কি আশ্চর্য মনের ভাবগতিক! যখন পরিষ্কার জানি যে , মানব সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হতে শুরু করেছিল মাত্র দেড় হাজার বছরের সামান্য কিছু আগে, আর আফগানিস্তানের জনপদের বয়স তো তার চেয়ে ঢের বেশী। ফলে তার আগে তো ওখানকার মানুষজনের ভিন্ন কোন ধর্মের অনুসারী হওয়ারই কথা। তারপরেও অবচেতনে কেন জানি বদ্ধমূল একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, অনাদিকাল ধরেই তারা বুঝি মুসলমান ছিল! এ ব্যাপারে একটাই ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারলাম এ মুহূর্তে, আর তা হল, যে আমার নিজেরই সচেতন আর অবচেতন মনের একটি বিচ্ছিন্নতা ছিল এ ব্যাপারে বহুকাল। আচ্ছা নিজেরই ভেতরে এরকম বিচ্ছিন্নতা সকলেরই কি থাকে? আর যদি থাকেই তবে ঐ ব্যাপারে মনোবিদ্যার দিকপালদের সিদ্ধান্তটিই বা কি?
বুদ্ধের পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ এই ঘরটির অন্য অংশের দিকে এগুতে এগুতে মনে পড়ল যেদিন টিভির সংবাদে হঠাৎ করেই দেখতে পেয়েছিলাম যে কি প্রবল ক্রোধ আর আক্রোশে তালেবানি জঙ্গিরা, ধ্বংস করছে প্রাচীন বামিয়ান সভ্যতার তৈরী পর্বতের গায়ের বিশাল সব বৌদ্ধমূর্তিগুলো; তার আগে ঘুণাক্ষরেও তো ভাবিনি যে আফগানিরা কখনো বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হতে পারে ।
আচ্ছা কেনই বা ঐ রকম মনে করেছিলাম? আসলে বেশীরভাগ সময়ে আফগানদের নিয়ে যে সব গল্প আর পাঠ্য ইতিহাস পড়েছিলাম, তাতে তো আফগান পাঠানদের সার্বক্ষণিক যুদ্ধংদেহী মনোভাবেরই একটি চিত্র দাঁড়িয়েছিল, যার সাথে বৌদ্ধ ধর্মের মতো নিরীহ শান্তিবাদি ধর্ম যায় না বলেই কি ঐ রকম ভেবেছিলাম? সেটাই যদি হয়, তাতেও তো এই ব্যাখাটা যুৎসই মনে হচ্ছে না। কারণ এই আমিই তো পরিষ্কার জানি যে মানুষের ইহলৌকিক জীবনাচরণের সাথে তার পারলৌকিক বিশ্বাস আর চর্চার কোনই যোগ নেই। এ এক আজব প্রাণী মানুষ, যার তুমুল সংখ্যাগরিষ্ঠ খুব সচতেনভাবে এরকম দ্বিচারিতা নিয়ে যাপন করে জীবন মহানন্দে, শুধু দু ‘য়েকজন জীবনানন্দই হঠাৎ হাহাকার করেই “যে জীবন ফড়িঙয়ের দোয়েলের, মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।”
“এই চল যাই অন্যদিকে, এই রুমে এতোক্ষণ থাকলে অন্য কিছু তো আর দেখা হবে না।“ এই স্ত্রীআজ্ঞা কানে যেতেই মনে উদিত হওয়া দার্শনিক আর কাব্যভাবনা দ্রুত পালালো ছুটে দূরে, হাত ধরাধরি করে। সাথে সাথেই তাইতো তাইতো বলে তাকাতেই দেখি, গোটা পরিবার যে একট্টা হয়ে গেছে এ ব্যাপারে তার সাক্ষাৎ নিদর্শন। এতোক্ষণ ওরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছবি তোলাতুলি করতে থাকলেও, এ মুহূর্তে আছে তারা সব একাট্টা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার আশেপাশে।
সবাইকে নিয়ে কক্ষটির বিপরীত দিকের খোলা দরজাটির দিকে কিছুটা দ্রুত পা চালিয়ে এগুতে এগুতে, ফের দেখতে লাগলাম দেয়ালে ঝোলানো আর রুমটির নানান জায়াগায় নানান আকারের চতুষ্কোণাকৃতির আয়তকার, বর্গাকার চমৎকার সব কাচের বাক্সের ভেতর অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে সংরক্ষণ করা, চীনের নানান অংশ থেকে পাওয়া বুদ্ধমূর্তির পুরাকীর্তিগুলোকে শেষ বারের মতো। দেখতে দেখতে ফের মনে হল মাও তার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঢেউ দিয়ে চায়নাতে নতুন সংস্কৃতি বিনির্মাণ করলেও, আর সেটিকে তিব্বতের দালাইলামা সাংষ্কৃতিক গণহত্যা নামে চিহ্নিত করলেও, এই যাদুঘর দেখে মনে হচ্ছে, মাও তার পূর্বপুরুষদের আচার আচরণ সংস্কৃতি একদম লোপাট করে দিতে চান নি। বরং সংরক্ষণ করেছেন তা অনেক যত্নে , যার বিপরীতে আফগানের তালেবানি জঙ্গিরা কি না বোমা মেরে তুমুল ক্রোধে তাদেরই পূর্বপুরুষদের নির্মিত সেই বৌদ্ধ মূর্তিগুলোকে উড়িয়ে দিয়েছে!
