দূরের দুরবিনে

বাংলা ও বাঙালি : মহাবিশ্বে মহাগগণ মাঝে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৯:৪১ পূর্বাহ্ণ

বাংলা ভাষার কি সত্যি দুর্দিন চলছে? এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে বলতে চাই আপনি যদি গুগল সার্চ করেন দেখবেন জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ভাষার ভেতর বাংলা আছে হয় পঞ্চম অথবা সপ্তম অবস্থানে । কোন কোন তধ্য সূত্র এটা নিয়ে মতান্তরে বিশ্বাসী হলে ও সবাই স্বীকার করেন বাংলা আছে প্রথম দশে। মেন্ডারিন যা কি না চাইনিজদের প্রধান ভাষা সে আছে এক নাম্বারে। স্প্যানিশ ইংলিশ ফ্রেন্স হিন্দী এর পরেই বাংলা। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন লেখেন ও পড়েন। চাইলেই ভাষাটিকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নাই । এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা এর জন্য কি করছি?

একটা কথা বলা যেতেই পারে যে দেশের চাইতে বিদেশে প্রবাসীদের ভেতর বাংলা চর্চা অধিক। প্রথমত দেশ ছেড়ে আসার বেদনা পরে যোগ হয় সন্তানদের চিন্তা। নতুন প্রজন্ম যেন বাংলা ভাষা ভুলে না যাব বা পড়তে লিখতে পারে সে জন্য মা বাবাদের আকুলতা দেখার মতো। দেশে যেমন অভিভাবকেরা টাকা পয়সা খরচ করে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে বিদেশে ঠিক তার উল্টো। সপ্তাহান্তে বহু আশা ও বিনোদনের ছুটির দিনে ও তারা বাচ্চাদের বাংলা পড়াতে বাংলা শিখাতে নিয়ে ছোটে । অনেক দূরে দূরে গিয়ে বাঙালিদের গড়ে তোলা বাংলা স্কুল গুলোতে বাচ্চারা পাঠ নেয়। এমন কোন বিদেশে বসবাসরত বাঙালি পরিবারের দেখা মিলবে না যাদের সন্তান বাংলা বোঝে না। বা বাংলা বলতে জানে না। এই প্রাথমিক পাঠ দানের পেছনে যে আবেগ ই কাজ করুক না কেন আখেরে এতে আমাদের মাতৃভাষাই প্রাণ পায়। শক্তি খুঁজে পায় নবীন প্রজন্মে ।

গবেষক ইফতেখার মাহমুদ লিখেছেন: জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়াত প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের পাশাপাশি মার্টিন কেম্পশেন বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ ও গবেষণা করেছেন। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের হান্স হারডার গবেষণা করেছেন চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার নিয়ে। তিনি প্রাচীনতম বাংলা কবিতা চর্যাপদ নিয়েও গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন।

পোল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এলভিয়েতা ওয়াল্টার বাংলা থেকে পোলিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণ অনুবাদ করছেন। বেলজিয়ামের নাগরিক ফাদার দ্যতিয়েন গবেষণা করেছেন বাংলা ভাষার পুরোনো বই ও পাণ্ডুলিপি নিয়ে। সেসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন মৌলিক সাহিত্য। অতি সমপ্রতি ডেনমাকের্র আলবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য বেঙ্গল স্টাডি সেন্টার খোলার প্রক্রিয়া চলছে।

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাচর্চার সূচনা করেছিলেন লেখক ও চিন্তাবিদ আবু সয়ীদ আইয়ুব ও শিবনারায়ণ রায়। তাঁদের প্রেরণায় মারিয়েন ম্যাডার্ন বাংলা গবেষণা ও অনুবাদে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ দেশে যেসব এশীয় ভাষা শেখার জন্য গুরুত্ব দিয়েছে, বাংলার অবস্থান তাতে তৃতীয়।

জাপানের এক অধ্যাপক ভারতে গিয়ে হিন্দী শিখেছিলেন । দিল্লীতে পড়াশোনা করার সময় তিনি বাংলার প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়েন । ধীরে ধীরে বাংলা শেখা শেষ করে এখন তিনি টোকিওতে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক। এই যে টান এবং এই দায় এর কারণ আছে । সে কথায় যাবার আগে আমি প্রয়াত: উইলিয়াম রাদিচের কথা বলব। আমাদের ভাগ্য আমরা তাঁকে চোখে দেখেছি। চট্টগ্রামে ফুলকিতে এসেছিলেন রাদিচে। ঘরোয়া আড্ডায় তাঁর কন্ঠ বিশুদ্ধ বাংলায় জীবনানন্দ দাশ শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের । আমার ছেলে অর্ক কে তিনিবাংলায় অটোগ্রাফ ও লিখে দিয়েছিলেন । কে এই রাদিচে? বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচনা অনুবাদের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে বাংলা শিখেছেন। পরে ওই বিভাগেই রাদিচে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরীর অধীনে মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে গবেষণা করেন। বাংলা ভাষা থেকে রাদিচের উল্লেখযোগ্য অনুবাদকর্মের মধ্যে রয়েছে Rabondranath Tagore: Selected Poems, Rabindranath Tagore: Selected Short Stories, Rabindranath Tagore: The Post Office: The Poem of the Killing of Meghnad প্রভৃতি। অনুবাদ করেছেন অন্যান্য ভাষা থেকেও। তাঁর নিজের কবিতা, প্রবন্ধ ও সম্পাদনাকর্মও রয়েছে। তাঁর পিতামহ ও পিতৃব্য ব্রিটিশ ভারতে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।

এবার সাধারণ মানুষদের কথায় আসা যাক। আমি বহুদেশ ভ্রমণ করেছি। ভ্রমণ আমার নেশা। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বাংলা জানেন এমন বলা মানুষের সংখ্যা কম নয়। হাওয়াই ও নমপেন দুটি বহুদূরের দুই শহর। একটি আমেরিকার অঙ্গরাজ্য আরেকটি এশিয়ায় । উভয় দেশে আমি বাংলা জানা আমেরিকান আর কম্বোডিয়ানের দেখা পেয়েছি। মার্ট নামের ষাট বছরের যে মানুষটি তার প্রেমিকাকে নিয়ে হাওয়াই এসেছিলেন তার বাংলা জানার কারণ রবীন্দ্রনাথ। গান শুনতেন কিন্তু ভাষা বুঝতেন না। এভাবেই শুরু। গানের কথা বুঝতে গিয়ে শিখতে শিখতে শান্তি নিকেতন ঘুরে আসা মানুষটি শুদ্ধ বাংলা জানেন। বলতে পারেন । কম্বোডিয়ার ভদ্রলোক বাংলা শিখেছেন ইতিহাস জানতে। যারা খবর রাখেন তাদের অজানা নয় গৃহযুদ্ধ আর সশস্ত্র বিপ্লবের নামে কী পরিমান মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন সে দেশে। আমি যখন সে দেশে যাই তখন ৫০ বছরের ওপরে বয়স এমন জনগোষ্ঠির দেখা মেলাই ছিল ভার। নারীদের দেখা মিললেও পুরুষের দেখা মিলতো না। কারন পলপট এক জেনারেশান কে প্রায় পুরো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল । সে যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী ও আমাদের জান দেয়ার ইতিহাস পড়তে গিয়ে বাংলা শেখা খেন খেমারাকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিল শুধুমাত্র বাংলা প্রেমের কারণে।

আজ আমরা অনেকদূর চলে এসেছি। এক সময়ের অভাব অনটন আর দারিদ্রতার দেশ নামে পরিচিত বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মাতৃভাষা তার মর্যাদা আর ভালোবাসায় অধিষ্ঠিত। কিন্তু ভাষার ওপর অত্যাচার বা তার বিরুদ্ধে থাকা মানুষের আক্রমণ কমে নি। একসময় উর্দু আধিপত্যকে আমরা ভয় পেয়ে আন্দোলন করেছি। আমাদের অগ্রজেরা প্রাণ দিয়েছেন। আজ আগ্রাসনের ধারা ভিন্ন। এখন মাথার ওপর ধর্মীয় ভাষা ঘাড়ের কাছে হিন্দি। মগজে ইংরেজি। কোন ভাষার বিরুদ্ধেই বলার কিছু নাই। বরং আমি আরবি হিন্দি ইংরেজি ভাষা ভালোবাসি। এই সেদিন ও পাকিস্তানি এক মহিলার সাথে উর্দুতে কথা বলে দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। হিন্দি বলতে পারি বলেই ভাঙ্গা উর্দুতে কথা হয়েছিল। ভাষা র কোন দোষ নাই। ভাষা পবিত্র এক মাধ্যম। সমস্যা হলো তাকে আত্মস্থ না করে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা। আমি কোন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র ছিলাম না। কর্পোরেশনের স্কুলে পড়া সাধারণ মানের ছাত্র। ইংরেজী ভাষার এই অষ্ট্রেলিয়া দেশে আমার তো জীবনযাপনে কোন সমস্যা হয় না। এমন হাজার হাজার বাঙালি দুনিয়ার নানা দেশে জীবনযাপন করছেন। ধীরে ধীরে নিজেদের তৈরী করে শান্তিতে আছেন। সমস্যা আগ্রাসনে। সমস্যা চাপিয়ে দেয়া। যদিও বাংলা বাঙালির ভাষা কেড়ে নেয়া যায় না। সম্ভব ও না। ঐ যে মানুষগুলোর কথা লিখলাম তাঁরা এমনি এমনি বাংলা প্রেমে মজেন নি। মজার মতো লালন ফকির হাছন রাজা মাইকেল মধুসূদন বিদ্যাসাগর রামমোহন রায় সুকুমার রায় রবীন্দ্রনাথ নজরুল এস এম সুলতান আছেন বলেই মজেন। মজতে থাকবেন আজীবন। যেমন আবু সায়িদ আইয়ুব । বাংলা না জানা মানুষ বাংলা জেনে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এমন লিখলেন যে এখনো কেউ তা ডিঙ্গাতে পারেন নি। অথচ আইয়ুব তিন পুরুষ ধরে কলকাতায় বসবাস করেও বাংলা জানতেন না। ষোল বছর বয়সে উর্দু পত্রিকায় গীতাঞ্জলি পড়ে মুগ্ধ হন তিনি। অত:পর বাংলা বাঙালির জামাই গৌরী আইয়ুবের বর ও সাহিত্যে এক ইতিহাস।

ফেব্রুবারি এলেই আমাদের বাংলা প্রেম জাগে। বই মেলায় ব ই পুস্তক প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। যদিও ডিজিটাল বাস্তবতা এ বিষয়গুলোকে আঘাত করতে শুরু করেছে। মানুষ বিশেষত নবীন প্রজন্ম এখন মজে আছে মজে থাকে ই রিডার অডিও গল্প ভিডিও কবিতায়। বাংলা গান ছবি সব কিছুতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যাই ঘটুক যে ভাবে ঘটুক কোন ভাবেই যেন আমাদের মাতৃভাষার অপমান না হয় । ধর্ম ব্যবসায়ি হোক আর মজুতদার হোক যেই তার চরিত্র হননের চেষ্টা করবে তাকেই যেন উপযুক্ত জবাব দিতে পারে বাংলা ভাষা। লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধবৈলতলীতে স্বামী নিশ্চলানন্দ অবধূতের তিরোধান দিবস পালিত