দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

মুখ থুবড়ে পড়া বাংলা সিনেমা জগত, উদ্ধার পর্ব
সোহেল রানা নামটি কি বর্তমান প্রজন্মের কাছে পরিচিত? এখন যারা তরুণ তরুণী তারা কি আদৌ চেনে তাঁকে? স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে এসেছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। একদিকে যেমন ওরা এগার জন, বাঘা বাঙালি, রক্তাক্ত বাংলা অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষীর মতো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল আরেকদিকে সুকৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের আবার তোরা মানুষ হ বলে অপপ্রচারও হয়েছিল সিনেমা জগতে। এই সোহেল রানা একজন খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা।এবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর কান্না লুকাতে পারেন নি। আবেগ ও স্মৃতি রোমন্থনে কাতর সোহেল রানার কান্না প্রধানমন্ত্রীকেও আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনিও তাঁর আবেগ সংবরণ করেছেন কষ্ট করে। বিশেষত সোহেল রানা যখন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ও অতীতে তাঁর আদেশে সিনেমায় অভিনয় করার কথা বলেন তখন সবাই নির্বাক হয়ে তা শুনছিলেন। কিন্তু এটাও জানা দরকার মাসুদ পারভেজ যার ছায়াছবিতে নাম সোহেল রানা রাজনীতি করবেন বলে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ৯ বছর আগে ২০১২ সালের মার্চ মাসের এক রোববারে তিনি ফুলের ডালা সাজিয়ে সোনার গাঁ হোটেলে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জাতীয় পার্টি প্রধান হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে তুলে দেন। তাঁর সাথে কিছু সংস্কৃতিকর্মী নামে পরিচিত মানুষজনও যোগ দিয়েছিলেন সে দিন। তখন কিন্তু সোহেল রানার মনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন কি না জানা যায় নি। যতোটা জানি এরশাদের আদর্শ আর দলকে ভালোবেসে যাওয়া সোহেল রানা তখন বঙ্গবন্ধুকে ভুলে গেছিলেন। এখন তাঁর কান্না শেখ হাসিনাকে স্পর্শ করলেও এই ঘটনা মিথ্যা হয়ে যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোটামুটি সব বিষয়ে খবর রাখেন। আশা করি এই ঘটনাও তাঁর মনে আছে। রাজনৈতিক ঝামেলায় সরকার প্রধানকে চেনা অচেনা মনে হলেও সংস্কৃতির কথা আসলেই আমরা পাই দরদী বাঙালি এক নারী শেখ হাসিনাকে। যিনি শুধু বড়দের জন্য না ছোটদের জন্য সিনেমা বানানোর কথাও মনে করিয়ে দেন। সেই কবে এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী নামে একখানা ছবি হয়েছিল তারপর কি আসলে আদৌ কেউ ছোটদের জন্য ছবি বানানোর কথা ভেবেছেন? মাঝে মধ্যে একাত্তরের যীশু বা এমন দু একখানা সিনেমা পাওয়া গেছে বটে বিনোদন আর মনোজাগতিক আনন্দে ছোটদের জায়গা নাই বললেই চলে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলতে ভুলেন নি।
শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “এর মধ্যে দিয়ে কিন্তু একটা শিশু তার জীবনটাকে দেখতে পারবে, জীবনটাকে তৈরি করতে পারবে, বড় হতে পারবে।“সেদিকে লক্ষ্য রেখেই শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, তার মধ্যে দিয়ে তাদের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো প্রতিফলিত করা, এটাও কিন্তু আমাদের করতে হবে।”চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই সামাজিক দায়িত্বটুকু পালন করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সিনেমাগুলো সেইভাবেই তৈরি করতে হবে, যেন পরিবার পরিজন নিয়ে দেখতে পারে।” শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প নষ্ট হয়ে যাক- সেটা সরকার কখনো চায় না। এক সময় টেলিভিশন যুগের আবির্ভাবে সিনেমা শিল্প থমকে গেলেও এখন আবার সিনেমার যুগ ফিরে এসেছে।“শুধু বাংলাদেশেই না, এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষ সিনেমা দেখছে। হয়ত হলে যায় না, ঘরে বসে দেখে। কিন্তু হলেও আমাদের মানুষ টানতে হবে। আর মানুষ যাতে আসে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? আজকাল দুনিয়ার কোন দেশেই মানুষ আগের মতো হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন না। কিন্তু এটাও ঠিক আমাদের দেশের মতো অতোটা খারাপ না অবস্থা। আমার একমাত্র সন্তান তার ক্যারিয়ার হিসেবে অভিনয় নির্দেশনা চিত্রনাট্য রচনা বেছে নেয়ার পর থেকে আমি খুব কাছ থেকে অষ্ট্রেলিয়া ও বলিউডের সিনে জগত দেখছি। ভাটির মুখেও সমুজ্জ্বল । প্রতিনিয়ত তৈরী হচ্ছে সিনেমা। সব এখন হলে গিয়ে দেখতে হয় এমনও না। বিলিয়ন ডলার বাজেটের মুভি বিশ্বনন্দিত সিরিজ মূলান। ডিজনি ওয়ার্ল্ডের এই ছবিতে খুব ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে অর্ক। এটি অষ্ট্রেলিয়া তথা এশিয়ার কোন যুবকের ডিজনি মুভিতে প্রথম অভিনয়। সেই বিগ বাজেটের ছবিটি করোনা কারণে হলে মুক্তি না পেলেও জমিয়ে ব্যবসা করেছে ডিজনি চ্যানেলে। আজকাল ঘরে বসেও মানুষ সিনেমা দেখা রপ্ত করে নিয়েছে। তাই একথা বলা যাবে না সিনেমা শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে মূলত বিপাকে পড়েছে সিনেমা হল কেন্দ্রিক ব্যবসা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন মানুষকে সিনেমা হল মুখি করে তুলতে। ভালো কথা। কিন্তু বিনয়ের সাথেই বলি পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা কি তা সমর্থন করে না, করছে? একদিকে ওয়াজ ধর্মীয় মাহফিল আর ইন্টারনেটে চলছে বিনোদন বিরোধী অপপ্রচার। সেগুলো এতো জঘন্য আর এতো বিদ্বেষপ্রসূত যে ভাবা যায় না। যেহেতু এগুলোর সাথে ধর্মকে ট্যাগ করে দেয়া হয়েছে সাধারণ বা আমজনতা নামের মানুষ তা বিশ্বাস করছে এবং গিলছে। এর সাথে সিনেমার সম্পর্ক সাপে নেউলে। সে সমাজে মানুষ কে কিভাবে সিনেমা হল মুখি করা সম্ভব?
সিনেমার বৈরী হয়ে ওঠা সমাজকে গাইড করছে যেসব মৌলবাদীরা তারাও কিন্তু ইলেকট্রনিক বাহনের মাধ্যমেই তা করছে। অন্যদিকে ভালো মাঝারি মান আর সাধারণ মানুষের সিনেমাগুলো বন্ধ করার পাঁয়তারা চললেও অশ্লীল নামের কোন কিছুই বন্ধ হয় নি। কাট পিসের জগত এড়িয়ে এখন সরাসরি অশ্লীল ছবি জুড়ে দেয়ার পাশাপাশি উদোম নগ্ন নায়িকারাও পিছিয়ে নাই। এসবের ব্যাপারে সমাজের অন্ধত্ব চোখে পড়ার মতো। মোবাইলে কম্পিউটারে নানাভাবে দৃশ্যমান লাল নীল কোন ছবির জগত এখনো বন্ধ করা যায় না। তাই উপায় আসলে একটাই। সুস্থ স্বাভাবিক ও মূলধারার ছায়াছবি নির্মাণে উৎসাহ যোগানো। সে সব মূলধারার ছবিগুলোই পারে শিল্প রুচি ও জীবনবোধের চাহিদা মেটাতে। যেটুকু শৈল্পিক যৌনতা তাও আসতে পারে সে সব চলচ্চিত্রে। পাশের দেশে কলকাতায় ও তার চর্চা হচ্ছে হচ্ছে বলেই আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে তাদের সিনেমা জগত। এর কোনটাই আমরা মানি না। নাই কোন পরিবেশও। ঠাট্টা করে বলা হলেও এটাই সত্য দেশের রাজনীতি যখন থেকে মৃত এবং রাজনৈতিক নেতারা যখন থেকে অভিনেতা হয়েছেন তখন থেকে মানুয নাটক সিনেমা দেখা বন্ধ করে টিভি পর্দায় এদের দেখেই ব্যাপক বিনোদন নিতে শুরু করেছে। সে ধারা এখন বলতে গেলে নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। সবাই জানেন কার পর কে আসবেন মিনি পর্দায় কি ধরনের উত্তেজনা আর তর্ক বিতর্ক চলবে। এসব দেখতে অভ্যস্ত মানুষের জীবনে সিনেমা হলের আর কোন জায়গা নাই।
তবু সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। চলচ্চিত্র জগতে নবীন প্রবীণ মানুষেরা কাজ করছেন। প্রতিবছর নতুন আশায় নতুন ছবি সামনে এসে দাাঁড়য়। কারো অভিনয় প্রতিভা কারো নির্দেশনা কারো সুর কারো ছবির ক্যামেরা আমাদের মুগ্ধ করে। তাঁরা পুরস্কার জিতে নেয়। জাগিয়ে যায় আশা। সিনেমা বা অভিনয় শিল্প মৌলিক। তার বিনাশ নাই। শুধু দরকার সরকারি আনুকূল্য আর মানুষকে সিনেমামুখী করা। সে কাজটা সমাজের আরো অনেক কিছুর সাথে থমকে আছে। কবে কিভাবে উদ্ধার হবে বা ঘুরে দাঁড়াতে শিখবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধঅপেক্ষা