সিডনি চোখ ধাঁধানো নববর্ষ উদযাপন করে আলোকসজ্জা আর আতশ বাজির উৎসব দিয়ে। এটি দুনিয়া স্বীকৃত এক আলোক উৎসব। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে এ দেশে এসে জানতে পারি এখানে তখন গ্রীস্মকাল। উত্তাপ আর গরম বাতাসের সাথে মাঝে মাঝে বন বাদাড়ে আগুন লেগে যাবার দিনকাল। আমি প্রথমবারের মতো সিডনি অপেরা হাউস আর হার্বার ব্রিজের নীচে বসে সে আতশ বাজির উৎসব দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। বছর চলে যায় সময় ও বহিয়া যায়। সে উৎসব এখন আর তেমন টানে না। আমার নিকটতম আত্মীয়ের বাড়ি এখন এমন এক জায়গায় যেখান থকে চোখে দেখাতো বটেই মনে হবে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় এই দৃশ্য। এখন আমরা সেখান থেকেই তা অবলোকন করি।
বলাবাহুল্য বাংলাদেশেও এই উৎসব নানা ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে চলছে। তারুণ্যের ভেতর যে প্রাণ উন্মাদনা আর ভালোলাগা তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যাবে না। তারা এই উৎসবকে আন্তর্জাতিকতার ভেতর দিয়ে গ্রহণ করেছে। তাদের চাই নির্মল আনন্দ। প্রবাসের যে ভালো দিকগুলো তাদের ভেতর ছড়িয়ে পড়া উচিৎ ছিল আমরা কি তা করতে পেরেছি ? এই প্রশ্নের উত্তরে রাজনীতি টেনে না আনাই হবে মঙ্গলের। আমরা যে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা শুনছি বা যে আগ্রহের কথা জানতে পারছি মূলত তার সাথে এর যোগ হওয়া দরকার। না হলে কোন জাতিই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না । সে কারণে আমরা প্রবাসের বাংলাদেশী সমাজে আরো বেশী গণতন্ত্র ও উদারতার চর্চা করবো। করবো না হানাহানি বা অধ:পতনের লড়াই।
নববর্ষের শুরুতেই বাংলাদেশ দ্বাদশ নির্বাচনের মুখোমুখি। এই নির্বাচন বহু কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা সহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর বিরোধিতা এবং তর্কের ভেতরে আছে স্বদেশ। বিএনপি শুধু বিরোধিতা নয় হরতালের ও ডাক দিয়েছে তারা। বিএনপি‘র রাজনৈতিক ভুল আর ভ্রান্তির কারণে তাদের অস্তিত্ব পড়েছে গভীর সংকটে । জনগণের কোন সায় আছে কি নাই তার তোয়াক্কা না করে তারা গায়ের জোরে যা করছে পরিণাম ভালো হবে বলে মনে হয় না । আসল কথা হলো নির্বাচন হবে আর সে কারণেই আমরা আলোচনা করব সামনের দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ আসলে কি করতে চাইবে বা চাইছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান‘ স্লোগানে ইশতেহার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের অর্জন এবং আবারও ক্ষমতায় গেলে দেশের উন্নয়নে তাঁদের যে কর্মপরিকল্পনা তা তুলে ধরা হয়েছে ইশতেহারে। ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮–এর নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনাগুলোর ধারাবাহিকতা দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনী ইশতেহারেও রক্ষিত হয়েছে। এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ১১টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। যেমন– ১. দ্রব্যমূল্য সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ২. কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা ৩. আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা ৪. লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ৫. দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো ৬. ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ৭. নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা ৮. সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সকলকে যুক্ত করা ৯. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ১০. সামপ্রদায়িকতা এবং সকল ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা এবং ১১. সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যেই এই ১১টি বিষয়ে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করেছে। আর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই ১১টি বিশেষ বিষয়ের প্রতিটির গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহারেই জাতির সামনে একটা আশাজাগানিয়া ও অনুপ্রেরণামূলক স্লোগান তুলে ধরে আওয়ামী লীগ। এইবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে স্লোগান ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। ২০১৮ সালে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ স্লোগান ছিল ইশতেহারে। ২০১৮ সালের সেই ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ ইশতেহারে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও ২১০০ সালের মধ্যে নিরাপদ ব–দ্বীপ গড়ে তোলার পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছিল। অতীতের ন্যায় এইবারও তরুণ সমাজকে কাজে লাগিয়ে তারুণ্য নির্ভর একটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
১ নাম্বারে যে আশা বা প্রতিশ্রতি তার গুরুত্ব সর্বাধিক। বিশ্বব্যাপী মন্দা যুদ্ধ আর করোনা বাস্তবতায় সব দেশেই মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারী দল দ্রুত আন পপুলার বা অজনপ্রিয় হয়ে পড়ছে। আমাদের এই প্রশান্ত মহাসাগর পারেও এক হাল। লিবারেল দলকে হটিয়ে দেশ শাসনে আসা লেবার দলের অবস্থা ক্রমেই নাজুক হয়ে উঠছে। যার কারণ বাজার। আমাদের দেশে এই বাজার বা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রথম বাধা সিন্ডিকেট। শোনা যায় মন্ত্রী মিনিস্টার সহ বহু বড় মাপের আমলাও নাকি এর সাথে জড়িত। শস্যের ভেতরে থাকা ভূত কিভাবে সামলাবে সরকারী দল? সে ব্যাখ্যা থাকলে ভালো হতো। মনে রাখা উচিৎ এবার তারা যে ম্যান্ডেট পাবেন বা পেতে চলেছেন বলে মনে করা হচ্ছে তা গত দুবারের তুলাব কষ্টার্জিত। এবং তার অপব্যবহার হলে সময় ছেড়ে কথা বলবে না।
বাকী দফা বা পয়েন্টগুলোর ভেতর ৯ নাম্বারে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা বিষয়টি অবিলম্বে নজরে আনা প্রয়োজন। মানবাধিকার লঙ্ঘন বা এ জাতীয় কাজগুলো বিদেশিদের চোখে ভয়ংকর অপরাধ। গাজায় কত মানুষ মরলো বা সন্ত্রাসীরা কত মানুষ মারলো কিংবা কোন দেশে জঙ্গিরা হামলা করলো তারচেয়ে ও তাদের উদ্বেগ এসব বিষয়ে অধিক। বলাবাহুল্য আমরা তার বাইরে থাকতে পারি নি।
সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে পয়েন্টটি ১০ নাম্বারে আছে আসলেই কি সে বিষয়ে আওয়ামী লীগ সতর্ক? বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযাত্রী চার জাতীয় নেতাদের মতো কি আজকের নেতারা হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান আদিবাসী সহ বাকীদের ব্যাপারে আন্তরিক? নানা কারণে যে আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ তার জবাব কি মিলবে এবার? সামপ্রদায়িকতা মূলত আওয়ামী লীগের একাংশেরো হাতিয়ার । এর অপব্যবহার রোধ না হলে জঙ্গীবাদ দমন করা যাবে না।
এরপরে দলটি সর্বস্তরে গণতন্ত্র চর্চার ওপর জোর দিয়েছে। আমরাও তা চাই। আজ দেশের একাংশ বিশেষ করে বিরোধী নামে পরিচিতদের বড় অভিযোগ গণতন্ত্র নাই। আসলেই কি আছে? থাকলে আমাদের দেখা বাদ প্রতিবাদ গ্রহণ বর্জনের সমাজে আজ সব নেতিয়ে পড়ছে কেন? আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা আওয়ামী লীগ এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ই পারবে গণতন্ত্রের পথ খুলে দিতে। আর তা যদি হয় বা হতে থাকে রাজনীতির জন্জাল ও সাফ হতে শুরু করবে। কারণ মানুষ কথা বলতে পারলে বা কথা বললে আর কোন দেশী বিদেশী শক্তি ই তার প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
বাংলাদেশের জন্ম থেকে অর্জনের দায়িত্ব নেয়া দল আওয়ামী লীগ। পাক প্রীতি ও পাকিস্তান ভাঙার জন্য নাখোশ যেসব অপশক্তি দেশে আছে তাদের মুখের ওপর জবাব দিতে পারে একমাত্র আওয়ামী লীগ। তাই এবারের ইশতেহারকে আমি গুরুত্বপুর্ণ মনে করি। একটা বিষয়ের উল্লেখ থাকলে আমার মনে হয় চমৎকার হতো। দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও বহু অসাধারণ মানুষের সাথে আওয়ামী লীগের যে দূরত্ব তা কমানো উচিৎ। এতে দল ও দেশ উভয়ের লাভ। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে কোন ভুল ভ্রান্তি হলে তার জন্য মাফ চাইতেও দ্বিধা করেন নি। এখন সময় সামনে তাকানোর । কোথায় যাচ্ছে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশ?
লেখক : কবি–প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট