দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

‘যত মুশকিল তত আসান’

যদিও যাদুঘর দেখার জন্য যে সময় ধার্য করে রেখেছিলাম মনে মনে, তার চেয়ে মিনিট পনের বা বিশ বেশিই সময় লাগল , তাতেও অসুবিধা ছিল না , যদি ঘটিত এ দেখার মধুরেণ সমাপয়েৎ। কিন্তু তা আর হল কই? তা যে হলো না তার প্রমাণ হিসাবে যাদুঘরের ঐ পুনর্জীবন নাকি পুনর্জাগরনের পথ নামীয় অংশ থেকে বেরুতে বেরুতে গজ গজ করতে থাকল হেলেন আর দীপ্র। একবার ভাবলাম বলি ওদের যে এ তো চায়নার তেমন কোন বড় ঘটনা নয়। বড় ঘটনা তো বরং ঘটিয়েছিলাম আমরা। ১৯৭১ এ, এ বিশ্বের দুই বৃহৎ মোড়লকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঠিকই যে স্বাধীন হয়েছিলাম আমরা, সেটাই তো বড় বাস্তবতা। তারচেয়েও বড় বাস্তবতা হল আজকের চায়না আমাদের অগ্রাহ্য তো করতে পারছেই না বরং রাখতে হচ্ছে তাদের গোনার মধ্যে। হউক সে কারণ ভূরাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক যা ইচ্ছা তাই। কিন্তু তা আর বলা হল না, কারণ হাঁটতে হচ্ছে জোরে অভ্রকে নিয়ে ওর প্রাকৃতিক ডাকের তাড়নায়।

সবাইকে পিছু ফেলে যাদুঘরে প্রবেশ আর বহির্গমনের মূল হলে ঘরে এসে চারদিকটা দ্রুত জরীপ করতেই হল ঘরের এই অংশেরই বা দিকটায় দেখা মিলল প্রাকৃতিক ডাক ঘরের, মানে রেস্টরুমের চিহ্নের। পেছন ফিরে সবার উদ্দেশ্যে আমাদের দুজনের আপাত গন্তব্য যে সেইদিকে, তা জানাতেই বোঝা গেল কম বেশী সকলেরই পড়েছে সেই ঘরের যাবার ডাক। অতএব দু ভাগে ভাগ হয়ে সেই দিকেই রওয়ানা করলো দলের সবাই।

প্রাকৃতিক ডাক ঘর থেকে ফেরার পর, যাদুঘরের এই ওম ওম আরামের উষ্ণতা ছেড়ে, বাইরের তীব্র ঠাণ্ডার হিমসাগর ঝাপ দেয়ার প্রস্তুতি হিসাবে দু পুত্রের মাথায় কানে মাফলার পেঁচিয়ে, জ্যাকেটের হুড মাথায় বসিয়ে চেইন লাগিয়ে ওদেরকে হাতে গ্লাভস গলিয়ে নিতে বলে, নজর দিলাম নিজের প্রস্তুতির দিকে।

“আচ্ছা এখন বেরিয়ে যাবো কোথায় আমরা? রেস্টুরেন্টে নাকি? দুইটার বেশী বেজে গেছে। ওদের তো খিদে পেয়ে যাওয়ার কথা ” পুত্রদের ব্যাপারে উদ্বেগ ঝরে পড়ল লাজুর

হুম, তা জানি। তবে এদিকে তো আর দ্বিতীয়বার আসা যাবে না। অতএব এখান থেকে বেরিয়ে, ঐ যে বলেছিলাম না, তিয়েনআনমেন স্কয়ারের একদিকের মাঝের জায়গাটায় মাওয়ের ছবি লাগানো, চাইনিজ স্টাইলে বানানো লালদালানটা,ওটাতে ঢুকবো। এখান থেকে খুব বেশী দূর না। ওখানে ঢোকার পর বেশী সময়ও নেব না। দ্রুত দেখে, বিশেষত মমি করে রাখা মাওকে দেখে বেরিয়ে যদি আশেপাশেই পেয়ে যাই কোন ম্যাক বা ঐ জাতীয় কোন ফাস্ট ফুডের দোকান তবে তাতেই ঢুকে পড়ব লাঞ্চ করার জন্য। আর যদি না পাই আশেপাশে ওরকম কিছু, তখন তো ডাকতে হবে আমাদের শোফার লি খাঁ কে। রেস্টুরেন্ট পেতে দেরী হলে তোমার ব্যাগে যা রসদ জমা আছে তা থেকে কিছু খাইয়ে দিও বলতে বলতে সবাইকে নিয়ে এগুতে লাগলাম যাদুঘরের এই বিশাল হল ঘর থেকে বাইরের বিশালতর তিয়েনআন মেন স্কয়ারমুখি নিষ্ক্রমণ দরজার দিকে।