আচ্ছা ঐ জঙ্গিদের সেই জান্তব ক্রোধটির লক্ষ কি ছিল শুধুমাত্র ঐ মূর্তিগুলোই, নাকি তারা ক্রোধান্বিত তাদের পূর্বপুরুষদের উপরও? একই সঙ্গে এ কেমন ঐতিহ্য বিরোধিতা ও পূর্বপুরুষদের অস্বীকার করার নির্লজ্জ প্রবণতা তুমুল ধার্মিক ঐ আফগান জঙ্গিদের? যেখানে কী না নাস্তিক্যতাবাদি মাওয়ের চীনেরই যে কোন আস্তিক্যবাদিতার প্রতিই হিংস্র হওয়ার কথা, সে তো তা না করে বরং করছে ওসবের সংরক্ষণ!
অবশ্য আফগান জঙ্গিদের কথাই বা ভাবছি কেন শুধু। আমাদের তো আছে কিছু যাকে বলে খাজুইরা বঙ্গসন্তান। নিজেদের এরা আরবী বংশোদ্ভূত ভেবে ভাতমাছ খেয়ে খাজুইরা ঢেকুর তুলে উষ্ট্রপৃষ্ঠে থাকে সর্বক্ষণ সমাসীন । যেকোন সুযোগেই তারা এটা বোঝাতে উঠে পড়ে লেগে যায় যে, তাদের পূর্বপুরুষেরা আসলে রক্তেকেনা বঙ্গিয় বদ্বীপটির আদি বাসিন্দা নয়। এসেছিল তারা নাকি প্রাচীনকালে ইসলাম প্রচার করার উদ্দেশ্যে এইখানে। ঐসব উন্নাসিকেরা এটাও কখনো ভাবতে পারে না যে, এ জাতীয় বয়ানে তারা নিজেদের পূর্বপুরুষদের আসলে বঙ্গের অনুপ্রবেশকারিদের দলেই ফেলে দিচ্ছে; এসেছিল যারা বনিক বা দস্যুর বেশে, ধনে সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই বঙ্গে । এদেরই উদ্দেশ্যে কি তবে আমাদের একজন আবু জাফর ওবায়েদউল্লাহ দৃপ্ত কণ্ঠে-“আমি কিংবদন্তির কথা বলছি” বলে তাঁর পূর্ব পুরুষদের করতলের পলিমাটির সৌরভ আর পিঠের রক্তজবার মতো দাগের কথা বলেছিলেন সগর্বে ? “বাবা, বাবা, আমরা কি এখন ঐ ঘরটাতে যাবো ?” দরজা দিয়ে বেরিয়ে করিডোরে এসেও দেয়ালে ঝুলতে থেকে পোড়ামাটির তৈরি টেরাকোটা জাতীয় বুদ্ধের মুখাবয়বের শিল্প কর্মগুলোকে দেখতে দেখতে যখন মগজের ভেতরে কেউ দরাজ গলায় আবৃত্তি করছিল আবু জাফর ওবায়েদুল্লাহ , দীপ্রর ঐ প্রশ্নে সে কণ্ঠস্বর থেমে যেতেই, অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করেই ওর কথায় সায় দিয়ে এগুতে লাগলাম ওরই পিছু পিছু পরের খোলা দরজাটির দিকে।
নতুন এই বিশাল ঘরটিতে সবাইকে নিয়ে পা দিয়ে এক ঝটকায় চারদিকে তাকিয়ে বুঝলাম ঢুকে পড়েছি চায়নার ভেতরের আফ্রিকায়। কিছুটা থতমতই খেয়ে গেলাম তাতে । কারণ চায়নায় আফ্রিকা দেখবো এরকম প্রস্তুতি ছিল না মনে ।
হ্যাঁ গোটা কক্ষটির যতোদূর চোখ গেল, সবদিকেই নজরে পড়লো কাঠের তৈরি নানান আকারের জীব জন্তু আর মানুষের ভাস্কর্য, মুখোশ এইসব। মানুষের ভাস্কর্যগুলোর দেহসৌষ্টব আর মুখাবয়ব জোর গলায় বলে দিচ্ছে এগুলোর উৎপত্তি স্থল যে আফ্রিকা তা নিয়ে দ্বিধাই করার কোন অবকাশ নেই।
আচ্ছা এগুলি কী সব পুরাকীর্তি না কি? আর যদি হয়ই তা, তবে এগুলো এলো কিভাবে এই চায়নার মিউজিয়ামে। আগেই তো বলেছি চায়নিজরা কখনও দূর মহাদেশে গিয়ে সেখানে তাদের কলোনি স্থাপন করে লুটপাট চালিয়েছিল এমন কথাতো জানা নেই । আর এ মুহূর্তে সামনে থাকা আফ্রিকান সিংহদলের কাঠের ভাস্কর্যটি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে কিছুতেই এটিকে কোন পুরাকীর্তি মানতে মন সায় দিল না কেন জানি। কারণ এটি দেখে মনে হল এর ভেতর যাকে বলে সেই এন্টিক এন্টিক ভাব, তা নেই । তবে সব মিলিয়ে অতি চমৎকার যে এই ভাস্কর্যটি তা মানতে কোনই দ্বিধা নেই।
এসময়েই মনে হল, আচ্ছা আফ্রিকায় কি পাথরের কমতি আছে নাকি? আর না হয় তাদের শিল্পকর্ম যা দেখছি এখানে এ পর্যন্ত, তার সবই তো দেখছি কাঠভিত্তিক। ভাবতে ভাবতে তখনি সামনের ডানদিকের দেয়ালে সাঁটানো বড় আকারের পোস্টারটির দিকে নজর গেল, যাতে উপরের দিকে বড় বড় চায়নিজ লেখা থাকলেও ঠিক তারই নীচে তারচেয়ে কিছুটা ছোট অক্ষরে হলেও দূর থেকেই পড়া যায় এমন ইংরেজি তর্জমাও আছে । আচ্ছা দেখি না কি আছে লেখা ঐখানে?
অবশেষে সেই লেখা পড়ে বোঝা গেল যে, এইসব আফ্রিকান শিল্পসামগ্রীসমূহ নানান সময়ে চায়নার ক্ষমতাসীন নানান নেতা উপহার হিসাবে পেয়েছিলেন সাব সাহারান আফ্রিকার নানান দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের কেছ থেকে। ঐসব দেশের মধ্যে মালি, আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া, ঘানা, সেনেগাল, সিয়েরে লিওন হল অন্যতম। যার মানে এই দাঁড়ায় যে, যা ভেবেছিলাম শুরুতেই যে এগুলো আসলে পুরাকীর্তি কি না, তা ঠিকই ভেবেছিলাম। অবশ্য সেটাই বা অতো নিশ্চিতভাবে ধরে নেই কিভাবে? এসবের মধ্যে পুরাকীর্তি থাকলে থাকতেও তো পারে কিছু। তবে এতগুলো আফ্রিকান শিল্পকর্মের মধ্যে ঠিক কোন কোন গুলো যে পুরাকীর্তি তা খুঁজে বের করার মতো সময়তো নাই হাতে। অতএব থাকুক সে প্রচেষ্টা মুলতবি আপাতত।তবে পোস্টারের লেখায় চায়না সগৌরবে তাদের সাথে আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে যে অত্যন্ত গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ ডিপ্লোম্যাটিক সম্পর্কের কথা লিখেছে উচ্চস্বরে, তা দেখে মনে পড়লো, এক্কেবারে মাগনা কেউ যে কাউরে খাওয়ায় না এই দুনিয়ায়, এই কথাটির মূল ইংরেজি বাক্যটি মনে পড়লো।
হ্যাঁ আজকের দুনিয়ার বড় অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠা চায়নাকে তো আফ্রিকার এশিয়ার অনেক দরিদ্র দেশই ভাই বলে ডাকতে চাইবে নানা ভাবে। প্রত্যুত্তরে চায়না তো সেই ডাকে সাড়া দিয়ে অকারণেই গদ্গদ হয়ে যাকে তাকে জড়িয়ে ধরে দাদা বলে না। প্রকৃতির অতুল ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত আফ্রিকাকে শত শত বছর ধরে মেরে কেটে লুটে অনেক কিছু ইউরোপ নিয়ে গেলেও, এখনও ওখানে যা কিছুই আছে অবশিষ্ট , তার উপরে অবশ্যই নজর পড়েছে হালের পুঁজিবাদী চায়নার। যার কারণে যতোটা মনে পড়ছে ঐ সমস্ত দেশের নানান সামুদ্রিক বন্দর বিনির্মাণে চায়না প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিষ্কার। আর তা হল উপকূলীয় বন্দরসম্বলিত ঐ সব আফ্রিকান দেশগুলোকে ঋনের জালে আটকে ঐসব বন্দরের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের মাধ্যমে শুধুই নিজেদের বানিজ্যের পথ সুগম করা নয়, বরং সেই বিস্তীর্ণ এলাকায় চলাচলকারী নানান দেশিয় পণ্যবাহী জাহাজের উপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই।
“আচ্ছা এইগুলি চায়নিজ জিনিষ নাকি ?” পেছন থেকে স্ত্রীকণ্ঠ নিঃসৃত এই প্রশ্নটি কর্ণকুহরে প্রবেশ করিবা মাত্রই, সামনের বিমূর্ত জাতের কাঠের যে নারীভাস্কর্যটি খুঁটিয়ে দেখছিলাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা থেকে নিবৃত হয়ে, ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম তা হবে কেন? এ তো সব আফ্রিকান- “চায়নিজ মিউজিয়ামে আফ্রিকান জিনিষ দেখে আর সময় নষ্ট করি কেন? চলো যাই এখান থেকে। চায়নিজ জিনিষ দেখি । ঐ যে দেখো ওরা ঐদিকটায় দাঁড়িয়ে দেখছে ওসব কেমন হা করে। ভাল লাগছে না আমার “
লাজুর এ কথায় চোখ গেল পুত্রদ্বয়ের দিকে । দেখি ওরা দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানের সেই বড় বেদিটির কাছে , যার উপরে সাজিয়ে রাখা আছে বেশ অনেকগুলো নানান আকারের যাকে বলে বাস্তবানুগ নগ্ন আফিকান নারীপুরুষের ভাস্কর্য । পরিষ্কার বোঝা গেল একটু আগে এখান থেকে বেরুবার যে তাড়াটি দিয়েছিল ও, তার আসল কারণ হল ঐ নগ্ন মূর্তিগুলো ঘিরে তৈরি হওয়া অস্বস্তিই।
কথা না বাড়িয়ে তাই দ্রুত এগুতে লাগলাম পুত্রদের দিকে। তবে ওখানে গিয়ে পৌঁছনর আগেই যখন দেখলাম দীপ্র উল্টো দিকের দেয়ালের কাছে মুখোশ দেখা নিয়ে তখনো বিভোর তার ফুপ্পির দিকে কিছু একটা বলতে বলতে কিছুটা দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে, বুঝলাম এতক্ষন এখানে ও দাঁড়িয়ে থাকলেও, বিশেষ কোন কিছুই তার আগ্রহ বা কৌতূহল সৃষ্টি করেনি। শুধু অভ্রই দেখছি স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছয় সাত ফিট লম্বা নগ্ন যুগলের দিকে । নাহ যুগল না, বড় বড় ঝুলন্ত স্তনসমৃদ্ধ ঐ নারী মূর্তিটি হাতে ধরা আছে একটি বাচ্চাও।
কি যে দেখছিল অতো মনোযোগে অভ্র, তা তো ঠাহর করতে পারছি না। তবে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই , আমার ঠিক নাক বরাবর ঝুলতে থাকা ঐ ভাস্কর্যের পুরুষটির বিরাটকায় জননেন্দ্রিয়টি চোখে পড়তেই নিজেরও কি রকম যেন অস্বস্তি লাগলো। অভ্রর হাত ধরে তাই বললাম ,চল বাবা যাই আমরা এখন নিচে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক