দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৬ নভেম্বর, ২০২০ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

আমাদের আদর্শ ও সহনশীল দেশ
হঠাৎ অনুভূতির নামে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে সমাজ। নানা কারণে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার পুরনো চক্র ফের মাঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বললেন সে কথা। কথা হচ্ছে বারবার তারা কেন এমন করতে পারে? এর কারণ কি রাজনৈতিক নেতৃত্বহীনতা না নো রাজনীতি?
কি এক কঠিন বাস্তবতা? কেন জানি কোন কিছু ধরে রাখতে পারি না। যে কোন অর্জন হারিয়ে ফেলাই আমাদের স্বভাব। এভাবে একটি জাতি এগুতে পারে না।
অথচ এই সে দিন সর্বজনীন শারদীয় উৎসব নামে পরিচিত দুর্গাপূজা শেষ হয়েছে। এবার কঠিন করোনা কালে সবাই যখন ভাবছিলেন পূজা হবে কি হবে না তখন চমৎকারভাবে এই পূজা হয়েছে বাংলাদেশে। আমাদের একটা স্বভাব সব বিষয়ে নেগেটিভ ভাবনা বড় করে তোলা। এর জন্য সমাজ মিডিয়াসহ বহু বিষয় দায়ী। কিন্তু এর সাথেই থাকে সদার্থক বাংলাদেশ। যে দেশটি আমাদের আরাধ্য। আমরা একবারও ভাবি না বহুধা বিভক্ত এই সমাজ আর রাজনীতির দেশটিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিভাবে একা ধরে আছেন?
গোড়াতেই বলি কোন দেশের ভার একক কারো ওপর ন্যস্ত করা যেমন ঠিক না তেমনি একক নেতৃত্ব সবসময় ভালো ফল বয়ে আনে না। বরং এতে নানাবিধ সমস্যার জন্ম হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত চমৎকারভাবে সামাল দেয়ার পাশাপাশি হয়ে উঠেছেন দেশের ঐক্যের প্রতীক। সমস্যা আর আতংক নিয়ে দুনিয়া যখন করোনা কাল মোকাবেলায় ব্যস্ত তখন বহুদেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। সচ্ছল আগুয়ান আর উন্নত নামে পরিচিত দেশগুলোর অর্থনীতিও পড়েছে তোপের মুখে। পাশের দেশ বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের অবস্থাও ভালো না। তাদের জিডিপির হার কে ছাড়িয়ে বাংলাদেশের জিডিপি নতুন মাত্রায় পৌঁছুতে চলেছে। এই আগামবাণী আমাদের দেশ আমাদের সবার জন্য এক দারুণ সংবাদ এবং এটি কোন দেশীয় প্রচার না। এই আগাম ভবিষদ্বাণী করেছে বিশ্ব নিয়ন্ত্রকেরা। অথচ আমাদের এ নিয়ে কোন জাতীয় গর্ববোধ নাই। নাই আত্মতুষ্টি।
বরং স্বভাবসুলভ বিরোধিতায় রাজনৈতিক দলগুলো এটাকে বানিয়ে বলা ভাবছে। এই যে নেগেটিভিটি এর জন্ম আমাদের সমাজগর্ভে। আজ সমাজ এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে যেখানে যে কোন দুসংবাদই একেকটা বিশাল খবর। মুহূর্তে সেগুলো সামাজিক মিডিয়া হয়ে পৌঁছে যায় ঘরে ঘরে। এর ভালো দিক হলো মানুষ সচেতন হতে পারে। রাস্তায় এসে দাঁড়ায় বা প্রতিবাদ করে। কিন্তু এইসব মানববন্ধনে বা প্রতিবাদে কি কোন ঘটনার সুরাহা হয়? না হয়েছে? সমাজে ধর্ষণ হত্যা নির্যাতন বাড়ছে তো বাড়ছেই। করোনার জন্য ঈদ হয়েছে নিয়ম মেনে। অপার আনন্দ উৎসব হতে পারে নি। পূজা হয়েছে সাবধানতার সাথে। মানুষ যেতে পারে নি। অথচ সামাজিক অন্যায় বা নির্যাতন ধর্ষণ হচ্ছে আগের চাইতে বেশী। এর কারণ কি খুঁজে দেখেছি আমরা?
কতোদিন হয় ,আমাদের সমাজে একটি চমৎকার শিশু সংগঠন বা শিশু কিশোর সংগঠন ফোকাস পায় নি? ফোকাস বলতে আমি বোঝাতে চাই যথাযোগ্য মর্যাদা আর তার যোগ্য প্রচার। আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম তখনো দেশে অপরাধ ছিলো। অপরাধ প্রবণতা ছিলো। সে সময় ্‌ এই সংগঠনগুলো ছিলো প্রাচীরের মতো। তার শক্ত মজবুত দেয়ালে আঘাত করে ফিরে যেতো যাবতীয় অপরাধ। আর তার আড়ালে নিরাপদে বড় হয়ে উঠতো আমাদের শৈশব কৈশোর বা যৌবন। যা আমাদের শিখিয়েছিল কিভাবে মেয়েদের বন্ধু মনে করতে হয়, কিভাবে তাদের সম্মান করতে হয় বা মেলামেশা করতে হয়। কিন্তু এখন আর এগুলো নাই। এখন বায়বীয় যুগ। এই যুগে একদিকে যেমন দুনিয়া খুলে গেছে তেমন ই তার সাথে ঢুকে গেছে নানা নোংরামি। অপরাধ প্রবণতা।
এটাই মূলত নেগেটিভ বাংলাদেশের প্রথমপাঠ। এখান থেকেই শুরু সবকিছুর। এর সাথে যোগ হয়েছে অপরাজনীতি। আসলে রাজনীতি গোটা দুনিয়াতেই পরিবর্তিত হয়ে বলতে গেলে নাই হয়ে গেছে। উন্নত দেশগুলোতে রাজনীতি মানে পলিসি নির্ধারণ আর সরকার ও বিরোধী দলের ছায়া সরকারের লড়াই। এগুলো আমাদের দেশে অসম্ভব। সে বাস্তবতায় পৌঁছুতে আরো শতবর্ষ পাড়ি দিতে হলেও অবাক হবো না। পাশের দেশ ভারতে যে রাজনীতি এখনো প্রবহমান তার কারণ তাদের অতীত। একসাথে স্বাধীন হলেও পাকিস্তানে কিন্তু সে রাজনীতি নাই। সমপ্রতি ইমরান খানের বিরুদ্ধে সেখানে বিরোধীরা হৈ চৈ করলেও রাজনীতিহীনতার কারণে কিছুই করতে পারে নি। পারতে হলে সামরিক বাহিনীর বিকল্প নাই। তাদের সহায়তা সাহায্য ছাড়া সেখানে পাতাও পড়ে না। এইসব বাস্তবতা থেকে আমরা অনায়াসে বুঝে নিতে পারি বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে বা কি তার ভবিতব্য?
সে কারণে বিরোধী দলকে চাঙ্গা করার নামে বাক্য ব্যয় না করে পজিটিভ বাংলাদেশের দিকে নজর দেয়াই হবে কাজের কাজ। সমাজ কোন পজিটিভ অবস্থানে নাই। বহু সামাজিক ব্যাধির আরেক বড় কারণ শিক্ষা। এতোবছর পরও এই খাতে কোন অভিনব অর্জন নাই। এখন করোনার কারণে কোন রকমে বা কোন ভাবে ছাত্র ছাত্রীদের পাস করিয়ে দেয়া আরো সমস্যার জন্ম দেবে। তা ছাড়া আধুনিকায়নের সংজ্ঞা মানে অন লাইন বা প্রযুক্তির ব্যবহার, এটা ভ্রান্ত ধারণা। ধর্মীয় শিক্ষার নামে যে সব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম যৌনতা আর নানা ধরনের অপকর্ম সমাজকে বারে বারে বিপদে ফেলছে তাদের বিরুদ্ধে জনগণ তো দূরে থাক সরকার ও কিছু বলতে ভয় পায়। এই বাস্তবতার ভেতরে থেকে কিভাবে অপরাধ দমন করা সম্ভব?
সবমিলিয়ে আপনি যদি বাস্তব ছবিগুলোর একটা কোলাজ করেন বুঝতে পারবেন সমস্যা আমাদের মগজে। সমস্যা আমাদের সমাজের কোষে কোষে। আন্তর্জাতিক জঞ্জাল আর দেশী অপজঞ্জাল মিলে আচরণের কালসাপ পেঁচিয়ে রেখেছে আমাদের। কোনটা যে সত্য আর কোনটা মিথ্যা তাও বুঝি না আর। মানুষ জানে না কোনটি আসলে ধর্ম আর কোনটা আচার? সে কারণে কখনো সামপ্রদায়িকতা কখনো ধর্ষণ কখনো বা লুটপাট মিলেমিশে তছনছ করে দিচ্ছে ভবিষ্যৎ। বলছিলাম পজিটিভের কথা। ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি করোনাকালে আগে বাড়লেই কি বলা যাবে আমরা উন্নত দেশ? উড়ালপুল বড় বড় রাস্তা ঘাট ভবন যতো উঁচুতে উঠছে ততোটা নীচে নেমে গেছে মানুষের শুভবোধ। দয়া মায়া আন্তরিকতা ভালোবাসা আর সহমর্মিতাহীন একটি দেশ কি আর্থিকভাবে উন্নত হলেই উন্নত বা সমৃদ্ধ হয়ে যায়?
আমাদের সামনে যে পজিটিভ বাংলাদেশের হাতছানি তার সাথে অর্থনীতির যতোটা নিবিড় যোগ ততোটা নাই সমাজ বা আদর্শের সাথে কোন যোগ। এ দুটি না হলে উন্নয়ন ঝুলে থাকবে সুতোর ওপর। তাকে আর যাই বলি না কেন আধুনিক বলা যাবে না। সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি সমাজ আর ধর্মের মতো বিষয়গুলো যদি সবার গ্রহণযোগ্য হয় আর শান্তিপূর্ণ হয় তবেই আমরা বলবো আদর্শ দেশ। সেটুকু না হলেও সংযত সহিষ্ণু আর সহনশীলতার বাংলাদেশ ই হোক আমাদের আপাত স্বপ্নের দেশ। আমরা কি এটুকু আশা করতে পারি না?
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধখিচুড়ি