আমাদের দুজনের কফি পান পর্ব শেষ হতেই লোক গিজগিজ করা ওম ওম গরমের আরামের ম্যাকস্টোর থেকে বেরিয়ে ফের বেইজিং হিমের উটকো হিমশীতল আলিঙ্গনের পাল্লায় পড়লেও দেখলাম তা নিয়ে তেমন কারোই কোনও বিকার নেই।
বাহ! বেশ ভালোই তো দেখছি এ ক’দিনেই সবাই মানিয়ে নিয়েছে নিজেদেরকে বেইজিং হিমের তীব্রতার সাথে। অবশ্য এই চত্বরটার চারদিক নানান সাইজের আর ডিজাইনের দালান দিয়ে ঘেরা বলেই কি না জানি না, এখানটায় বাতাসের তোড় তেমনটা নেই, যেমনটা ছিল চত্বরটার ওপাশের ফুটপাতে, যার ওপাশেই হল এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়ার রাজপথ।
হ্যাঁ মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ পর্যন্ত, তেমনি এখানে আমারও দৌড় ঐ এয়ারপোর্ট পর্যন্তই। কারণ এ রাস্তা এয়ারপোর্ট পেরিয়ে বা তার পাশ বা বা ডান পাশ ঘেঁষে ঘুরে অন্য কোথাও গেছে কি না তা তো জানি না। জানি না ঐ রাস্তার নামও। যেহেতু প্রথম রাতে এয়ারপোর্ট থেকে এই রাস্তা ধরেই এসে পৌঁছেছিলাম হোটেলে, সেই থেকে নিজ মনে ওটার নাম তাই এয়ারপোর্ট সড়কই রেখে দিয়েছি আর কি।
‘কী ব্যাপার, যাচ্ছ কোন দিকে ? আমরা কি এখন হোটেলে যাবো না? ’
এই যে দোকানটা এটা মনে হচ্ছে সিল্কের দোকান। এখনি চোখে পড়ল। তুমি না সিল্ক কিনতে চাইছিলে। তাই ভাবলাম আর একটা চক্কর দেই এখনি, চলো না দেখি একটু দ্রুত উঁকি দিয়ে, বলতে বলতে হাঁটা পথ থেকে চার সিঁড়ি উঁচুতে থাকা দরজাটার দিকে এগুতেই, কোনও রকম ওজর আপত্তি করা ছাড়াই দেখলাম আসছে বাকিরাও।
সদলবলে সামনের দিকে এগুতে এগুতে ম্যাকস্টোরের পরের একটা বিল্ডিং পর, বেশ পুরানো ধাঁচের আরেকটা বিল্ডিংয়ের সামনের হাঁটা পথ দিয়ে এগুতে এগুতে চোখে পড়েছিল সেটির টানা জানালায় ঝুলতে থাকা হরেক রং আর ডিজাইনের থান কাপড় লম্বালম্বি ভাবে পর্দার মতো ঝুলতে। দেখে মনে হল ওগুলো সিল্ক হতে পারে। এর আগেও গিয়েছি যখন এদিক দিয়ে বার কয়েক, তখন চোখে না পড়লেও দেখতে পেলাম এখন। তবে চোখে পড়েনি এটা সম্ভবত ঠিক নয়। চোখে ঠিকই পড়েছে কিন্তু সেসময় ছিলাম যেহেতু অন্য চিন্তায় বা তাড়ায়, দেখলেও মনোযোগ যায়নি সেদিকে সেসময়। তাই চোখে পড়লেও আসলে দেখা হয়নি এটা, হয় যা আমাদের জীবনে প্রায়শই। কিন্তু আজ যেহেতু শপিং ডে, আর লাজুর শপিং লিস্টিতে আছে সিল্ক তাই এমুহূর্তে চোখের দেখার সাথে মনের সংযোগ ঘটেছে।
‘আচ্ছা এটা কি হোলসেল দোকান? এতো কাপড় এখানে। আমাদের কাছে বিক্রি করবে তো?’
লাজুর এই প্রশ্নে গোটা দোকানটি চোখ জরীপ করতে করতে আনমনে বললাম, বুঝতে তো পারছি না। আগে দেখে নেই না ভালো করে। তারপর কাপড় পছন্দ হলে জিজ্ঞেস করবো দুই চার বা পাঁচ গজ বেঁচবে কি না। নাকি কিনতে হবে থান ধরে।
চোখ আন্দাজে মনে হচ্ছে হবে এই তলাটা কমপক্ষে দুই কি আড়াই হাজার বর্গফুট। গোটা তলাটাই ঠাঁসা নানান রং ডিজাইনের ঝিলমিল সিল্কি ধরনের কাপড়ের বড় বড় থানে। গোটা তলাটার রাস্তার দিকের অংশটির ভূমি থেকে শুরু করে একতলার ছাদ পর্যন্ত কাচে মোড়া। ঐ কাচের অংশটাতেই ছাদের কাছাকাছি জায়গায় লাগানো রড থেকে পর্দার মতো ঝুলিয়ে রেখেছ নানান ডিজাইনের কাপড়। ব্যাপারটাতে কোনও নান্দনিকতা নেই, তবে আছে চিকন চাইনিজ ব্যবসায়িক বুদ্ধি। এইভাবে জানালার ধারে কাপড় ঝুলিয়ে রাখাতে একদিকে হচ্ছে তাদের কাপড়ের ডিসপ্লে, অন্যদিকে আলাদা পর্দা দেবার খরচা বেঁচে গেছে। এর ভেতরকার আবহ দেখে, চট করে চোখে ভেসে উঠল ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালের কাছের একটানা পর্দার দোকানগুলোর। দ্রুতই ফের এই স্টোরটা জরীপ করতে করতে মনের ভেতরে দ্বিতীয় জন বলে উঠলো ফিসফিসিয়ে, যাক বেইজিঙের সিল্ক স্ট্রীটে না যেতে পারলে কী হবে, সিল্কগুহা তো পেলে অবশেষে।
‘নাহ এখানকার কোনও কাপড়ই পছন্দ হচ্ছে না।’
‘খ্যাত খ্যাত ডিজাইনের কাপড় সব।’
স্টোর উপচে পড়া উজ্জ্বল লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কমলা, ঘিয়ে ইত্যাদি রঙের সিল্কের কাপড়ের উপর কন্ট্রাস্ট কিম্বা একই রঙ্গ বা সুতো কিম্বা জরি দিয়ে চায়নিজ ট্র্যাডিশনাল ফুল লতাপাতা, ড্রাগন ইত্যাদি আঁকা কাপড়গুলো দেখতে দেখতে ভাবী আর ননদের মুখ থেকে পর পর এই মন্তব্য আসায়, বোজা গেল যে বেশির ভাগ সময়ে প্রায় সকল বিষয়ে ভিন্নমতাবলম্বী এই দুইজন এ পর্যন্ত যে অতি অল্প কিছু সময়ে একমত হয়েছিল, এ মুহূর্তটি সেরকমই একটি বিরল মুহূর্ত। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম তাতে। কারণ কাপড়ের ডিজাইন পছন্দ করা নিয়ে ননদ ভাবীর কোনও দ্বৈরথের মাঝে পড়তে হয়নি আপাতত।
এরই মধ্যে চোখে পড়ল কড়া লাল রঙের সিল্কের উপর সোনালি জরির ব্রকেড করা কাপড়ে তৈরি গাউন জাতীয় ইউনিফর্ম পরে বিরস বদনে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ তলায় জনা পাঁচেক চায়নিজ নারী। না এমনিতে চায়নিজদের চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ করতে না পারলেও এদের দেহের গঠন আর মুখ ও গলার কাছের চামড়ার ভাঁজ দেখে বুঝতে পারছি পরিষ্কার যে, তরুণী নন তারা। তদুপরি মেদবহুল শরীরের স্থুলতার ভাবটিও বলছে এরা মধ্যবয়সী চায়নিজ রমণী। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে এ দোকানের মালিক যিনি, তিনি এখনো ব্যবসায় তার সাবেকি চালই বজায় রেখেছেন, সাজসজ্জা থেকে শুরু করে তার কর্মচারীদের পোশাক আশাক আর তাদের চলাফেরার ভাব দেখে সেটাই মনে হচ্ছে।
কে জানে, এটা হয়তো এ মালিকের পারিবারিক ব্যবসা। তাই বাইরের কাউকে নিয়োগ না দিয়ে হয়তো চাল্লাচ্ছে এই ব্যবসা তারা নিজেরা নিজেরাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এদের সাথে ইংরেজি বাৎচিত করে খুব যে লাভ হবে না তা তো বুঝে গেছি এ কয়দিনে। তার উপর আমাদের ব্যাপারে তাঁদের কোন কৌতূহলও দেখছি না। আরে কিনি না কিনি, টুকটাক কথাবার্তা বলতে পারলে দাম জেনে একটা ধারণা তো নিতে পারতাম। কোথাও কোনও কাপড়ের গায়ে প্রাইস ট্যাগ চোখে পড়ছে না, হোক না তা চায়নিজিই।
স্টোর দেখতে দেখতে এসব ভাবতে ভাবতে এরই মধ্যে দোকানটির ভেতর হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি দেখি, দোতলায় উঠার সিড়ির গোঁড়ায়। উপরে উঠার সিড়ির দু পাশেও ঐ পাশের জানালার মতো একই ভাবে সিল্কের কাপড় ঝুলতে দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না যে উপরের তলায়ও আছে আরো সিল্ক সম্ভার।
‘বাবা, বাবা আমরা কি উপরে যাবো? এখান থেকে কি কিছু কিনবে?’
পেছন থেকে জ্যাকাটের বা দিকটা খামচে ধরে করা অভ্রর কিছুটা অসহি‘ু প্রশ্নে উত্তরে, সিঁড়ির দিকে এগুতে এগুতেই বললাম, চল না যাই দেখি উপরে। পছন্দ হলে তোমার মা কিছু কিনলে কিনতেও পারে।
দোতালায় উঠার পর মনে হল যে, নাহ এখানে এক দুই তিন বা চার গজও বিক্রি করা হয়। যেহেতু এখানে নিচের মতো থান আর বান্ডেল থাকলেও, আছে দেখছি নানান রেকে ভাঁজ করে রাখা পিস কাপড়ও। এ তলার সজ্জা আর কাউন্টার দেখেও মনে হল এটাই মূলত এদের বেচাবিক্রির জায়গা। নিচের তলাটা সম্ভবত ডিসপ্লে আর স্টোর! আচ্ছা এরকম করলো কেন এরা? ঘটনা তো উল্টা হবার কথা।
‘আচ্ছা বলতো ১২৫ রেন মেন বি তে আমাদের টাকায় কতো টাকা হয়?’ পাশ থেকে লাজু এসময় জিজ্ঞেস করতেই মগজে ফিট করে রাখা মানি কনভার্টারে দ্রুত একটা খসড়া হিসাব করে উত্তর জানাতেই ফের প্রশ্ন
‘আচ্ছা এটা কি গজের দাম নাকি, ঐ পুরো পিসটার দাম বলোতো?’
আচ্ছা এ প্রশ্নের জবাব কেমনে দেই, আমি জানি নাকি, ভাবতে ভাবতে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম কার কাছ থেকে শুনেছ এই দাম? কে বলল?
‘আরে দেখছ না, এ তলার থানগুলো আর পিসগুলোর উপরে ইংরেজিতে লেখা দামগুলো।’
তাইতো! আমি তো এতক্ষণ লক্ষই করিনি যে এ তলায় সব ধরনের কাপড়, হোক তা থান, বা পিস সবগুলোর গায়েই আধা পৃষ্ঠা সাইজের সাদা কাগজে বেশ বড় করে লাল অক্ষরে লেখা আছে নানান ইংরেজি সংখ্যা। সব সংখ্যাই শতকের ঘরে। এমনকি আছে অনেক হাজারের ঘরের সংখ্যাও। কিন্তু কিভাবে বলি এই দাম কি গজের, মিটারের, নাকি কেজির। শুনেছিলাম চায়নায় সিল্কের কাপড় নাকি কেজিতেও হয়। অতএব ব্যাপারটার মিমাংসা করার জন্য কাউন্টারের একটানা লম্বা হাই বেঞ্চ জাতীয় টেবিলের ওপাশে বসে থাকা যে জনা পাঁচেক নারী পুরুষ আছে, তাদের কাকে জিজ্ঞেস করা যায়, ভাবতে ভাবতে লাজুকেই ফের জিজ্ঞেস করলাম, তোমার পছন্দ হয়েছে কি কোনও কাপড় সেটা বল।
‘আরে নাহ এখানেও পছন্দ হয়নি। তবে ঐ যে দেখছ না ঐ থানটার গায়েই দেখলাম সবচেয়ে কম ১২৫ লেখা আছে। কিন্তু দাম যা বললা আমাদের টাকায় তা যদি এক গজের দাম হয়, কিনবো না। অনেক দাম এখানে।’
তাহলে চল যাই বেরিয়ে, হোটেলে ফিরতে হবে। আর দেরী করে লাভ নেই। বলেই এগুলাম নিচে নামার সিঁড়ির দিকে।
বাইরে আসার পর মনে হল হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো বুঝি এতক্ষণ মনমরাভাবে মুখ গোমড়া করে স্টোরে ঘুরতে থাকা দু পুত্র। বাইরে পা দিয়েই মহানন্দে তড়িঘড়ি দুজনেই ওরা এগুতে শুরু করেছে, এই শপিং চত্বর থেকে বেরিয়ে যেদিকটা দিয়ে এগুলে ওঠা যাবে আমাদের হোটেলের দিকে যাবার ফুটপাতে, সেদিকে। বোঝা যাচ্ছে, বারকয়েক এদিকটায় আসায়, মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে রাস্তা ওদের। তুমুল ভাষাবিভ্রাটের এ শহরে আমার জন্য এ এক অত্যন্ত ভালো খবর। কারণ এখানে যদি ওরা কোনও কারণে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও যায়, নিজেরাই ফিরতে পারবে হোটেলে।
‘বাবা, বাবা, ঐ যে দেখো টয় শপ। এটার কথাই বলেছিলাম তখন। এখান থেকেই আদিব ভাইয়ের জন্য খেলনা কিনতে হবে। আচ্ছা বাবা এখন কি আমরা ওখানে গিয়ে ছবি তুলে আসতে পারি?’
দৌড়ের ভঙ্গিতে দুই ভাই বেশ অনেকটা এগিয়ে যাবার পর, হঠাৎ করে ঘুরে দৌড়ে আমাদের কাছে এসে এই চত্বরের ঠিক যে জায়গায় আছি এখন, তার ঠিক উল্টা দিকে প্রায় শ খানেক মিটার দূরের আধুনিক ডিজাইনের বেশ বড়সড় পাঁচতলা শপিং মলটির নিচতলার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো দীপ্র।
লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।