“আচ্ছা দাদা, ড্রাইভার কে এখন ডেকে আনা যায় না? গাড়ী করে যাই না আমরা ঐ দিকে “হিমকাতুরে হেলেনের আব্দার ফের আরে নাহ, এদিকে কোন গাড়ী চলাচল করতে দেয় না মনে হয়। বাইরে কি কোন গাড়ী দেখেছিস? বলতে বলতে পুত্রদের বগলদাবা করে হল ঘর থেকে বের হবার নির্দিষ্ট দরজাগুলো একটার দিকে এগুলাম, যে গুলোর নাম দেয়া যায় ডিজিটাল যুগের উপস্থিতি ফাঁক দরজা। হ্যাঁ আলিবাবার যুগে পাহাড়ের গাঁয়ের চোরা দরজা খুলতে “সিসিম ফাঁক” মন্ত্রোচ্চারণ করতে হলেও, আজকাল যে কোন জনসমাগমের জায়গা বা পাবলিক প্লেসে, ওসব জায়গার দরজাগুলো মানুষের উপস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে যেহেতু খুলে যায় অবলীলায়, এ আকেলমন্দ দরজাকে উপস্থিতি ফাঁক দরজা বললে কী খুব একটা ভুল হবে?

দরজা বাইরে, করিডোরে পা রেখে মনে হল যতোটা হিমের ধাক্কা খাবো বলে মনে মনে কঠিন একটা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম সেটা কাজে দিল বুঝি! হ্যাঁ ঠাণ্ডার ধাক্কা খেলাম বটে, কিন্তু হকচকিয়ে গেলাম না তাতে। বাকীদের দিকে নজর দিয়েও মনে হল হয়নি কেউ কাবু ততোটা। অতএব মহাউৎসাহে যাদুঘরের চাতাল ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে গেলাম ডানদিকের খোলা রাস্তার দিকে।

নাহ! নিজ মনের সে ভুল বা বিভ্রম ভাঙ্গতে সময় লাগলো না! যাদুঘরের চাতাল ছেড়ে খাঁ খাঁ জনশুন্য ছাই রঙয়ের ঘন ধোঁয়াশার চাদরে মোড়া খোলা তিয়েনআনমেন চত্বরের ডানদিকের হাঁটা রাস্তায় পা দিয়েই টের পেলাম, যতোই নিয়ে থাকি প্রস্তুতি মনে মনে, সবই উড়ে গেল কোথায় কে জানে এক ধাক্কায়। আমাদের দেশে তো জানি হিম হাওয়া আসে উত্তর দিক থেকে। এখানে তো মনে হচ্ছে, আসছে হাড় হিম করা হাওয়া চারদিক থেকেই! এমনিতেই নিজে দিককানা, আর এখন এখানকার এই পাগলা হিম হাওয়ার তোড়ে মগজের নিউরনে নিউরনে চলতে থাকা ইলেকট্রিক বার্তা গেছে তো বুজি জমে!

যদিও মাফলার আর হুডের ফাঁক দিকে যতোটুকুই খোলা আছে চামড়া মুখের, হিম প্রথম ধাক্কাতেই তা অসাড় হয়ে যাওয়ায় ওখানটায় আর টের পাচ্ছি না কিছু, কিন্তু দস্তানাহীন হাতের আঙুলের হাড়গুলো সব ঠাণ্ডার কামড়ে মনে হচ্ছে ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে গেছে বুঝি এরই মধ্যেই। ফলে চাচা আপন প্রান বাঁচা সূত্র ধরে নিজেরই অজান্তে হাত দুটো ততোক্ষণে পুত্রদ্বয়ের কাঁধ ছেড়ে ঢুকে গেছে জ্যাকেটের পকেটে।

‘বাবা, বাবা, আমার হাতে ব্যাথা করছে “পাশ থেকে এসময় কঁকিয়ে উঠলো অভ্র। আসলে ওকে দিয়ে দেওয়া আমার দস্তানাগুলো ওর ছোট্ট হাতে তো ঢলঢল করছে। ফলে সেই দস্তানার ফাঁকফোঁকড় দিয়ে হুড়মুড় করে হিম ঢুকে বেচারাকে একদম নাকাল করে ফেলছে। দ্রুত তাই দু পুত্রকেই বললাম বাবা ঢুকিয়ে ফেল হাত জ্যাকেটের পকেটে।

“ওহ মাগো ঐ পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে! এখন তো মনে হয় ঠাণ্ডা আরো বেড়েছে। আমি পারবো না মনে হচ্ছে ঐ পর্যন্ত হাঁটতে।“হেলেন পেছন থেকে কঁকিয়ে উঠতেই, সাথে সাথে তাতে ভাবীরও বিরল সমর্থন মিলতেই প্রমাদ গুনলাম।

