জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়

শঙ্কর প্রসাদ দে | রবিবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৪ at ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ

২১ ডিসেম্বর ২০২৩, রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে অনুপম গাড়ি স্টার্ট দিল। অনুপম থাকে ক্যামব্রিজ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার ২০৪ নং বাড়ির নীচতলায়। শুধু বোস্টন নয় গোটা আমেরিকাতে রেসিডেন্সিয়াল এলাকার বাড়িগুলো ৩ তলার বেশি হয় না। বোস্টনের বহুতল ভবনগুলোর মালিক সিটি গভর্নমেন্ট। বেশির ভাগ ফ্ল্যাটই স্টুডিও ডিজাইনের। মাত্র দু’রুমের ফ্ল্যাটে নাগরিক সুবিধার সবকিছুর ব্যবস্থা করা আছে। সিটি কর্পোরেশন ভাড়ার টাকা বেতন থেকে কেটে নেয়।

এমনিতে বোস্টন ছিমছাম কোলাহলমুক্ত স্বল্প জনসংখ্যার একটি শহর। এটিকে এডুকেশন হাব বলার যুক্তি আছে। ১৪৫ টি মাধ্যমিক স্কুল। ৫০টি কলেজ ও ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয় হলো শহরটির প্রাণ। আমেরিকায় যে কয়টি এলাকা দিয়ে বৃটিশ উপনিবেশ শুরু হয় তার অন্যতম হল বন্দর নগরী নিউ ইংল্যান্ড অর্থাৎ এই বন্দর নগরী দিয়ে অভিবাসন শুরু হয়েছিল বলে এটিকে নিউ ইংল্যান্ড ডাকা হত। রাজ্যটির নাম ম্যাচাচুয়েটস্‌। কিছু ক্যামব্রিজ গ্র্যাজুয়েট ইংল্যান্ড থেকে গিয়ে শহরের যে অংশে বসবাস শুরু করে সেটির নাম রাখা হয় ক্যামব্রিজ। পরবর্তীতে নিউ ইংল্যান্ড আর ক্যামব্রিজ অর্থাৎ চার্লস নদীর উভয় তীরকে একত্রে নামাকরণ করা হয় বোস্টন। এটি ম্যাচাচুয়েটস্‌ রাজ্যের রাজধানী। মূল শহরের জনসংখ্যা মোটামুটি ৭ লক্ষ এবং বৃহত্তর বোস্টনের জনসংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ।

২১ ডিসেম্বর রাতে আমাদের সর্বশেষ রোমাঞ্চকর ভিজিট হল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ল্যাব। ঢুকার আগে কল্পনাও করতে পারি নি এতকিছু দেখবো। এতো বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রার সাক্ষী হব। তপন কান্তি সিন্‌হা (বড়ুয়া) হার্ভার্ড সাইয়েন্টেফিক ল্যাবের একজন টেকনিশিয়ান। দীর্ঘদিন ধরে হার্ভার্ডে চাকুরী করছেন সস্ত্রীক। একটি বিরল সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্য চিরদিন স্মরণ করবো।

রাত তখন প্রায় ১০ টা। ১টি রিসার্চ রুমে ঢুকতেই পরিচয় হলো মার্কিন এক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর পিএইচডি’র মাঝবয়সী ছাত্রীর সাথে। পরিচয়ের শুরুতেই বললেন তাঁর পিএইচডি শেষ পর্যায়ে। প্রতিটি রুমের প্রতিটি টেবিলে ডিএনএ ও আরএনএ স্লাইটগুলো সারি সারি বসানো আছে। ভদ্র মহিলা সংক্ষেপে জানালেন ডিএনএ ও আরএনএ প্রোফাইল সেটিং এর পর এগুলো ফলাফলের জন্য ল্যাবের নির্দিষ্ট কক্ষ, ফ্রীজ ও লকড ফ্রীজে চলে যাবে। মানবিক বিভাগের ছাত্র হওয়ায় বিজ্ঞানে আমার জ্ঞান নেই বললে চলে। আক্কেল দিয়ে ইতিহাস, সাহিত্যে জ্ঞানার্জন করা সম্ভব। বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়ে সম্ভব নয়। তপন’দা বললেন ন্যাচারাল সায়েন্স অর্থাৎ জীববিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক গবেষণার জন্য হার্ভার্ড পৃথিবীখ্যাত। বিশ্ববিদ্যালয়টির সর্বশেষ চৌকষ গবেষণা পর্বটির নাম জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং।

আমেরিকান বায়োকেমিস্ট স্টানলি এন কোহেন এবং বায়োটেকনোলজিস্ট হার্বাট ডব্লিউ বোয়ার যৌথভাবে ডিএনএও ধারণার প্রস্তাবনা ১৯৭৩ সালে উপস্থাপন করেন। কোহেন স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর ছিলেন। জেনেটিকস্‌ বিভাজন, বিভাজিত খণ্ডকে ভিন্ন ডিএনএ এর সাথে জোড়া লাগিয়ে বা বিভাজিত ডিএনএ ও আর.এন.এ থেকে প্রয়োজনে কোন কোন খন্ড বা অংশকে বাদ দেয়া যায় বা সংযুক্ত করা যায় মর্মে কোহেনের বক্তব্য তাত্ত্বিক ন্যাচারাল সায়েন্সে আলোড়ন সৃষ্টি করে। জেনেটিক্সের ক্ষুদ্রতম একক হলো ডিএনএ এবং আরএনএ।

খুব দ্রুত পৃথিবীব্যাপী ডিএনএ ও আরএনএ বিভাজন বা জেনেটিক তত্ত্ব নিয়ে প্রচুর যুগান্তকারী প্রযুক্তি আসতে শুরু করে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজির অধ্যাপক হার্বার্ট বোয়ার বাইরে থেকে ডিএনএ ও আরএনএ ঢুকিয়ে ব্যাকটেরিয়ার চরিত্র বদলের প্রযুক্তি আবিষ্কার করে কৃষি উৎপাদন এবং চিকিৎসা জগতে ব্যাপক গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। কৃষি খামারে কত বিচিত্র রকমের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন হচ্ছে। কত নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা এসব উন্নত প্রযুক্তির ফসল, উদ্ভিদ, মৎস্যকে হাইব্রীড বলে থাকি। হাইব্রীডের এই সাফল্য মূলত ডিএনএ ও আরএনএ এর চরিত্র পরিবর্তন। এই প্রযুক্তি মানবজাতির খাদ্য নিরাপত্তাকে অনেক উন্নত করেছে। এসব কিছুর কৃতিত্ব কোহেন এবং বোয়ারের। তপন’ দা বিশেষ কিছু ফ্রীজ দেখিয়ে বললেন, ডিএনএ সহ অন্যান্য হাইব্রীড সংযোজন, বিয়োজন ও পরিবর্তনের ফলাফলের জন্য দীর্ঘ বছর অপেক্ষা করা হয়। প্রশ্ন করেছিলাম মানব শরীরের কোন অংগ প্রত্যঙ্গ বা অন্য উপাদানের ডিএনএ নিয়ে কি এখানে গবেষণা হয় না? বংশানুক্রমে জীন স্থানান্তরিত হয় ডিএনএ এর মাধ্যমে।

তপন’দার জবাবে যা শুনলাম তাতে স্তম্বিত হবার শেষ নেই। বায়োকেমিস্ট ল্যাব দেখিয়ে বললেন হার্ভার্ডের ল্যাবের যন্ত্রপাতির সব ব্যয়ভার ওষুধ কোম্পানিগুলো বহন করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে, কৃষি প্রযুক্তিবিদদের, রসায়নবিদদের পিএইচডি’র ব্যয়ভার এবং স্কলারশিপ ওষুধ কোম্পানিগুলো স্পন্সর করে থাকে। এতোদিন মনে করতাম ওষুধ কোম্পানিগুলোর বড় বড় ল্যাবে ঔষধ আবিষ্কত হয় বা পরীক্ষা চালানো হয়। ভুল ভাঙলো। আসলে পৃথিবীতে নতুন নতুন ওষুধ, ভেকসিন আবিষ্কার হয় হার্ভার্ড সহ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

সর্বশেষ রোমাঞ্চকর তথ্যটি তপন’দা জানিয়ে বললেন, মানব শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের মধ্যে কিডনী, লিভার ও হার্ট নিয়ে হার্ভার্ডে মৌলিক গবেষণা হচ্ছে। মাইনাস ১০০ মাইনাস ১৫০ মাইনাস ২০০ ডিগ্রীর অনেকগুলো ফ্রিজ দেখিয়ে বললেন এসব ফ্রীজে প্রস্তাবিত কৃত্রিম কিডনী, লিভার, হার্টের ফর্মূলা ঢুকানো আছে ৪০/৫০ বছরের জন্য। ধারণ করা হচ্ছে এসব প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটার ফলাফল ভালো আসবে এবং এরপর আরো কিছু সময় চলে যাবে সরাসরি পশুদেহে ও মানবদেহে ট্রায়ালে। ফ্রীজে কৃত্রিম কিডনী, হার্ট ও লিভার পরীক্ষাধীন আছে গত ত্রিশ বছর ধরে। সম্ভবত আরো বিশবছর পর এসব ফ্রীজ খোলা হবে। ধারণা করা হয় একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এসে মানবজাতি কৃত্রিম হার্ট, কিডনী ও লিভার প্রতিস্থাপনে সক্ষম হবে। আসলে ১৯৮৬ সালে নোবেলজয়ী কোহেনের ডিএনএ ও আরএনএ বিভাজন তত্ব এবং বোয়ারের ডিএনএ ও আরএনএ বিভাজন পরবর্তী সংযোজন বিয়োজন নিশ্চিতভাবে মানুষের গড় আয়ুকে নিয়ে যেতে পারে অদূর ভবিষ্যতে শতবর্ষের উপরে। গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে হার্ভার্ড সহ পৃথিবীর নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। অনেকে বলে থাকেন মানুষ একদিন মৃত্যুকেও জয় করতে সমর্থ হবে। ভীষ্মের ইচ্ছা মৃত্যু হয়েছিল। শতাব্দী শতাব্দী ব্যবধানে ইচ্ছামৃত্যুই হবে মানুষের মানব জীবনে শেষ মুহূর্ত।

লেখক: আইনজীবী, আপীল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