দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা বড়ই অবহেলিত

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

দেশে সরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ছাত্র ছাত্রীদের লম্বা লাইন দেখা যায়। এই সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য অনেকে নানা জায়গায় তদবিরও করে। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়। যারা একটু স্বচ্ছল তারা তাদের সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে চান না। দেশের কর্তাব্যক্তিরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন এমন হয়?

একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যত উন্নত, সে দেশ তত উন্নত। কারণ উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে মান সম্পন্ন শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কোনো বিকল্প নেই। আর সেই ভিতটি রচিত হয় শিশুদের শিক্ষা জীবনের শুরুতে অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে। সেজন্য উন্নত বিশ্বে শিশুদের শিক্ষা জীবনের শুরুতে একটা বয়স পর্যন্ত লেখাপড়ার বদলে প্রকৃতি, সামাজিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, মানবিক গুণাবলি ও আচার আচরণ শিখানো হয়। এতে করে তারা বড় হয়ে মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মানুষ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। উন্নত বিশ্বে শিক্ষাখাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষায়।

সেজন্য তারা বাজেটে সবচেয়ে বেশী বরাদ্দ দেয় প্রাথমিক শিক্ষায়। আমাদের দেশেও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সর্বোচ্চ। ২০২১-২২ অর্থ বছরে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ৭১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১১.৯১ শতাংশ। এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয় ২৬ হাজার ৩১১কোটি টাকা। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয় ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি ও কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে দেওয়া হয় ৯ হাজার ১৫৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ একক ভাবে সবচেয়ে বেশী বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষা খাতে। বর্তমানে সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৯৩। অর্থাৎ দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান মোটামুটি ভালো হলেও প্রাথমিক শিক্ষার মান মোটেও ভালো নয়। এই সব স্কুলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুব একটা ভাল নয়।

তার উপর রয়েছে শ্রেণী পেশা নির্বিশেষে স্কুল এলাকার সব মানুষের সন্তানদের ঐ স্কুলে ভর্তি করানোর বাধ্যবাধকতা। শ্রেণী বৈষম্য, সামাজিক অবস্থান, নিরাপত্তা ও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ঐসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে আগ্রহী হয় না। আবার এইসব স্কুলের ক্লাসের সময় সকাল ৯.১৫ হতে বিকাল ৪.১৫ পর্যন্ত।একটি অবুঝ শিশুর জন্য এটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য তাও ভেবে দেখা দরকার। সেই জন্য শহর ও গ্রামের স্বচ্ছল মানুষ তাদের সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করাতে আগ্রহী। কারণ জীবনের শুরুতে একটি শিশুকে যথাযথ মানসম্পন্ন শিক্ষা, মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয় গুণাবলীসহ যে সব বিষয় ও পরিবেশ দেওয়ার কথা, তা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিতে পারে না। বিগত বছরগুলোতে এর মানের তেমন কোনো উন্নতিও পরিলক্ষিত হয় নাই। তাই বলা চলে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারে নড়বড়ে ও অবহেলিত।

স্বাধীনতার ৫১ বছরেও আমরা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে মান সম্পন্ন করার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় নি। আমরা শিশুদের শিক্ষা জীবনের শুরুতে একগাদা বই পিঠে ঝুলিয়ে দিই, যা তারা সারা জীবন বহন করে। এতে শিশু অবস্থায় লেখাপড়ার প্রতি তাদের একধরণের ভীতি তৈরী হয়। অন্যদিকে আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটাকে পুরাপুরি প্রাইভেট সেক্টরের উপর ছেড়ে দিয়েছি। ফলে প্রাইভেট সেক্টর প্রাইমারী শিক্ষাকে ব্যবসায়ীকভাবে নিয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে। সেজন্য আমাদের দেশে প্রচুর উচ্চ শিক্ষিত মানুষ তৈরী হচ্ছে কিন্তু মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ তৈরি হচ্ছে না। অন্যদিকে আগে শিশুকে শিক্ষা জীবনের শুরুতে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হতো, এখন সেই ধর্মীয় শিক্ষা ও আমরা দিই না। ফলে এখন ধর্মীয় অনুভূতি সম্পন্ন মানুষও তৈরী হচ্ছে না।

বর্তমানে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী বেশ শক্তিশালী। সামাজিক ও রাষ্টীয়ভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণী দেশকে ডমিনেট করছে। তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার ভিতটা সরকারি প্রাইমারী স্কুলে করা হয় না। অথচ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তানেরা মাধ্যমিক ও উচ্চ শ্রেণীর লেখাপড়া সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এর প্রধান কারণ বাংলা মিডিয়ামের মান সম্পন্ন ক্যারিকুলাম, প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও ভালো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভাব। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, দেশের বড় বড় শহরগুলোতে সরকারি প্রাইমারী স্কুল গুলোর বর্তমান অবস্থা কেমন? দেশে কয়টি মান সম্পন্ন সরকারি প্রাইমারী স্কুল আছে? আমরা চাইলেও আমাদের বাচ্চাদের বাংলা মিডিয়ামের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করাতে পারি না। অথচ আমরাই একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। ফলশ্রতিতে আমাদের সন্তানেরা শিক্ষা জীবনের শুরুতে অন্য মিডিয়াম বিশেষ করে ইংরেজি মিডিয়ামে লেখাপড়া শুরু করে, যা পরবর্তিতে পরিবর্তন করতে তাদের কষ্ট হয়। বাংলা ভাষার প্রতি তাদের এক ধরনের ভয় সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষার প্রতি দরদ বা ভালোবাসা তেমন একটা থাকে না এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা ঠিকমত বাংলা বলতে ও পড়তে পারে না। আর আমরাও আমাদের সন্তানদেরকে ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলে ভর্তি করিয়ে গর্ববোধ করি।

অন্যদিকে ইংরেজি মিডিয়ামে শিক্ষা জীবন শুরুর কারণে ওরা দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করতে চায় না। মাটি ও মানুষের প্রতি তাদের কমিটমেন্ট ও ভালোবাসা তৈরী হয় না। দিন দিন তারা বিজাতীয় সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির প্রতি বিশেষত মোবাইল, কম্পিউটার, টেলিভিশন ইত্যাদির প্রতি ঝুকে পড়ে। ফলে গল্প, উপন্যাস, কবিতা বা পেপার পত্রিকা পড়তে চায় না। এতে করে তারা আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য হতে দূরে সরে যাচ্ছে এবং ভিনদেশি কালচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। আর একটি বিষয় আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে দেশে এখন বিজাতীয় চ্যানেলের আগ্রাসন চলায় সব বয়সের মানুষ বিশেষভাবে শিশুরা এখন ঐ সব চ্যানেলে প্রতি এডিকটেড হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা ঐসব ভাষা ও সংস্কৃতি অনুসরণ ও অনুকরণ করছে। যা ভবিষ্যত প্রজন্ম ও দেশের জন্য অশনি সংকেত।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনগর পরিচালনায় মহিউদ্দীন চৌধুরী মডেল
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল