দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ at ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ

প্রদীপের নীচের অন্ধকার

শহরের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া বিমানবন্দরমুখী এ রাজপথে গাড়ির জন্য সর্বোচ্চ গতিসীমা কত যে নির্ধারিত করা আছে তা তো জানি না! তবে ফেরারি চালক যে সেই গতিসীমার মধ্যে থেকেই সর্বোচ্চ গতিতেই চালাচ্ছেন বোঝা যাচ্ছে তা, সড়কের সর্ব বাঁয়ের লেন দিয়ে বাকি গাড়িগুলোকে পেছনে ফেলে দিয়ে তার এগিয়ে যাওয়া দেখে। এভাবে ভুঁইফোড়ের মতো হঠাৎ করে উদয় হয়ে বাতাসে তীব্র ফেরারি ইঞ্জিনের মার্কামারা গর্জন সে ছড়িয়ে দিলেও, আমার মগজের নিউরনে নিউরনে সেই গর্জনকে ছাপিয়ে তুমুল ভাবে ঢেরা পিটাচ্ছে একটু আগে অভ্রর স্বভাবগতভাবে ইংরেজিতে করা তুমুল অবিশ্বাস জড়ানো সেই প্রশ্নটি যে ধনে মানে সমৃদ্ধ এই বেইজিং এ কিভাবে এরকম একজন গৃহহীন থাকতে পারে?

এরই মধ্যে সামনের দিকে দ্রুত অপসৃয়মান সেই ফেরারি গর্জনের গলা যখন ক্রমশ মিইয়ে আসছে যখন মনে হল, আচ্ছা কী কারণে অভ্র এই প্রশ্ন করল তা তো জানি না? দেশে তো ওরা অহরহই দেখে এরকম অনেক গৃহহীন মানুষ। তখন তো ওরা অবাক হয় না! তাহলে কি সারাক্ষণই ওরা যে নানানভাবে নানান দিক থেকে নানান জনের কাছে দেশ হিসাবে আমরা যে খুব গরিব এবং অকিঞ্চিতকর তা শুনে শুনে ধরে নিয়েছে যে, আমাদের দেশটাই শুধু দরিদ্র গৃহহীনদের, বাকি পৃথিবীতে আছে সবাই দুধে ভাতে? কিন্তু নাহ, বছর দুয়েক আগে ওরা তো শীতের রাতে প্যারিসের রাস্তায়ও এরকম গৃহহীন মানুষ দেখেছে। ওইসময় অভ্র আজকের মতো এরকম জটিল অব্যর্থ একটি প্রশ্ন না করলেও, অবাক হয়ে সেদিনও সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

আরেকটা ব্যাপার! প্যারিসের রাস্তায় বা আমেরিকায় গৃহহীন মানুষ দেখে এই আমি নিজেও মোটেও অবাক না হলেও, এই বেইজিং শহরে এখন ঐ নীচের সিঁড়িতে বসে যে লোকটি তার হাতের বাদ্যযন্ত্রটি তে টুং টাং সুর তোলার চেষ্টা করছে, তাতে কিন্তু অবাক হয়েছি! কেন এরকম হল? এ কি তাহলে মাও সমাজতান্ত্রিক চীনের পুঁজিবাদের পথে পা বাড়ানোর পরিণতিতেই হল? নাকি এ সমস্যা ছিল সমাজতান্ত্রিক চীনেও? প্রদীপের নীচে সবখানেই কি তাহলে থাকে অন্ধকারের বসবাস?

আচ্ছা, ফেরারি উত্তেজনা শেষে অভ্র যদি সেই প্রশ্ন করে ফের করে, কী দেব উত্তর তবে? উত্তরে কী বলবো যে, শোন বাবা চীনে এসে তোমরা নানান জায়গায় যে রোলস রয়েস, ফেরারি, এস্টন মার্টিন দেখে বা কোটি কোটি টাকা দামের ঘড়ি দেখে অবাক হয়েছ, তোমরা কি জানো ওইরকম একটি গাড়ি বা ঘড়ির দামে কতজন মানুষের মুখে ভাত জোটে? কিম্বা হয় তাদের গৃহসমস্যার সমাধান? এই পৃথিবীতে যতো ঐরকম গাড়ি, ঘড়ির মালিক আছে তার চেয়ে ঢের বেশি আছে এইরকম দরিদ্র মানুষ। মানবনির্মিত সমাজের এ এক কুটিল সমস্যা, যার সমাধান জানলেও তা সেই সমাধান করতে পারেনি মানুষ এখনো!

কী ব্যাপার, তুমি যে এখানে দাঁড়িয়ে আছো? দেখছো না ওরা ঐ দিকে দৌড়াচ্ছে? ওদের থামাও। আমি কিন্তু ঐদিকে আর যেতে পারবো না এই ঠাণ্ডায়, গেলে যাবো ডান দিকে।’

পেছন থেকে লাজুর বলা কথাগুলো কানে যেতেই, দেখি জগিংয়ের ভঙ্গিতে, ‘এই বাচ্চারা এভাবে দৌড়াবে না, দাঁড়াও দাঁড়াও ‘বলতে বলতে হেলেন যাচ্ছে এগিয়ে। তাতেই লক্ষ করলাম দ্রুত অপসৃয়মান ফেরারিটিকে যতোটা পারা যায় ভাল করে দেখার জন্য তুমুল উত্তেজনায় উচ্চস্বরে কথা বলতে বলতে দুইপুত্র এরই মধ্যে, মেট্রো রেলের সেই পাতাল স্টেশনের মুখ থেকে ডানে সরে দৌড়াতে শুরু করেছে এখানকার মাঠ সদৃশ ফুটপাতের সামনের দিকে, মানে এয়ারপোর্টমুখি সড়কের প্রান্তে। যদিও জানি নামবে না ওরা ফুটপাত থেকে মূল সড়কে। তারপরও একদিকে স্ত্রী আজ্ঞা শিরোধার্য করে অন্যদিকে ‘সাবধানের মার নাই’ ভাবতে ভাবতে নিজেও এগুলাম হেলেনের পিছু পিছু।

ওদের দিকে এগুতে এগুতে মূলরাস্তার সামনের দিকটার চোখজরীপ করে মনে হল এখান থেকে সামনে গিয়ে তো লাভ নাই আসলেই। কারণ সামনের ঐ ব্লকটা তো ফাঁকা দেখছি। লাজু তো ঠিকই বলেছে। বরং এদিকটায় ঐ যে পার্কটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেটির ডানে গেলেই তো পারি। বিমানবন্দরমুখী মূল সড়কের পেট থেকে বেরিয়ে এই ব্লকে যে রাস্তাটি গেছে ডান দিকে, সেটি পেছনে ফেলে আসা ব্লকগুলোর পাশ রাস্তা থেকে ঢের বেশি চওড়া। ফলে এটিকে পেছনের ব্লকগুলোতে যে রকম পাশ সড়ক আছে ঐরকম কিছু মনে হচ্ছে না। বরং এটিকেও মনে হচ্ছে আরেকটা মূল সড়কই। আচ্ছা সেদিন যে লি খাঁ আমাদের তিয়েন আন মেন স্কয়ারে নিয়ে গিয়েছিল, তখন সে তো সোজা রাস্তায় কিছুটা এসে, ডানে মোড় নিয়েছিল, এটি কি সেই সড়ক নাকি?

নিশ্চিত নই এ ব্যাপারে। তবে মনে হচ্ছে এদিকটা দিয়েও যাওয়া যেতে পারে তিয়েন আন মেনে, যদিও ওইখানে যাওয়ার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে লাজু কিছুক্ষণ আগে, যার ব্যত্যয় করা যাবে না। তবে মনে পড়ছে ওইদিকটায়ও বেশ কিছু শপিং মল দেখেছিলাম। আর অভ্রর জন্য যে পেটশপ খুঁজতে বেড়িয়েছি, গুগুল ম্যাপে দেখা তথ্যানুযায়ী সেটি যেহেতু মেট্রো স্টেশনের কাছে ধারেই হওয়ার কথা, থাকলে আছে সেটি ঐ ডানেই।