যতোই ভ্যাবাচাকা বা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যাই না কেন এতে মনে মনে, বাতাসের ঝাপটা এড়ানোর জন্য মাথা নিচু করে দ্রুত সামনে এগুতে এগুতে, মুখে সবাইকে সাহস দেয়ার জন্য বললাম, চল সবাই পা চালাই জোরে। ঘণ্টা দুয়েক আগেই তো এই এলাকার এই ঠাণ্ডায় হেঁটে হেঁটেই সবাই ঢুকেছিলাম যাদুঘরে। তখন যতোটা হাঁটতে হয়েছিল এখন তো আর ততোটা হাঁটতে হবে না। একবার ওখানে ঐ মমিঘরে গিয়ে পৌঁছুতেই পারলেই হল। তারপর আর থাকছি না এই খোলা চত্বরে। ডেকে আনব শোফার লি খাঁ কে। আজকের দিনের বাকী ঘোরাঘুরি গাড়িতেই বসে হবে।

আসলেই ঠাণ্ডার প্রকোপ বেড়েছে কিনা, তা তো জানি না। তবে বাতাসের তোড় যে বেড়েছে ঢের এই ঘণ্টা দুই আড়াই ঘণ্টা আগে থেকে তা নিয়ে কোনই সন্দেহ নাই। হিম যে এখন শুধু মুখের সামান্য খোলা অংশেই হুল ফুটাচ্ছে, তা তো নয়। বাতাসের তোড়ে সারা গায়ের তিন চার স্তরের গরম কাপড় ভেদ করে এক্কেবারে দেখছি তা ফোটাচ্ছে হুল হাড়ে হাড়ে। তাতে এই ধোঁয়াশার মধ্য দিয়ে মাথা নিচু করে জোর কদমে এগুতে গিয়ে চোখে এক্কেবারে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করেছি নিজেই।

“নাহ, আজ আর না । এখন বরং চল ফিরে যাই হোটেলে। “ঘোষণা এলো লাজুর-পেছন ফিরে নিয়ম মেনে বললাম, ঠিক আছে তাই করবো। কিন্তু বলেছিই তো, আগে তপৌঁছুতে হবে ঐ মমিঘর পর্যন্ত। অতএব পা চালিয়ে চল আরেকটু কষ্ট করে যত মুশকিল তত আসান, বলে যে কথাটি আছে আমাদের , তারই সাক্ষাৎ প্রমাণ কী না মিলল এ সময়ে এই চায়না মুল্লুকের তিয়েনআন মেন স্কয়ারে । সাথে অবশ্য আরেকটা ব্যাপারও প্রমাণিত হল , তা হল চোখ কান খোলা রাখার উপকারিতা । দলের সকলের নানান অনুযোগ অভিযোগের উত্তরে ওদের চাঙ্গা করার জন্য দায়সারা হলেও নানান কথার কথা আওড়াতে আওড়াতে যতোই মাথা নিচু করে সামনে এগুই না কেন, আড়চোখে ঠিকই খুঁজছিলাম এ বিপদ থেকে উত্তরণের কোন আসু পথ পাওয়া যায় কি না। এই ধোয়াশার মধ্যেও মিটার বিশেক দূরের ডানেদিকের ঐ সুড়ঙ্গের মুখ টা দেখে মনে হল বাঁচলাম আপাতত। শুধু যে ঐ টানেল বা সুড়ঙ্গের মুখটিই দেখলাম, তা নয়। যাদুঘরের দিক থেকে হেঁটে আসা দু তিনজন কে ঐ সুড়ঙ্গের ভেতরে হাওয়া হয়ে যেতেও দেখলাম ।

এই যে শোন, চল চল সবাই জোরে, এই তো সামনেই ডানে দেখছি একটা টানেল, বলেই মমিঘর মুখি সোজা হাঁটার বদলে, ডানে একটু গোত্তা, না গোত্তা না কান্নি মেরে হাঁটতে হাঁটতে পিছু ফিরে দলের দুই মহাপারক্রমশালী নারী সদস্যেদেরও জানালাম সুখবরটা যে ঐ টানেল ঢুকে পড়লেই নিশ্চিত বাঁচা যাবে এই হিমছোবল থেকে।

চরম বিপদেও সামান্য একটু খানি আশারবাণীও যে মানুষকে উদ্দিপ্ত করতে পারে অনেক গুণ, তার প্রমাণ পাওয়া গেল। একটু আগে শোনানো আশ্বাসবাণীতে সকলের মধ্যে একটা বাড়তি গতি সঞ্চারিত হতেই। অতএব দ্রুতই সেই সুড়ঙ্গে সবাইকে নিয়ে ঢুকে পড়া গেল সবাইকে নিয়ে।
লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের জীবনে শিক্ষা-দীক্ষার সমন্বয়
পরবর্তী নিবন্ধশেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক