দাম ঠিক হয় নামে
ছোঁয়াফোনের পর্দার ঘড়ি আর এই চত্বরের ঝলমলে আলোকসজ্জা বলছে সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। আগেই বলেছি বেইজিং এ আসার পর থেকে সূর্যের মুখ দেখিনি। সারাক্ষণই চারিদিকে লেপটে আছে ছাই রঙ্গয়ের ধোঁয়াশা, অতএব সূর্যঘড়ি অচল এখানে আজো। এ মুহূর্তের সুখের বিষয় হলো একটু আগেই শেষ হয়েছে আমাদের হুতংয়াভিজান। হুতংয়ের ঐ মৈনাক পর্বতের অবিক্রেতাসুলভ ষণ্ডামিমার্কা আচরণ বাদে আর কোন খটমট লাগেনি ওখানে। হুতংয়ের কেনাকাটার অভিজ্ঞতার নিরিখে এখন বলতে পারি বেইজিঙয়ের আধুনিক ঝলমলে মলগুলোর সব বিক্রয় কন্যা ও বালকদের তুলনায় ঐ হুতংয়ের বিক্রেতারাই দেখলাম অনেক চটপটে আর সপ্রতিভ। ঢাকার বংগবাজারের বিক্রেতাদের মতোই এখানকার বিক্রেতারাও , ইয়েস নো ভেরি গুড ,এর সাথে “ক্যান” “ক্যান নত” দিয়ে বেচাবিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় বাৎচিত ভালই চালাতে পারে। তদুপরি গত ক’দিনে রাস্তাঘাটসহ নানান দর্শনিয় স্থানে বিদেশীদের উপস্থিতি খুব একটা নজরে না এলেও, তুলনামূলক ভাবে এখানেই তাদের বেশী দেখা মিলেছে। তাতে এই মুহূর্তে আমার হাইপোথিসিস হল, এই হুতংটিতে নিশ্চয় বিদেশী মানে ইউরোপ আমেরিকানদের আনাগোনা বেশি।
“আচ্ছা, নানানজনকে দেওয়ার জন্য কিছু চকলেট ফকলেটও তো কেনা দরকার। আমি দেখি একটা জুতা নিতে পারি কি না! আচ্ছা ওদেরকে ডাকো না। কতক্ষণ থাকবে এখানকার মার্কেট খোলা? ওহ আদিবের খেলনা আর অভ্রর জন্য ব্যাগ ওতো কেনা বাকি আছে!”
হুতং থেকে বেরিয়ে চত্বরটির কোনায় দাঁড়িয়ে, এটির চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকা শপিংমলগুলোর সামনে চায়নিজ নববর্ষ উপলক্ষে করা সাজসজ্জাগুলোতে নানান রঙ্গয়ের বাতি জ্বলে উঠে চত্বরটি মোহময় হয়ে উঠায়,ওইগুলির সামনে ছবি তোলায় ধুন্দুমার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, দুপুত্র আর হেলেন। দুই হাতে দুই পলিথিন ভর্তি নানান শো পিস আর রান্নাঘরের জন্য অতিব প্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছুরি কাঁচিসহ কেনা ছোটখাট নানান যন্ত্রের ভার নিয়ে, ভাবছিলাম আমি এ ভারমুক্ত হওয়া যায় কিভাবে ? লাজুর মন্তব্য কানে যেতেই তাতে সাথে সাথে সায় দিয়ে বললাম যে, ভাবছি আমি কি তাহলে হোটেলে গিয়ে এই ব্যাগ গুলো রেখে আসবো নাকি? এ ফাঁকে তোমরা বাকি কেনাকাটা করো? এই হেলেন, এই দীপ্র অভ্র এদিকে আসো তো?
