মহাপ্রাচীরের ড্রাগনদ্বারে
দলের সাথে এসে যোগ দেবার পর বোঝা গেল ঘটনা। না নতুন কোনও ব্যাপার বা ঘটনা না। ঘটনা হল আমাদের এই চায়না ভ্রমণের শুরু থেকেই মানে চীনদেশে পা দেবার পর থেকে, যে দুর্দৈব কাঁধে চেপে আছে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো, ঘটনা হল সেটা। এমনিতে লাজু বা হেলেন লি খাঁ এর সাথে কথা বার্তা বলা এড়িয়ে চললেও, আমার ক্ষণিক অনুপস্থিতিতে দুজনেই লি খাঁ কে, হাত পা নেড়ে জিজ্ঞেস করছিল যেতে হবে আর কতদূর, মহাপ্রাচীরের দেখা পাওয়ার জন্য?
তাদের এ চেষ্টার ফলাফলতো আগে থেকেই জানা? ওদের প্রশ্ন আদৌ বুজতে লি খাঁ পেরেছে কি না, জানি না। তবে সে কাজ করেছে একখান, যা নিয়ে বেশ বিরক্ত দেখছি হেলেনকে। তাদের প্রশ্নের জবাবে মুখে সে যাই বলে থাকুক, তা যে দুজনের কারোই বোধগম্য হয়নি তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এরই মধ্যে লি খাঁ এক অদ্ভুত কাজ করে বসেছে, তা হল হেলেনের হাত থেকে তার ফোনটা টেনে নিয়ে বেশ কটা ছবি তুলেছে ওদের! লি খাঁর এই হঠাৎ অযাচিতভাবে ক্যামেরাম্যান না বলা উচিৎ মোবাইল ক্যামেরাম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া নিয়ে এ মুহূর্তে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হেলেন, যার আঁচ লেগেছে লাজুর উপরও।
এ ঘটনাতো তেমন কোনও গুরুতর বিষয় না। তারপরও ভাবছি যে লি খাঁই বা কেন হঠাৎ ওদের ছবি তুলতে গেল তাও যেমন বুজতে পারছি না, তেমনি এ নিয়ে দলের দুই নারী সদস্যও যে কেন বিরক্ত হল তারও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আজকাল হাতে হাতে হাতযন্ত্র থাকায় আর সে যন্ত্র ছবি তোলার মোক্ষম হাতিয়ার হয়ে উঠায়, ছবি তো তোলে মানুষ যখন তখন যত্রতত্র ইচ্ছায় অনিচ্ছায়। হতে পারে ওদের এই যে বিরক্তি, না বলা ভাল এই অস্বস্তিটির কারণ হল, বঙ্গনারীদের অচেনা পুরুষদের ব্যাপারে যে সাংস্কৃতিক সংস্কার আছে, তা। হোক কারণ যা–ই, ব্যাপারটার তো একটা রফা করতে হয়। আমাদের আজকের সার্বক্ষণিক সঙ্গী কাম গাইডের উপর দলের কারো বিরূপ মনোভাব থাকলে তো, সারাক্ষণ একটা গুমোট ভাব থাকবে। কিন্তু কি জিজ্ঞেস করি লি খাঁ কে? এ চিন্তায় ওর দিকে চোখ ঘোরাতেই দেখি সে হাত দিয়ে ইশারা করে আমাদের দাঁড়াতে বলছে তার গাড়িটিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে। বিশেষ লক্ষ তার আমাদের পুত্রদ্বয়। বারবার হাতের ইশারায় তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার বিফল চেষ্টা করছে সে, কারণ ব্যস্ত তারা লাফালাফি ঝাপাঝাপিতে।
এখনকার তার দেহভঙ্গি আর মুখভঙ্গিতে কেন যেন মনে হল, লি খাঁ তার গাড়িটি ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে আমাদের গোটা পরিবারটির ছবি তুলতে চায়। অতএব পুত্রদ্বয়কে ডেকে এনে পরিবারের সবাই গাড়িটিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে দাঁড়াতেই দেখি স্পষ্ট হাসি ফুটলো মুখে তার। প্রথমে সে নিজের ফোনে আমাদের পরিবারের ছবি তুলল পটাপট কয়েকটা। তারপর দেখি এদিকে পাশ ফিরে নিজের হাত সামনের দিকে লম্বা করে মোবাইলটি উঁচু করে ধরে আমাদের সহ সেলফি তুললো।
ছবি তোলা শেষ হতেই হাসিমুখে এগিয়ে এসে, এইমাত্র তোলা ছবিগুলো পর্দায় এনে দেখিয়ে, কিছু বলল ও মুখে। আর যাই বলে থাকুক, তার মধ্যে দুটো শব্দই বুঝলাম পরিষ্কার। যার একটি হল তার সার্বক্ষণিক বুলি ‘ওকে’। দ্বিতীয়টি হলো ‘হোম’।
এতে চকিতে মনে হল, আমাদের গোটা পরিবারটির ছবি সে বাড়ির লোকজনদের দেখানোর জন্য তুলেছে। একটু আগে যে সে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, তখন হয়তো সে তার স্ত্রীকে আমাদের কথা বলেছে। হয়তো বলেছে তার গতকালকের ও আজকের এই যাত্রীরা এসেছে বাংলাদেশ থেকে। এতে নিশ্চয় তার স্ত্রী হয়তো জিজ্ঞেস করেছে, বাংলাদেশ আবার কী? ওখানকার লোকজনই বা দেখতে কেমন? সে কারণেই লি খাঁ হয়তো আমাদের ছবি তুলেছে নিশ্চয় বাড়িতে দেখানোর জন্য। আমার এ ধারনাটির কথা সবাইকে জানাতেই এসময় হেলেন ফের, সামনে এগিয়ে এসে হাতে নেড়ে যখন আমাকে বলতে শুরু করলো যে লি খাঁ সহ ঐ রকম একটা ছবি আমাদেরও কাছেও থাকা উচিৎ; তখনি আবারো লি খাঁ ‘ওকে’ বলে, হেলেনের হাত থেকে ফোন নিয়ে ছবি তুলতে শুরু করতেই পরিষ্কার বুজলাম যে, হেলেন তার ফোন ধরা হাত লি খাঁর সামনে নাড়িয়ে কথা বলায়, সে মনে করেছে, তাঁকে বুঝি ছবি তুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। ফলে সে পালন করছে সেই অনুরোধ অক্ষরে অক্ষরে। নিজের আবিষ্কৃত এই সম্ভাব্য ব্যাখ্যাটি ওদের বুঝিয়ে বলার পর, তা মেনে নিয়ে লাজু বলল, ‘চল যাই আমরা এবার। আরো কতক্ষণ আর কতদূর যেতে হবে, তা কি জানো?’
ভুল কছু বলার চেয়ে জানি না বলা ভাল এই সূত্র মেনে অকাতরে এব্যাপারে নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করে, সবাইকে গাড়িতে ওঠার তাড়া দিয়ে লি খাঁকেও ইশারায় তা বোজাতেই, গাড়ির চাবিতে থাকা বোতাম টিপে গাড়ির পাশ দরজা খুলে দিতেই, উঠে পড়লো সবাই গাড়িতে।
সবাইকে অনুসরণ করে নিজেও লি খাঁ কে পেরিয়ে গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে ওপাশে নিজের সিটের দিকে এগুবার সময় আবারো করলাম ওকে ব্যর্থ জিজ্ঞেস, ‘হাও ফার’?
উত্তর এলো ফের সেই একই শব্দে মানে, ‘ওকে, ওকে’। যে অর্থ উদ্ধারে তিলার্ধ সময় নষ্ট না করে ড্রাইভিং সিটের পাশের আমার সংরক্ষিত সিটে বসে, দরজা টেনে দিতেই ওম ওম গরমের চাদর জড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরে।
‘বাহ কি চমৎকার গরম গাড়ির ভেতরটা! কি আরাম’। বলে উঠল পিছনের সিটে দীপ্রকে পাশে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা হেলেন, এরই মধ্যে লি খাঁ শুরু করে দিয়েছে যাত্রা।
নাহ খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না আমাদের এবারের যাত্রা। গাড়ির ওম ওম গরমে জমিয়ে বসতে না বসতে, মানে মিনিট ছয় কি সাতের মধ্যেই, লি খাঁ একটা বিরাট চত্বরে এসে, ফের ‘ওকে ওকে’ বলতে বলতে গাড়ি পার্ক করার উদ্যোগ নিতেই, এবার জিজ্ঞেস করলাম তাকে
গ্রেট ওয়াল, হিয়ার?
মাথা নেড়ে লি খাঁ এবার বললেন ‘ইয়েচ’!
এই চল। নামো সবাই। চলে এসেছি আমরা গ্রেট ওয়ালে। পেছন ফিরে সকলের উদ্দেশ্যে এ ঘোষণা দিতেই সকলের চেহারায় আর নড়ে চড়ে উঠার ভাবের মধ্যে টের পাওয়া গেল মহাপ্রাচীরের পাদদেশে পৌঁছানর মহাউত্তেজনার কিঞ্চিৎ আভাস! গাড়ি পুরোপুরি থামার আগেই দেখি, দু পুত্র সিট ছেড়ে আধা দাঁড়িয়ে গেছে নেমে পড়ার জন্য। অন্যদিকে সিটে বেশ গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা লাজু আর হেলেনের ভঙ্গিতেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, দরজা খোলামাত্র গাড়ির ওম ছেড়ে নির্দ্বিধায় বাইরের হিমে ঝাপ দেয়ার প্রস্তুতি।
এরই মধ্যে লি খাঁ তার পছন্দসই জায়গায় গাড়ি পার্ক করিয়ে, পেছনের দরজা খুলে দিতেই, হৈ হৈ করতে করতে পুত্রদ্বয় লাফিয়ে নেমে যেতেই, নিজেও গাড়ি থেকে নেমে পায়ের নীচের পাথুরে নাকি কংক্রিটের আভাস পেতে না পেতে ওপাশ থেকে
‘এই, এই খবরদার তোমরা কিন্তু ধরবে না ওটাকে’ পুত্রদের উদ্দেশ্যে দেয়া তাদের মাতার এই চরম সতর্কবার্তা কানে যাওয়ার সাথে দেখলাম সেই নয় নম্বর বিপদ সঙ্কেত উপেক্ষা করে, দু পুত্রই গাড়ির ওপাশ থেকে বেরিয়ে তীর বেগে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, এক্ষণে লোকবিরান চমৎকার এই কংক্রিট চত্বরে জুবু থুবু হয়ে বসে থাকা বাদামি রঙয়ের একটা লোমশ ছোট্ট পুতুল জাতীয় কুকুরের দিকে।
এরই মধ্যে ওদের পেছন পেছন ছুটতে শুরু করেছে দেখি তাদের মাতা ও ফুপ্পি। ছোটার ভঙ্গিতেই পরিষ্কার দুজনের উদ্দেশ্য দু’টো। মা আশঙ্কিত অজানা অচেনা জায়গার অচেনা অজানা কুকুর নিয়ে পুত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে। অন্যদিকে মোবাইল তাক করে ফুপ্পি দৌড়াচ্ছে ভাতুষ্পুত্রদের এই আনন্দঘন মুহূর্তের ছবি তুলে, ফোনের ডিজিটাল মগজে জমা করার জন্য।
তবে পায়ের ব্যথার কথা মনে করে কিম্বা আমাকে দেখতে পেয়ে লাজু তার শুরু করা দৌড় থামিয়ে দিয়ে আমার উদ্দেশ্যেই হুকুম জারী করলো
‘কী ব্যাপার, তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও না। ওদেরকে থামাও। ওরা যেন কুকুরটাকে না হাতায়। যদি কামড়ে দেয়’।
বিনাবাক্যব্যয়ে স্ত্রী আজ্ঞা পালনের উদ্দেশ্যে, মিটার বিশেক দূরে থাকা ঐ কুকুরটির পাশে গিয়ে দাঁড়ানো পুত্রদের দিকে পা চালিয়ে যেতে যেতে ভাবছি, আচ্ছা কার কুকুর এটা? এটাও কি তার মালিকের সাথে এসেছে নাকি আমাদের মতো মহাপ্রাচীর দেখতে? কিন্তু মানুষজন তো দেখতে পাচ্ছি না কোন। এ মুহূর্তে এ তল্লাটে গাড়িও তো দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাদেরটাই। তা হলে এলো এটা কোত্থেকে?
এ জাতের কুকুরকে তো সুসজ্জিত মহিলাদের কোলে সমাসীন হয়ে গাড়ি থেকেই তশরিফ আনতে দেখেছি এ যাবতকাল। এ কি তবে সেই ফেরারি যে দেখেছিলাম সেটিরই যাত্রী হয়ে এসেছে নাকি। ফেরারিটি পার্ক করেছে কোথায়? এ ভেবে এই প্রথমবারের মতো গোটা এলাকাটায় নজর বোলাতেই সামনে ডান দিকে নজরে পড়লো বিশাল আকারের আয়তাকার, লাল ইট রঙয়ের গেইটির দিকে, যাতে অনেক বড় চাইনিজ লেখার নীচে তার চেয়ে বেশ ছোট হলেও যথেষ্ট বড় অক্ষরে ইংরেজিতে বেশ ফাঁক ফাঁক করে মানে প্রতিটি চায়নিজ অক্ষর না বলা উচিৎ ছবি–অক্ষরের নীচে আলাদা করে লেখা আছে -‘গঁ ঞরধহ ণঁ’ এ দেখেই একটু আগে যে মনে করেছিলাম এসেছি মহাপ্রাচীরের পাদদেশে, তার বদলে মনে হল এসেছি তো আদতে মহাপ্রাচীরের সিংহদ্বারে। কিন্তু চায়নায় কি সিংহদ্বার আছে না কি কোথাও তা তো জানি না? এখানকার রাজরাজড়া, জমিদারদের আর বড়লোকদের বাড়ির ফটকেতো থাকলে ড্রাগনমূর্তি দাঁড়িয়ে থাকার কথা। সে হিসাবে বলা উচিৎ, এসেছিনু সবে মিলে আজ এবেলা, মুতিয়ানু মহাপ্রাচীরের ড্রাগনদ্বারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক