ব্যাপারটি আমার ক্ষেত্রে সবসময়েই ঘটে, বিশেষত বিদেশের মাটিতে। মানে বলছিলাম আর কী, ঐ যে বাইক্কা কার্ড মানে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে যখনই কোন কেনাকাটা করি, পিন কোড দেয়ার পর অজানা আশংকায় বুক ধড়পড় করে, যদি বা না তা কাজ করে বিদেশ বিভুইয়ে! একদম অমূলক কারণে যে ঘটে ব্যাপারটা তাও না। এ ঝক্কিতে পড়েছিলাম অন্তত বার দুয়েক বিদেশের মাটিতে। দু’বারই রক্ষা পেয়েছিলাম সাথে যথেষ্ট নগদ নারায়ণ ছিল বলেই। এখনো আছে পকেটে নগদানগদি রেন মেন বি। তারপরও বুকের ঐ ধুকপুকানিটা এলো দুই কারণে প্রথমত ভাবলাম একেতে এখানকার বস এসে পজ মেশিনকে তার বিশেষ ক্ষমতাবলে বাধ্য করেছে আমার বঙ্গদেশ থেকে ইস্যুকৃত এই বাইক্কা কার্ডকে গ্রহণ করার জন্য, কিন্তু তাও কি এই চাইনিজ পজ মেশিন বুঝেছে ঠিকঠাক আমার বঙ্গদেশের আঙ্গুলে দেয়া পিনকোড? এখানকার লোকজনের সাথে বাক্যালাপ করতে গিয়েই যখন দেখছি খাচ্ছে খাবি তারা হরহামেশা, সেইক্ষেত্রে এই চায়নিজ যন্ত্রেরও তো হতে পারে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
দ্বিতীয়ত এবং একটু ভয়াবহ ধরনের যে আশংকাটির কথা মনে পড়লো, তা হল কার্ডটি হ্যাক কিম্বা ক্লোনড হয়ে যাবার আশংকা। শুনেছি এ কর্মে চায়নিজরা ওস্তাদের উপর মহাওস্তাদ । আর তা যদি হয় এই অধমের ক্ষেত্রে তবে তো খবর আছে! যদিও এই ডিপার্ট্মেন্টাল স্টোরটিকে কোন হেজিপেজি জাতের স্টোর মনে হচ্ছে না, তারপরও তাদের কর্মচারীরা সবাই যে ধোয়া তুলসি পাতা তা তো ভাবতে পারছি না । কারণ জাল টাকার ছড়াছড়ি যে বেইজিংএ আছে ভালই তা তো বুঝে গেছি এরই মধ্যে। আহা, কী দরকার ছিল ক্রেডিট কার্ডে দাম দেয়ার এ ফালতু ভাব ধরার আমার !
মনের ভেতর এই ভয়ানক আশংকার ঝড় দ্রুত তার আগমন ঘোষণা করে আমাকে ভড়কে দিল যখন, ঠিক তখনই কাউন্টারের উপরে থাকা পজ মেশিন কির কির কির কির শব্দে রিসিট উগড়ে দিল পজ। বুঝলাম চায়নিজ মানুষ, বিদেশীদের কথা না বুঝলে কি হবে? এদের তৈরি মেশিন তা বোঝে ঠিকই। এ জন্যই তো ছোটখাট থেকে শুরু করে ভোমা ভোমা সাইজের যাবতীয় যন্ত্রের বাজারও দখল করেছে আজকাল চায়নিজ মেশিন, যে বাজারে একসময় একচেটিয়া রাজত্ব ছিল ইউরোপের।
সে যাক করিতকর্মা এই পজ মেশিনের এইমাত্র দেখানো কর্মতৎপরতায় আমার প্রথম আশংকাটি দূরীভুত হওয়ায় নিজে যতো না খুশি হলাম, তার চেয়ে ঢের বেশী উল্লসিত হল দেখছি হাস্যময়ী। একগাল মিষ্টি হাসির সাথে, দুই হাতে কোন আওয়াজ না করেই হাত তালি দেওয়ার ভঙ্গি করলো সে, বসকে ডেকে এনে হলেও কাজটি সম্পন্ন করতে পারার আনন্দে। চায়নিজ ব্র্যান্ডের তার হাস্যোজ্জ্বল চোখের সাথে এসময় চোখাচোখি হতেই, একগাল হাসিতে মাথা একটু নড করে বাহবা দিলাম তাকে, যদিও মনে মনে তখনও আশংকিত আছি কার্ড হ্যাক হয়ে যাওয়া বা ক্লোনড হয়ে যাওয়া নিয়ে।
এদিকে একটু আগে ক্রেডিটকার্ড বিষয়ক সমস্যার সমাধানকল্পে আসা স্যুটেড বুটেড হাস্যময়ীর সেই বস, যিনি হতে পারেন এ স্টোরের একদম বড় না হলেও মাঝারি সাইজের কোন কর্তা, আমার দিকে তাকিয়ে এসময় অনুচ্চস্বরে থ্যাংকু বলে বুকের কাছে ডান হাত নিয়ে নড করতেই, যা বললাম তাকে ধীরে সুস্থে থেমে থেমে ইংরেজিতে, বাংলায় তার মানে হল, শোন মিয়া তুমি কিন্তু একটা রত্ন পাইছো। এই হাস্যময়ীর মতন আর দু চারজন বিক্রয়কর্মী থাকলে তোমার সাথে, তবে এই স্টোরের সেল ঠেকাবে কোন শর্মা!
কী ছাইপাশ বুঝলো সে আমার এই কথার, তা কে জানে? দুজনকেই বিদায় জানিয়ে ঘুরে হাঁটা ধরছি যখন নীচে নামার জন্য চলন্ত সিঁড়ির খোঁজে, শুধু পিছন থেকে শুনতে পেলাম বস বলছেন “ওকে, ওকে”। আমি নিশ্চিত এই হাস্যময়ী একদিন এই স্টোরের ম্যানেজার হবে। কাজ তো সবাই করে না, আবার যারা করে, তাদের কেউ করে কাজ শুধুই হাত দিয়ে। কেউবা শুধু করে কাজ মাথা দিয়ে। এই দুই ধরনের কেজো লোককে অনায়াসে অতিক্রম করে যায় সে, যে কাজ করে হাত আর মাথা মিলিয়ে । আবার এই তিন ধরনের কেজোকে অনায়াসে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে চতুর্থ ধরনের কেজো লোকেরা ! এঁরা হাত মাথা আর হৃদয় এই তিনের সমন্বয়ে কাজ করেন। এমনিতে এদের দেখা পাওয়া বড়ই মুশকিল! আসলে মানুষের যে কোন সমাজেই এদের সংখ্যা খুবই কম । কপাল ভাল আমার এই যে, এই বেইজিং শহরে ওইরকম একজন বিরলকর্মীর দেখা পেলাম, যে হল কিনা ঐ হাস্যময়ী।
তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, এরকম একটা মোটামুটি উচ্চ মধ্যবিত্ত জাতের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ক্যাশ কাউন্টারের দায়িত্বে আছে যে, সে কি না আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড থেকে কিভাবে পেমেন্ট নিতে হবে তা জানে না? ব্যবসার ব্যাপারে তুমুল সফল চায়নিজদের সাথে এ ঘটনা তো মেলানো কঠিন! ব্যাপার কী?
মনের ভেতরের প্রথমজন এসময় এই প্রশ্ন তুলতেই, দ্বিতীয়জন বলে উঠলো , শোন উত্তর হল এর খুবই সোজা। প্রথমত এই বেইজিং যতোই আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, এ যে যাকে বলে কসমোপলিটন হয়ে উঠা, তা সে হয়ে উঠতে পারেনি এখনো। এমনকি এ স্টোরেও তো আর কোন বিদেশী নজরে পড়েনি। অতএব বোঝাই যায় এই স্টোরের ক্রেতা হল মূলত চায়নিজরাই। আর স্বভাবতই চায়নিজরা ব্যবহার করে চায়নিজ বাইক্কা কার্ড। তাই ঐ ক্যাশিয়ার কালেভদ্রেও কোন বিদেশী ক্রেডিট কার্ড দেখতে পায়না হয়তো। ফলে জাত ব্যবসায়ী চায়নিজরা ঐ ব্যাপারে তাকে ট্রেনিং করিয়ে অনর্থক অর্থ, শ্রম বা সময় কোনটাই নষ্ট করেনি । আসলে পূঁজি তো কখনোই কাউকে এমন কিছু শেখায় না, যা থেকে তার লাভ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না , বুঝলে না।
“বাবা, বাবা, আমরা তো তোমাকে খুঁজতে উপরে উঠছিলাম। তোমার দেরী হচ্ছিল বলে মা বলছিল তোমাকে খুঁজে নিয়ে যেতে।” উপরের ঐসব চিন্তায় ভাবনার জাল বুনতে বুনতে চলন্ত সিঁড়ি মারফত আধাআধি নিম্নগমন সম্পন্ন হতেই ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল দীপ্রর গলার আওয়াজে। ফলে ডানে ঘাড় ফেরাতেই দেখি, দেখি উঠছে দুই ভাই উপরের দিকে পাশের সিঁড়ি দিয়ে। খিঁচড়ে গেল মেজাজটা! এটা একটা কথা হল ? যতোই না বললাম এই স্টোরে কেউ কাউকে ছেড়ে যাতে না যায়, তারপরও কি না, পুত্রদের উপরে পাঠিয়ে দিল আমাকে খুঁজতে! কপাল ভাল যে, আমাদের দেখা হয়ে গেছে সিঁড়িতে। না হয় এই স্টোরের নানান সেকশনের গোলক ধাঁ ধাঁয় পড়ে কতো যে সময় নষ্ট হতো, কে জানে? নাহ এটা নিয়ে এক্কেবারে হেস্তনেস্ত না হলেও কড়া আপত্তি অবশ্যই জানাতে হবে। এ কথা ভাবতে ভাবতে গলা উঁচু করে বললাম পুত্রদ্বয়কে , তারা যেন অবশ্যই উপরে উঠার সাথে সাথেই এই নিম্নগমনের সিঁড়ি ধরে দ্রুত। আরো বললাম যে ওরা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো আমি নীচে সিঁড়ির গোড়াতেই।
কিন্তু নাহ! এই আমি একদম নীচে নামার আগেই চোখে পড়লো, সিঁড়ির একদম গোড়াতেই না হলেও সিঁড়ির উপর চোখ রাখা যায় এমন কাছাকাছি একটা জায়গাতে বা পাশে দাঁড়িয়ে আছে লাজু । দাঁড়িয়েছে ও এমনভাবে যাতে চোখ রাখা যায় পুত্রদের উপর। ফলে কড়া আপত্তি জানানোর যে পরিকল্পনা করেছিলাম এইমাত্র মনে মনে, তা গেল মাঠে মারা । উল্টা নীচে নেমে নিজেই পড়লাম কড়া আপত্তি তো নয় এক্কেবারে স্ত্রীশেলের মুখেই।
সব মিলিয়ে সময় যে একটু বেশিই নিয়ে ফেলেছি তা যেহেতু প্রমাণিত সত্য, কথা না বাড়িয়ে বরং সোজাসাপ্টা সে অপরাধ তাই ঘাড় পেতে নিয়ে, মিন মিন করে আত্মপক্ষ সমর্থন করার মানসে বললাম জুতো যেহেতু কিনছিলাম মিঠু ভাই সাবিনা ভাবীর কন্যার হবু বরের জন্য, তাই একটু তো দেখে শুনে কিনতে হবে তা ! তদুপরি পড়েছিলাম এখানে ভাষাবিভ্রাট ছাড়াও কার্ড বিভ্রাটেও!
কথা কটি বলে দ্রুত স্ত্রীর মুখশ্রী অবলোকন করে মনে হল , মোক্ষম কাজ দিয়েছে যুক্তিটি। তাতে সাহস পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম ওদের কেনাকাটার খবর, যদিও মোটামুটি নিশ্চিত আমি যে ভাষা বিভ্রাটের এই চায়নায় আমার অনুপস্থিতিতে একা একা কেনাকাটা করতে পারা সম্ভবপর হওয়ার কথা নয় ওদের ।
“এই যে দেখতে পাচ্ছ না এটা। টাকা যা ছিল তা দিয়ে এটা কিনে ফেলেছি।” এই স্টোরের মার্কামারা শপিং ব্যাগটি চোখের সামনে দুলিয়ে লাজু এ কথা কটি বলতেই টের পেলাম যে আসলেই লক্ষ করিনি ওটা এতক্ষণ ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।