“না, না তুমি আবার এখন হোটেলে যাবে কেন খালি খালি? দাও তো দেখি একটা ব্যাগ আমার হাতে।” একথা বলতে বলতে আমার হাত থেকে একটা ব্যাগ নেবার জন্য হাত বাড়াতেই চট করে একটা চমৎকার বুদ্ধি মাথায় আসতেই মনে মনে নিজেই চাপড়ে দিলাম নিজের পিঠ।
বুদ্ধিটা হল, এই শপিংমলগুলোর কোন একটার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢোকার মুখে ওদের কাছে এই ব্যাগগুলো জমা রেখে টোকেন নিয়ে, ওখান থেকে যা যা দরকার কেনাকাটা করে বের হবার পরও, ঐ ব্যাগগুলো ওখানেই রেখে বাকি শপিং শেষ করে হোটেলে যাওয়ার পথে টোকেন জমা দিয়ে ওগুলো তুলে নিলেই হবে।
“বাবা, বাবা, চল এখন আমরা ঐ খেলনার দোকানে যাই। আদিব ভাইয়ুর জন্য খেলনা কিনতে হবে না?” আমার ডাকে এরই মধ্যে হেলেন, দুই ভাইপোকে বগলদাবা করে ফিরে আসতেই, দীপ্র এই প্রস্তাব দিতেই মনে মনে সাথে সাথেই তা গৃহীত হয়ে যেতেই , ওর কথায় সায় দিয়ে দলের দুই পরাক্রমশালী নারী সদস্যদের জিজ্ঞেস করলাম লাগবে কি না রেন মেন বি তাদের? যদি লাগে তা নিয়ে যেন, দুজনে এই ফাঁকে সেরে নেয় তাদের সদাইপাতি। সবাই একসাথে কেনাকাটা করার মতো সময় আসলে নাই হাতে। তদুপরি এখানকার শপিংমলগুলো কতক্ষণ খোলা থাকে, তাও তো জানি না। গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে একটাই, তা হল যে যেখানেই থাকুক, এখন থেকে ঠিক দেড় ঘণ্টা পর মানে, হাত ফোনের পর্দায় আটটা বাজতেই রিপোর্ট করতে হবে সবাইকে ঐ ম্যাকের সামনে, পরবর্তী করনিয় ঠিক করার জন্য। আর এ সময়টায় পুত্রদের নিয়ে আমি আদিবের খেলনা আর চকলেট কেনার কাজ সেরে রাখবো ।
এ ব্যাপারে কারো কাছ থেকে কোন ওজর আপত্তি না আসায় ধরে নিলাম পাশ হয়ে গেল প্রস্তাব সর্বসম্মতক্রমে। এরই মধ্যে লাজু ও হেলেন নিজ নিজ ব্যাগ হাতড়ে , জানান দিল যে রেন মেন বি কতো যে লাগতে পাড়ে তা তারা নিশ্চিত নয়। এমনিতে মনে হচ্ছে আছে যথেষ্টই। তবে আমি যদি আরও কিছু দিতে চাই, তাদের আপত্তি নাই!
কথা আর না বাড়িয়ে দুজনকেই হাজার খানেক করে চায়নিজ মুদ্রা ধরিয়ে দিয়ে, পুত্রদ্বয়কে নিয়ে এই প্রায় আয়তাকার চত্বরটির এই কোনা থেকে এগিয়ে যাওয়া কাল্পনিক কর্ণ ধরে এগুতে লাগলাম চত্বরের ঐ কোনার বিশাল খেলনার দোকানটির দিকে।
ওখানে পৌঁছেই স্টোরে ঢোকার মুখেই হুতংশপিংয়ের ব্যাগ দুটো কাউন্টারে জমা দিয়ে ঝাড়া হাত পা হয়ে ভেতরে ঢুকে একই সাথে অবাক ও হতাশ হলাম। অবাক হওয়ার কারন অবশ্যই এর বিশাল আকার। আর হতাশ হলাম বিশাল এই ষ্টোরটির ভেতরকার পরিকল্পনা মানে স্টোর ডিজাইন নিয়ে। তাক ভর্তি উপচে পড়া নানান জাতের খেলনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু লম্বা সেলফগুলো দেখে মনে হচ্ছে একটার সাথে আরেকটা গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোন মতে।
বিশ্বের আরো নানান শহরে যেখানেই এরকম বিরাটাকায় খেলনার দোকান দেখেছি, ওসবে যে খোলামেলা ভাব ছিল তাতে বাচ্চাদেরকে একটু আধটু দৌড়ঝাঁপ বা খেলাধূলা করার যে সুযোগ পেতে দেখেছি, এতে তা নেই । এর সাজসজ্জার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, নীরবে বলছে এই স্টোর, ঢুকছোই এখানে যখন, পছন্দমতো খেলনা কিনে হও বিদেয় শিগগির!
