দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৮ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

ভাইয়া, ভাইয়া এই যে দেখো একটা গোল্ডেন রিট্রিভার আসছে ।”

মহানন্দে অভ্রর করা এই ঘোষণাতেই দেখলাম এরই মধ্যে কোত্থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে বড়সড় লম্বা কানের লোমশ আরেকটা কুকুর। ঐ ঘোষণার সাথে আগেকার পুডুলটাকে বড় ভাইয়ের হেফাজতে রেখে নবাগত গোল্ডেন রিট্রিভার মহাশয়কে আদর করতে লাগল অভ্র।দুটো ভিনদেশি পথের কুকুরের প্রতি পুত্রদের এই অপত্য মমতা দেখতে দেখতে ভাবছি, প্রকৃত আদরের, মমতার, ভালবাসার অদৃশ্য চৌম্বক আকর্ষণ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব বলে বড়াই করা মানুষ অবলীলায় উপেক্ষা করতে পারলেও, কুকুর বিড়ালের মতো নিতান্তই নিম্নস্তরের প্রাণির সে ক্ষমতা নাই সম্ভবত। আর না হয় , অচেনা একটা জায়গায় এসে দু’টি ভিনদেশি বালক, একটি কুকুর কে আদর করছে, এমত দৃশ্যে আকর্ষিত হয়ে আরেকটি কুকুর চলে আসবে কেন? মজার ঘটনা হচ্ছে এমনিতে কুকুরে কুকুরে কামড়া কামড়ির সম্পর্ক থাকলেও, এই দুই কুকুর দেখছি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। দুটি কুকুরই লেজ নাড়তে নাড়তে অতি সহজেই বন্ধুত্ব স্থাপন করে আদুরে কুই কুই শব্দ করে লাফ ঝাপ দিয়ে খেলতে শুরু করেছে পুত্রদের সাথে।

অন্যদিকে বেশ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েএ নিয়ে পুত্রদের নিরাপত্তার আশংকায় তাদের মায়ের বাড়ছে উদ্বেগের মিটার। তাতে অবস্থা হলো আমার শাখের করাতে পড়ার মতো।

কারণ কুকুর বিড়াল বিষয়ে দু পুত্রের তুমুল আগ্রহের সাথে, এ বিষয়ে তাদের ফুপ্পিরও তুমুল প্রশ্রয় থাকায় , এ নিয়ে মাঝেমাঝেই ভাবি ননদের মধ্যে তৈরি হয় নিরব দ্বৈরথ। যেমন এখনো হেলেন ভ্রাতুষ্পুত্রদের এই কুকুরপ্রেমের পালে হাওয়া দিতে দিতে, কুকুর দুটোর প্রতি নানান আদুরে শব্দ ছুড়তে ছুড়তে, তুলছে ভাতুষ্পুত্রদের সাথে ওদের খেলাধুলা করার নানান ভঙ্গি আর মুহূর্তের ছবি। অবস্থা আমার শ্যাম রাখি না কূল রাখি! ননদ ভাবীর আসু সম্ভাব্য দ্বৈরথ থেকে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে তাই মরিয়া হয়ে পুত্রদেরকে বললাম, অনেক হয়েছে বাবারা। চল এখন সামনে যাই, বলেই দুজনকে বগলদাবা করে সামনের দিকে, মানে ঐ বিশালাকৃতির গেট সংলগ্ন সম্ভাব্য টিকিট ঘরের দিকে এগুতে শুরু করলাম।

কিন্তু আমি ওদেরকে কুকুরদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনলে কি হবে? ঐ যে বললাম ভালবাসার, মমতার সেই চৌম্বক আকর্ষণে কুই কুই করতে করতে তিড়িংবিড়িং লাফাতে লাফাতে ওদের গা শুঁকতে শুঁকতে, দু ভাইয়ের পাশাপাশি ওরাও এগুতে লাগলো। আর ওরা দুজনেই আদুরে গলায় বাংলা আর ইংরেজির সাথে হাতের ইশারায় দুটিকেই বলছে না এগুতে। সাথে এও নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে ফেরার পথে দেখা হবে আবার। অবাক ব্যাপার তাতে কাজও হলও দেখলাম।

এসময় সামনে এগুতে এগুতে লি খাঁকে ডাকলাম হাতের ইশারায়। যেখানে খোদ বেইজিং এয়ারপোর্ট থেকে শহরে আসার বাসের টিকিট কাটতে গিয়েই যখন ওখানকার টিকিট বাবুর সাথে পড়েছিলাম তুমুল ভাষা বিভ্রাটে, তদুপরি বেইজিং শহরের লি খাঁর সাথেও তো করতে পারছি না বাৎচিত ঠিকঠাক মতো, সেখানে এ তো হলো মুতিয়ানু গ্রাম। গত দুই দিনের পরিচিত লি খাঁকে যদিওবা বোঝাতে পারি কথা,এখানকার টিকিট বাবুকে তো তা পারবো না।

আমার ডাকে দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকা লি খাঁ কাছে আসতেই তাকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারণ করলাম টিকিট উত্তরে ‘ওকে, ওকে’ বলে গেটের ওপাশে ভেতরের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা কতগুলো সম্ভবত ব্যাটারি চালিত পরিবেশবান্ধব গাড়ী দেখিয়ে লি খাঁ কিছু একটা বললো । কি বলল লি খাঁ তা বুঝতে না পেরে মুখের সাথে সাথে হাতের ইশারায় তাকে, বললাম বাপু দাও তো তোমার সেই দোভাষী ফোন। এখন আবার ঐ গাড়ি ভাড়া করতে হবে কেন? আমরা তো হেঁটে উঠবো।

জ্যাকেটের পকেট থেকে দোভাষী ফোন বের করে হাতে দিতেই, মহাপ্রাচিরে হেঁটে ওঠার টিকিট চাই আমরা এই কথাটাই লিখলাম শুধু সংক্ষেপে । সাথে সাথে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লি খাঁ দোভাষী ফোনের অনুবাদটা পড়ে, আমারই হাতে ধরা তার সেই ফোনের বোতাম টিপে লিখল ১৮০।

এবার পাহাড়ের দিকে এগুতে এগুতে ফের ভাবনা এলো, আচ্ছা পারবে কি দলের সবাই ঐ পাহাড়ে উঠে তার মাথায় বসানো মহাপ্রাচীরে পা রাখতে?

ভাইয়া, ভাইয়া, বাবা,বাবা ঐ যে দেখো বার্গার কিং” এ কথা বলতে বলতে হৈ হৈ করে অভ্র সেদিকে দৌড় দেবার চেষ্টা করতেই , দ্রুত ওকে টেনে ধরে থামিয়ে বললাম, ঠিক আছে লাঞ্চ করবো আজ আমারও ওখানে। এখন চল গ্রেটওয়ালে ওঠার জন্য ঐ পাহাড়ে উঠি আগে।

না না বাবা , আমরা তো কিছু খাবো না। একটু দেখে আসি না ওটা।’ আব্দার করলো দীপ্র। “কি বললে , পাহাড়ে উঠতে হবে কেন ?” যুগপৎ অবাক উদ্বিগ্ন গলায় করা লাজুর এই প্রশ্নের উত্তরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, মহাপ্রাচীরটাই যে বানানো হয়েছে পাহাড়ের উপরে।

ওহ তাই নাকি ? পাহাড়ের উপর মহাপ্রাচীর বানিয়েছে কেন ওরা? শ্‌ত্রুরা অতো উঁচু পাহাড় ডিঙ্গাতে পারলেও ঐ দেয়াল বুঝি ডিঙ্গাতে পারবে না?”

পাহাড়ে উঠার ব্যাপারে নিজের এমুহূর্তে অপারগতা বা অনীহা প্রকাশ না করায় মনে মনে বউকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে দিতে ওরা কথায় সায় বললাম, কথা সত্য। খুব ভাল যুক্তি দিয়েছ। ঠিক একথাটাই আমিও ভেবেছিলাম একসময় অনেক। পরে বুঝেছি চায়নিজ রাজারা এবং তাদের সেনাপতিরা সম্ভবত পাহাড়ের উপরে ঐ প্রাচীর আর ওয়াচ টাওয়ার বানিয়েছিল যাতে তাদের সৈন্যরা ঐ দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে পাহারায় থেকে, সর্বক্ষণ চোখ রাখতে পারে কোনো শত্রু আসছে কি না , পাহাড়ের ওপাশ থেকে। কতোটা সত্য বা মিথ্যা জানি না কথাটা, তবে শুনেছি তারপরও পাহাড় বা ঐ দেয়াল শ্‌ত্রু থেকে নাকি ১০০ ভাগ সময় রক্ষা করতে পারেনি সে সময়কার চায়নিজ সেই রাজাদের রাজ্য। কোন তীর ধনুক ছোড়াছুড়ি বা গোলাগুলি বিনিময় করা ছাড়াই নাকি, কয়েকবার শত্রুরা ঢুকে পড়েছিল তখনকার চায়নার সীমানায় শুধু মাত্র ঘুষের বিনিময়ে। তাহলে অত্যন্ত শক্তিশালী ও অব্যর্থ অস্ত্র ঘুষের কী ভেল্কি! আজ আমরা দুর্নীতির, ঘুষের চ্যাম্পিয়ন হলেও, আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ আর প্রয়োজনীয় আবিষ্কারের মতো, ঘুষ নামের এই অব্যর্থ অস্ত্রের আবিস্কারকও কিন্তু চায়নাই মনে হচ্ছে। দুই, আড়াই হাজার বছর আগে, আমাদের দেশে ঘুষ ছিল কী না? নিশ্চিত নই। তবে তখন যে এটা চায়নায় বেশ ভালই প্রচলিত ছিল, তার প্রমাণ তো ঐ গল্পে পাওয়া যায়। গল্প যতোই কারো কল্পিতকল্পনা হউক না কেন, ওতে বাস্তবতার ছাপ থাকেই থাকে কিছু না কিছু হলেও।

বাবা, ঐ বার্গার কিংয়ের কাছেই একটু পেছনে একটা কে এফ সিও আছে। এখান থেকে ওটা দেখা যাচ্ছে না।“ দুই ভাই তাদের রেকি শেষ করে ফিরে এসে, এ খবর জানিয়ে দীপ্র আমাদের কথার মাঝে ঢুকে পড়তেই ঠিক আছে চলো যাওয়া যাক এবার তাহলে ঐ পাহাড়ের দিকে বলে পা চালালাম সামনের দিকে।

কতোটা উঠতে হবে ঐ পাহাড়ে। আর দেখতে পাচ্ছি না কেন এখান থেকে কোন দেয়াল পাহাড়ের উপরে ? অতো উঁচু পাহাড় উঠবো কিভাবে আমরা?” সামনে এগুতে এগুতে করা হেলেনের এই উদ্বেগমিশ্রিত জিজ্ঞাসার পিঠাপিঠি , দীপ্র সগর্বে জানালো, এ পাহাড়ে উঠা তার জন্য কোন ব্যাপারই না। তবে সন্দেহ আছে এই ছেলেটাকে নিয়ে বলেই, কনুইয়ের খোঁচা মারলো ছোট ভাইকে।

না না অভ্র কি আর এখন আগের মতো ছোট আছে নাকি? ও এখন অনেক বড় হয়েছে। ঠিকই পারবে ও বলে, ওকে পাশে টেনে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম বার্গার কিং কে এফ সি এলাকা থেকে কিছুটা এগিয়ে পাওয়া লি খাঁ নির্দেশিত ডানের রাস্তাটি ধরে।

বুজতে পারছি না এদিকটাতে আগে থেকেই কি বাতাস বেশী ছিল? নাকি এ মাত্রই শুরু হলও এই জোর বাতাস? এখানে নামার পর থেকেই হালকা একটা হাওয়ার পরশ লাগছিল মুখে আর কানে। কিন্তু এ মুহূর্তে সেই বাতাসের গতি মনে হচ্ছে বেড়েছে ঢের। পাহাড়ের কাছাকাছি হওয়াতেই কি এরকম হচ্ছে নাকি? প্রত্যেকে আমরা যেভাবে স্তরে স্তরে কাপড় পরে নিজেদের একেকটা চলমান কাপড়ের বেঢপ বস্তায় রূপান্তরিত করেছি, তাতে এ হিম ভালই মোকাবেলা করতে পারলেও কমেছে সবার হাঁটার গতি। জোর এই বাতাসের ঝাপটা নাকে মুখে লেগে এখানকার হিমের যে প্রমাণ রাখছে, তাতে মনে হল গতকাল তিয়েন আন মেন স্কয়ারে যে হিমের মুখোমুখি হয়েছিলাম , তার কাছে এ হিম নিতান্তই নাবালক। আবার এও হতে পারে, ঐ যে কথায় আছে না শরীরে না মহাশয় , যাহাই সহায় তাহাই সয়, হতে পারে তাও।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতির পাতায় সিজিএস
পরবর্তী নিবন্ধঅধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান স্মরণে