অধঃগামি হয়ে, মানে কোনদিকেই গিয়ে ঐ স্ত্রী অনুযোগ নামের করাতের হাত থেকে রক্ষা নাই স্বামীর। একটু আগে ঐদিকে বসলাম কেন এ নিয়ে পড়লাম তীরের মুখে, এখন সামনে এসে বসে এক্কেবারে ঘাড় দিয়ে দিলাম কি না খাঁড়ার নীচে। অতএব একমাত্র মাথাটি রক্ষাকল্পে বললাম -শোন ঐ গুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়াতেই এসেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম ড্রাইভার বুঝি সারাক্ষণই ঐ তলপেটের ঢাকনাটা খুলে রাখে, এখন দেখে বুঝলাম যে না শুধু কাজের সময়েই তলপেটের ঢাকনা খুলে আর কাজ শেষে বন্ধ করে দেয় সাথে সাথে-‘কি ফালতু কথা বলছ? বাদ দাও তো আজে বাজে কথা’! এবার আর অনুযোগ না এক্কেবারে সাক্ষাৎ খাড়ার নিচেই পড়লাম আর কি। ভাবলাম হায়রে কি দোষ যে করলাম, বুঝতেই তো পারলাম না। আগেই তো বলেছি দশদিকের কোন দিকে গিয়েই যে রক্ষা নাই স্বামীপ্রবরের, তবে তার প্রমাণ যে এরকম এক্কেবারে হাতে হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে, তা তো ভাবিনি, ঘুণাক্ষরেও !
প্রাণের মায়া বড় মায়া। অন্যসময়ে না বুঝলেও খাড়ার নীচে মাথা পড়লে যে তা সাথে সাথে বোঝা যায় বুঝলাম তা। অতএব ঝটিতে বুঝে গেলাম এ মুহূর্তে খাড়ার নীচে মাথা যাওয়ার কার্যকারণ। ঐ যে বাসের ‘তলপেট’ শব্দটি বলেছি সেটাই এই নটঘটের কারণ। হায়রে আমার কপাল, আমাশা রুগি ছাড়া দেখছি আর কারো তলপেট চেপে দৌড়ানো বা তলপেট মোচড়ানোর কথা বলা তো দূরের কথা, পেটের ঐ ভগ্নাংশটির নাম উচ্চারণ করাই নিষিদ্ধ দেখছি! স্থান কাল পাত্রভেদে আরো কিছু শব্দের উচ্চারণ বিষয়ক আমাদের সমাজে নিরব সংস্কারটি সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই অবহিত হয়ে গেলেও, সেটি যে এই তলপেটের ব্যাপারেও প্রযোজ্য সে জ্ঞান অর্জনের জন্য কিনা অবশেষে আমাকে চীনেই আসতে হলো! সাধে কি আর বলা হয়েছিল জ্ঞানার্জনের জন্য চীনগমনের কথা !
আচ্ছা তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমি তো মজা করে প্রতীকীভাবে শব্দটি বলে জীবনে একটু সাহিত্য মিশাতে চেয়েছিলাম। মহৎ সাহিত্যকে যদি জীবনঘনিষ্ঠ হতে হয়, তাহলে জীবনে যদি সাহিত্যের অনুপ্রবেশ ঘটানো যায়, তাহলে তো তা হয়ে যাবে মহৎ জীবন। যদিও সেই মহৎ জীবন ছোটবেলায় পড়া ডাঃ লুৎফর রহমানের লেখা মহৎ জীবন হবে কি না তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে আমার ।
আরে রাখো তোমার জীবনে সাহিত্য মিশানো। সেই ৯৩/৯৪ সালে একটা মাত্র চটি ছড়ার বই নিজের পকেটের টাকায় ছাপিয়ে, নানান জনের কাছে জোরজার বিক্রি করে, আর পরিচিত বন্ধুজনদের বিনা পয়সায় গছিয়ে দিয়ে ঘর খালি করে এখন তো লিখছেন আপনি শুধু দেয়ালে, তাতেই বুঝি হয়ে গেছেন সাহিত্যিক? আরে মিয়া মহাকবি কালিদাসই তো পাত্তা পায়নি স্ত্রীর কাছে। সেখানে আপনি কোথাকার কোন হরিদাস পাল? এক্কেবারে খেকিয়ে বলে উঠলো নিজেরই ভেতরের দ্বিতীয়জন।
মনের দ্বিতীয়জন কালিদাস পণ্ডিতের কথা মনে করিয়ে দিতেই, মনে হল হায় রে আসলেই তো আমি কোন ছাড়? মহাকবি কালিদাসই তো স্ত্রী আজ্ঞার নানামুখি আক্রমণে বেদিশা হয়ে একবার এক্কেবারে যে ডালে বসেছিলেন সে ডালই কাটতে শুরু করেছিলেন। তবে হ্যাঁ গল্পে আছে স্ত্রী বরে না হলেও, স্ত্রীর আজ্ঞায় বেদিশা হয়ে জীবননাশ করার সঙ্কল্প করার পরই নাকি ‘মেঘদূত’, ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ এসব লেখার মুরোদ হয়েছিল কালিদাসের। অবশ্য এসব লেখার পর স্ত্রীরহস্তে কালিদাসের জীবননাশ না হলেও আর কোন দুর্গতি হয়েছিল কি না, তা তো জানি না। কারণ যক্ষপ্রিয়ার যে বর্ণনা দিয়েছেন পণ্ডিত, তাতে তো তলপেট না শুধু, আরো অনেক নিষিদ্ধ অঙ্গেরই চিত্রকল্প না শুধু সচিত্র বর্ণনাই আছে। অবশ্য শুনেছি যে সংস্কৃত নামের দেবভাষায় নাকি শুধু রাজরাজড়া আর পুরোহিতগণেরাই কথা বলতেন, আর তাতে রচিত হতো কাব্য। তাই হয়তো কালিদাস পত্নী টের পাননি কি মহাকর্মটি করেছেন তার অকর্মা স্বামীটি, তাতেই হয়তো তাঁর প্রাণরক্ষা হয়েছিল। সেখানে এই বেকুব অধম খাঁটি বাংলায় তলেপেটের কথা উল্লেখ করি কোন সাহসে? হোক না তা যতই একটা ভোমা সাইজের পরিবহন যন্ত্রের।
হুসসস ও তৎপরবর্তী ঘটাং শব্দের যুগলবন্দী এসময় ফের কানে যেতেই বুঝলাম , বাসে উঠতে যাচ্ছেন আরো এক বা একাধিক নতুন যাত্রী। অতএব নিজের মনে নিজেরই তৈরী সেই টুরিস্ট বিষয়ক হাইপোথিসিসটির উপাত্ত সংগ্রহের নিমিত্তে চোখ আর মন যুগলবন্দী হয়ে নিবদ্ধ হলো বাসের গেইটের দিকে ।
হ্যাঁ এবারেও উঠছেন দেখি একের পর এক নানান বয়সী চায়নিজ নারী ও পুরুষই। ক’জন হবে? গুণবো নাকি? আরে ধ্যাত গুনে আর কি হবে। এ বাসে এখনো ঢের জায়গা আছে। আর এ নিশ্চয় আমাদের দেশের শহর এলাকার বাসের মতো বাদুরঝোলা করে যাত্রী বোঝাই করবে না। আর করলেই বা কি? আমরা তো পেয়ে গেছি সিট। অবশ্য এই বাসের বাইরে আর ভেতরে যে অভিজাতভাবটি আছে, তাতে এটিতে বাদুরঝোলা করে যাত্রী তুললে এর সম্মানেরহানিই হবে। নানান দেশে বিশেষত ইউরোপে যেসব বাসে চড়েছি এ পর্যন্ত, সেগুলোর সমগোত্রীয়ই এই বাসটিও। আর ঐ সমস্ত বাসগুলোর বেশীরভাগই তো মনে হয় মার্সিডিজ বাস ছিল। আচ্ছা এ বাসটি কি জাতের বাস বা কাদের তৈরি তা তো জানি না!
কুছ পরোয়া নেই। এ ব্যাপারে দু বিশেষজ্ঞ তো আমার পেছনের সিটেই বসে আছে পর পর । আমরা যতই হিমে কাবু হয়ে আর দ্রুত হোটেলের ফেরার তাগিদে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে থাকি না কেন, আমাদের দুই বিশেষজ্ঞ নিশ্চয় তাদের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির ব্যাপারে জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে কোন অবহেলা করেনি। অতএব বাসের সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ঘুরে পুত্রদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম-আচ্ছা বাবারা, তোমরা কি দেখছো এই বাসটা কোন ব্র্যান্ডের? ‘দেখেছি কিন্তু পড়তে তো পারিনি, সবই তো চায়নিজ’। এলো উত্তর যুগলবন্দী।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষের অধিকার, গণসচেতনতা এবং …
পরবর্তী নিবন্ধবাবার নামে সাত খুন মাফ