“ভাইয়া, ভাইয়া ঐ যে দেখো স্টারওয়ার্সের ডার্ট ভাদের! চল চল ছবি তুলি গিয়ে।’ এসময় অভ্র এ কথা কটি বলেই বাঁয়ের দিকের সামনে গায়ের গা না লাগিয়ে একটু ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা তিনটা শেলফের ত্রিমোহনায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রমান সাইজের মানুষ সমান ঐ মডেলটির দিকে দৌড় দিতেই , পিছু নিল দীপ্র। ওদের এই দৌড়ঝাঁপে কোন না কোন শেলফের গায়ে ধাক্কা লেগে সেটির বুকভরা খেলনা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড যাতে না ঘটে, সে ভাবনায় তুমুল বিব্রত আমিও ওদেরকে সে ব্যাপারে সাবধান করতে করতে এগুলাম দ্রুত।
এদিকে ডার্থ ভাদেরের সাথে ছবি তোলা শেষ হতে না হতেই, “ঐ যে স্পাইডারম্যান, চল অভ্র ঐ যে স্পাইডারম্যান” বলে দীপ্র অন্যদিকে দাঁড়িয়ে থাকা স্পাইডারম্যানের দিকে দৌড় দিতেই অভ্রর পিছু পিছু বাধ্য হয়ে আমাকেও করতে হল অনুগমন।
এভাবে বিশাল এই খেলনার দোকানের নানান কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা নানান ডিজনি আর আম্রিকান কার্টুন ক্যারেক্টারের সাথে দুপুত্রের ছবি তুলতে তুলতে মনে হল, হায় চায়নার এতো প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ইতিহাস আর সংস্কৃতি থাকার পরও, এই খেলনার দোকানে সেই সংস্কৃতির কোন ছাপই নাই! ডিজিটাল এই বিশ্বে অচিরেই এভাবেই কি তবে হারিয়ে যাবে নাকি দিকে দিকে লোকসংস্কৃতি? আমাদের প্রজন্মই কি তাহলে দেশে দেশে স্থানীয় নিজস্ব সংস্কৃতির শেষ ধারক বাহক নাকি?
আমার শৈশবের কুচবরণ বা কেশবতি কন্যা, ডালিমকুমার, পংখিরাজ ঘোড়া , সুয়োরানী দুয়োরানী এসবের কোনটারই তো কোন আবেদন নাই পুত্রদের কাছে! তেমনি নিশ্চয় চায়নারও লোককাহিনী বা রূপকথার চরিত্রদের কোনই আবেদন নাই এখানকার নতুন প্রজন্মের কাছে। আমাদের পুত্রদের মতো তারাও নিশ্চয়ই ঐ স্নো হোয়াইট, মুগলি, টিগার, স্পাইডারম্যান এসবেরই ভক্ত। এই খেলনার দোকানে এসে এ তো এক নতুন ভাবনা এলো দেখছি মাথায়!
“বাবা, বাবা, আদিবের জন্য আমরা কি ট্রান্সফরমার দেখবো? নাকি অন্যকিছু?”
“না না , চল ঐ রিমোট কন্ট্রোলড হেলিকপ্টারটা নেই। ও হেলিকপ্টার খুব পছন্দ করে “দীপ্র প্রশ্নের জবাবে অভ্র এই কথা বলে বেশ বড় সড় সাইজের একটা প্যাকেট শেলফ থেকে নামাতেই, চোখ আমার চলে গেল সেই হেলিকপ্টার সেলফে লাগিয়ে রাখা দাম লেখা স্টিকারটির দিকে! তাতে চক্ষু উঠে গেল আমার কপালেই!