মনে মনে দ্রুত এসব চিন্তা করে পেছনে ফিরে লাজুকে হাত ইশারায় এখানেই অপেক্ষা করতে বলে, দ্রুত এগুলাম পুত্রদ্বয়ের দিকে। দাঁড়িয়ে আছে ওরা এখন সোজা রাস্তার ফুটপাতের ঐ পাড়ে যাওয়ার জন্য এদিকটার জেব্রা ক্রসিং এর মাথায়। ইতিমধ্যে হেলেন ওদের কাছে গিয়ে পৌঁছলেও, এখান থেকেই বুঝতে পারছি, ওর কথা মেনে ফিরে আসতে চাইছে না ওরা। দাঁড়িয়ে আছে ঠায় ওরা ঐ জেব্রাক্রসিংয়ের লেজেই। ডান দিকের রাস্তাটি যেহেতু চওড়া, এখানকার জেব্রাক্রসিংটিও তাই। পুত্ররা নিশ্চয় ভাবছে ঐদিকেই যাওয়ার কথা আমার। হেলেনের কথায় তাই ফিরতি না হাঁটা না দিয়ে ওখানেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাবা, বাবা মা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? আর এন আমাদের পেছনে চলে আসতে বলছে কেন? আমরা তো সামনে যাবো তাই না?’

ফুপ্পির সাথে তর্ক করতে করতে দীপ্র ঘাড় ফেরাতেই আমাকে এগুতে দেখে বিরক্ত হয়ে গলা উঁচিয়ে একথা বলতেই, গলা উঁচু করে বললাম, না বাবা আমরা আর সামনে যাবো না। চলে আসো এদিকে?

নাহ কাজ হলো না তাতে। দুজনেই দেখছি দাঁড়িয়ে এখনো তর্ক করছে ফুপ্পির সাথে। মনে হচ্ছে যতোই গা সওয়া হয়ে উঠুক না কেন বেইজিং হিম আমাদের বাঙ্গাল শরীরে, কিন্তু একটু আগে বলা বাংলা কথাগুলোর তা হয়তো হয়নি এখনো। সেজন্যই কথাগুলো আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এতোটুকু দূরত্ব পেরিয়ে ওদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেনি। বরং মাঝপথে জমে বরফ হয়ে টুপ করে পড়ে গেছে ফুটপাতে। কানে পৌঁছেনি ওদের তাই আমার বলা কথাগুলো।

অগত্যা দ্রুত হাঁটাকে জগিংয়ে রূপান্তরিত করে এগিয়ে ওদের মাঝে এসে বললাম, ফুপ্পির কথা শুনছো না কেন? রাস্তা পেরিয়ে ওইপাশে কেন যাবো? দেখছ না ঐ জায়গাটা ফাঁকা। ডানে গেলেই পাওয়া যেতে পারে পেটশপ।

আমার কথায় দুজনে ভড়কে গেলেও, পেটশপ খোঁজার কথা শুনতেই অভ্রর মুখে ফুটল হাসি। একই সাথে দীপ্রও সায় দিয়ে বলে উঠল ‘ওহ তাইতো ওপারে তো দেখছি কিছু নাই। চল যাই’

সদলবলে ওদের নিয়ে ঘুরে জোর পায়ে ফিরতি হাঁটা দিতেই দেখি মিটার পঞ্চাশেক পেছনে অপেক্ষায় রেখে আসা, লাজু দাঁড়িয়ে নেই। হাঁটাহাঁটি করছে ও ওইখানটাতে সামনে পেছনে আড়াআড়িভাবে ফুটপাতে। বুঝলাম বেইজিং হিমকে গায়ে হুল ফুটানোর সুযোগ দিতে চায় না ও। সেজন্যই ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় না থেকে, হাঁটছে সে ঐ পাতাল স্টেশনের ঢোকার সুড়ঙ্গ মুখের সামনে পেছনে এমনভাবে যাতে থাকি আমরা এই অচেনা শহরে দৃষ্টির গোচরে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এখান থেকেই ওর হাঁটার মধ্যকার খোঁড়ানোর ভঙ্গিটি। প্রমাদ গুনলাম মনে মনে। কারণ এ হলে তো খুব বেশিদূর এগুতে রাজি হবে না ও সামনে।

আচ্ছা, ও এরকম খোলা রাস্তায় না হেঁটে, ঐ সুড়ঙ্গটায় ঢোকার জন্য যে সিঁড়ি আছে তা বেয়ে একটু নীচে নেমে দাঁড়ালেই তো হিমঝাপটা কম লাগতো। বিশ্রাম পেতো তাতে তার পাও। একথা মনে হতেই হাতের ইশারায় ওকে তা বললেও, বোজাতে পারলাম না কিছু।

বাবা, আমি কি এই টাকাটা দিতে পারি ঐ হোমলেস লোকটাকে?’ পাশ থেকে এসময় অভ্র বলে উঠতেই ওর দিকে তাকাতেই দেখি, পকেট থেকে ও বের করে এনেছে দশ রেন মেন বির নোট একটা।

অবশ্যই পারো দিতে। তা তুমি এই টাকাটা পেলে কোথায়?

আমার উত্তরের প্রথম অংশ কানে যেতেই দ্বিতীয় অংশ আর শোনার অপেক্ষা না করে এরই মধ্যে দিয়েছে ভোঁ দৌড় অভ্র! সঙ্গী হয়েছে সাথে দীপ্রও।

হঠাৎ করেই আমার হাত থেকে ছুটে গিয়ে দুই ভাইয়ের এই দৌড় দেয়া দেখে কি বুঝলো হেলেন জানি না, ‘আস্তে, আস্তে দৌড়াও মনু, পিকাসো বলতে বলতে হেলেনও এগুতে লাগলো ওদের পিছু পিছু জগিং এর ভঙ্গিতে। ফলাফল? হিমের কারণেই হোক আর ওদের তিনজনের গতি বৃদ্ধির ডমিনো ইফেক্টের কারণেই হোক, জগিং করে এগুতে শুরু করলাম নিজেও।

এগুতে এগুতে মন ভাল হয়ে গেল এই ভেবে যে ছোট পুত্রটি আমার যতোই ফেরারির ঘোরে পড়ুক না কেন একটু আগে, ভুলে যায়নি মোটেও তাতে সে, ঐ সুড়ঙ্গের সিঁড়িতে ভিক্ষার আশায় বসে থাকা সেই লোকটির কথা!

এই, এই তোমরা যাচ্ছ কোথায়? ওইখানে যাচ্ছ কেন?” আমার থেকে মিটার বিশেক দূরে হাঁটাহাঁটি করতে থাকা লাজু ওরই সামনে দিয়ে সুড়ঙ্গের সিঁড়ির দিকে এগুতে থাকা পুত্রদের উদ্দেশ্যে এসময় চেঁচিয়ে উঠলেও কাজ হলও না তাতে।

থাক, থাক, কিছু বলো না ওদের। অভ্র ঐ লোকটাকে টাকা দিতে চায়, তাই যাচ্ছে ওখানে। জগিংয়ের ভঙ্গিতে এগুতে এগুতে গলা উঁচু করে বললাম লাজুকে। কিন্তু বরাবরের মতোই কাজ হলো না তাতে। আমার কথার কানাপয়সাও পাত্তা না দিয়ে নিজেও এগুতে শুরু করলো ও হেলেনের পিছু পিছু পুত্রদের লক্ষ করে, সুড়ঙ্গের সিঁড়ির দিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে অতপর আমি যখন এসে দাঁড়িয়েছি সেই সুড়ঙ্গের সামনে, দেখি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে ওরা সকলে। সবার আগে উপরে উঠে আসা অভ্র আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে তুমুল তৃপ্তিতে।

এগিয়ে গিয়ে, ভেরি গুড বাবা বলে ওর কপালে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা বাবা, যদি কোন এক দেশে গিয়ে দেখো যে, সেখানে কিছু লোকের ফেরারি, লাম্বারগুনি থাকলেও অনেক লোক আছে ওখানে যাদের ঘর নাই, এমন কি খেতেও পায় না তারা। আবার আরেকটা দেশে গিয়ে দেখলে কারোই ওইরকম দামী গাড়ি নাই, কিন্তু সবারই থাকার ঘর আছে। খেতেও পায় ওরা সবাই ঠিকঠাক মতো, তবে এই দুটো দেশের মধ্যে কোন দেশটাকে তোমার ভাল মনে হবে?

ধন্দে পড়ে গেল অভ্র মনে হচ্ছে, প্রশ্নটা শুনে। সাথে সাথেই তাই দিল না কোনও উত্তর। একটু ভেবে কিছুটা অনিশ্চিতভাবে বলল ‘পরের দেশটা ভালো হবে।’ এ উত্তরে ওকে ফের একটা চুমু দিতে যাচ্ছি যখন, পেছন থেকে তখন দীপ্র বলে উঠল

কেন, বাবা ওরকম হতে হবে কেন? এরকম কি হতে পারে না, যে অনেকের ওইরকম গাড়ি থাকার পরও সেই দেশে কেউ না খেয়ে নেই। আবার সবার বাড়ীও আছে?’

লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের নারীর এগিয়ে চলা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতিবন্ধীদের কল্যাণ ও উন্নয়ন