একই সাথে অন্যান্য শেলফে রাখা নানান খেলনার দামের স্টিকার গুলোর দিকে নজর যেতেই বুঝলাম, মাল এসব যতোই হোক চায়নিজ, মানে মেইড ইন চায়না, দাম এগুলোরই সবই হল আম্রিকান ইউরোপিয়ান!
হবেই বা না, কেন তা? নাম মানে ব্র্যান্ডতো এগুলো সবই নামকরা ও বৈশ্বিক; যার কোনটার আদিনিবাস ইউরোপ তো কোনটার আমেরিকা! চায়নায় বানিয়ে চায়নায় বিক্রি করলেও দাম এগুলোর ঠিক করা আছে তাদের বৈশ্বিক মানদণ্ডেই। আমাদের দেশে একটা কথা ছিল “জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভাল।” সেরকমই আজকালকার ডিজিটাল পৃথিবীর দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে বৈশ্বিক উৎপাদন ব্যবস্থায় আউটসোর্সিং নামের যেই ঢেউ চলছে, তাতে পণ্যের জন্য ব্যাপারটি দাঁড়িয়েছে “জন্ম হোক যথা তথা, ব্র্যান্ডিং এ ঠিক হবে দাম।” ফলে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটনি খেঁটে যেই পোশাক বানিয়ে দিয়ে আমাদের বস্ত্রকন্যারা জীবন যাপন করে কায়ক্লেশে, সেই কাপড়ের প্রতিটিই বিক্রি হয় ম্যানহাটানের ফ্যাশন স্ট্রিটে শত শত ডলারে। কে কিভাবে কোথায় তা বানাল তা দিয়ে তো নয়, দাম ঠিক বিক্রি হচ্ছে তা কোথায়, কোন নামে?
“বাবা, বাবা, ঠিক আছে আদিবের জন্য আমরা এই হেলিকপ্টারটাই নেব। কিন্তু বাবা, বাইরে ফুটপাতে একটা লোককে দেখেছিলাম এরকম হেলিকপ্টার নিয়ে বসে আছে। আগে দেখে আসি তো ঐটার কতো দাম?”
এরই মধ্যে দ্রুত দুই ভাই আরো বেশ কয়টা খেলনা দেখার পর নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ শেষে এইমাত্র নিজেরা একমত হওয়ার পর, দীপ্র একথা জানাতেই , বললাম ঠিক আছে , নিয়ে নাও। বাইরে আর কেন দেখতে যাবে?
“না না চল না বাবা দেখেই আসি না বাইরে থেকে , চল তো অভ্র।“ আমার কথা উপেক্ষা করে দীপ্র অভ্রকে নিয়ে বাইরের দিকে রওয়ানা করতেই ওদের পিছু পিছু এগুতে এগুতে ভাবছি আচ্ছা, কখন, কোথায় দেখল দীপ্র বাইরের ফুটপাতে এই একই খেলনা? আমার তো নজরে পড়েনি ওটা!
নাহ, বাইরে বেরিয়ে খুব বেশী দূর যেতে তো হলোই বরং বলা চলে এই স্টোরে একদম দোর গোড়াতেই পাওয়া গেল সেই খেলনাওয়ালাকে। হ্যাংলা পাতলা এক চায়নিজ ছোকরাকে দেখলাম চক্রবক্রা একটা জ্যাকেট আর প্যান্ট পড়ে বসে আছে, এই স্টোরের ঢোকার মুখে যে লম্বা সিঁড়ি আছে তার ডান কোনায়। পাশে আছে ঐ হেলিকপ্টারটির প্যাকেটটির মতোই আরকেটিকে। ভাবেসাবে দেখে মনে হচ্ছে না যে, সে ওটা বিক্রি করার জন্য বসে আছে। উল্টা মনে হচ্ছে সে–ই বুঝি এইমাত্র এটি ঐ দোকান থেকে কিনে ওটা পাশে রেখে একটু জিরোচ্ছে সিঁড়িতে বসে। এতে কেমন যেন একটু ইতস্তত বোধ হল আমার।
প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক