দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ১ জুলাই, ২০২২ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

অর্জন বনাম বিকৃতি : সমাজের যাত্রা কোথায়?

একজন আত্মপ্রত্যয়ী নেতার দরকার ছিল আমাদের। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন সব মানুষের জয়জয়কার যারা নেগেটিভ। এরা কোন কিছু ই সহজ ভাবে নিতে পারে না। এমন কি দেশের সুনাম নিয়ে ও এরা ভাবে না। দুনিয়ার কোন দেশে এমনটা দেখবেন না। এই যে ভারত পাকিস্তান এই দুই দেশ নিয়ে বাদ বিসংবাদ আলাপ আলোচনা , তাদের দেশের মানুষেরা কিন্তু নিজেদের মান সম্মান নষ্ট হোক এমন কোন কাজ করে না। স্বাধীনতার পর থেকে এক শ্রেণির বাঙালির বিকৃত মানসিকতা দিন দিন বেড়েছে বৈ কমে নি। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে আমি নবম দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। সবকিছু মনে আছে আমার। চারদিকে হঠাৎ এমন সব আগাছা আর ডালপালা গঝিয়ে গেল যেন দেশ স্বাধীন করাটাই ছিল অপরাধ। ৭৫ আর অগাস্ট দেখেছি আমি। সাধারণ মানুষের মনে যাই থাকুক সে দিন আওয়ামী লীগ ছিল অসহায়। নেতাদের বেশীর ভাগ ই হয়ে গেছিল মোশতাকের হাতের পুতুল। সে আমলটায় নেতৃত্ব ধ্বংস করার জন্য মরিয়া দালাল শ্রেণি আজও দমে নি। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যার মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তানের ছায়া রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা সার্থক হয় নি। এরা ভাবতেও পারে নি আওয়ামী লীগ ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়াতে পারে। এরা ভাবেনি বঙ্গবন্ধু কন্যা এই দেশ শাসন করে বাংলাদেশকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবেন যা অভূতপূর্ব। আজকের বাংলাদেশ শেখ হাসিনার পরিশ্রম আর একক নেতৃত্বের ফসল। যা অনেক অর্জনে সমৃদ্ধ ।

এতো অর্জন আর সাফল্যের পরও আমাদের সমাজে শান্তি নাই। আজকাল সবকিছু কেমন জানি পাগল বা বিকৃতদের দখলে। সামাজিক মিডিয়া উন্মুক্ত হবার পর থেকে এই পাগলামি বা ক্রেজ রোগে পরিণত হয়ে গেছে । আমি আমরা কেউই এর বাইরে না। যে যা পারছে যার যা আছে তা নিয়ে বিখ্যাত হবার নেশায় মত্ত । এই মত্ততার নিদারুণ নির্লজ্জ উদাহরণ পদ্মাসেতুর নাটবল্টু খুলে নেয়া। কতোটা পাগল আর মস্তিষ্ক বিকৃত হলে এটা করা সম্ভব ? কিন্তু করেছে । শুধু করেই চুপ থাকে নি। লাইক লাভ বা ভাইরাল হবার আশায় তা প্রচারের জন্য ভিডিও করা হয়েছে। খবরে দেখলাম তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধের সাজা না জানলে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। যাবজ্জীবন এমন কি চাইলে আরো ক্যাপিটাল কোন পানিশমেন্ট দিতে পারে আইন। বিচারে কি হবে জানি না তবে এই লোক যে মানসিক বিকারগ্রস্ত উম্মাদ সমাজের এক নিকৃষ্ট উদাহরণ সেটা বলে বোঝানোর দরকার দেখি না। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই আজকাল এমন কাজ করার হিড়িক পড়ে গেছে। আরেক উন্মাদ নবনির্মিত সেতুতে প্রকৃতির ডাক সামালতে সাড়া দিয়ে ছবি তুলেছে। এই বিকৃতি আসলে কিসের ঈঙ্গিত?

এসব ঘটনার আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে আরো কিছু ঘটনা। যা আরেক ধরনের বিকৃতি। ধর্ম ছিল আছে এবং থাকবে। আমাদের দেশ ও সমাজের মানুষ চিরকাল ই ধর্মভীরু। কিন্তু এমন ধর্মান্ধতা আর ভাইরাল হবার নামে অপপ্রচারের মাধ্যমে সহিংসতা আগে দেখা যায় নি। নড়াইলের প্রধান শিক্ষক স্বপন সরকারের গলায় জুতার মালা দিয়ে রাস্তায় ঘোরানোর ছবি আমরা বিদেশে থেকেও দেখেছি। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এসব ছবি দেশ ও সমাজের ভাবমূর্তি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কেন এই আক্রোশ? এটা কি স্বপন কুমার হিন্দু বা সংখ্যালঘু বলে? এই প্রশ্নটা করতে হচ্ছে কারণ আজকাল সংখ্যালঘু নামে পরিচিতদের ওপর বেশি বেশী আক্রমণ আর নির্যাতন দেখতে পাচ্ছি। এই ঘটনা যখন ঘটে তখন সেখানে নড়াইলের ডিসি পুলিশ সুপার সবাই ছিলেন সেখানে। এতগুলো বড় বড় মানুষের সামনে কর্তাদের সামনে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটলো অথচ কারো মনে প্রশ্ন জাগলো না পরিণাম কি হতে পারে? এ জায়গাটা ভয়ের। কারণ এরা সবাই বুঝে গেছেন নীরিহ টিচার বা সংখ্যালঘু সহ সাধারণ মুসলমানের ওপর অত্যাচার অনাচার হলে কিছু হয় না। বরং এদের সাথে থাকলে বা এদের হয়ে দাঁড়ালেই বিপদ। যে কারণে নড়াইলের কোন মাননীয় এখনো মুখ খোলেন নি। এমন কি সাংসদ ক্রিকেটার আমাদের সবার প্রিয় অধিনায়ক মাশরাফিও কিছু বলেছেন এমনটা শুনি নি। আপনি যদি তালিকাটা দেখেন বুঝবেন এটা পরিকল্পিত যা এখন ক্রমেই অভ্যাসে পরিণত হতে চলেছে। শ্যামল কান্তির কান ধরা লতা সম্‌দ্দারের টিপ পরা হৃদয় মন্ডলের কারাবাস সব মিলে মিশে চূড়ান্ত পরিণতি উৎপল সরকারের জান খোয়ানো। আপনি বুকে হাত দিয়ে বলেন তো কোনটার সুষ্ঠু ও ন্যায্য বিচার হয়েছে? যদি না হয়ে পার পায় তাহলে এমন ঘটনা বারবার কেন ঘটবে না?

সেটাই যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়াতে চাইছে। বলা বাহুল্য পাঠক্রম আর শিক্ষক এর একটাও আর আগের জায়গায় নাই। মূল সমস্যা সেখানেও আছে। ভালো ভাবে পাঠ দান আর পাঠক্রম সেকুল্যার না হলে সমাজ সেকুল্যার হবে কি ভাবে ? সমাজ বা জাতিকে মানুষ করে তোলে শিক্ষা। সে শিক্ষা এখন বাণিজ্য। কোচিং আর প্রাইভেট টিউশানের নামে এই বানিজ্য বহু আগেই পথ হারিয়েছে। আমার কেন জানি মনে হয় যারা অপমানিত আর নির্যাতিত হচ্ছেন বা হবেন তাদের বড় দোষ হবেতো তারা এই বাণিজ্য প্রক্রিয়ার বাইরে। যার মানে সৎ আদর্শবান আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু এরাই এখন টার্গেট। এটা সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের এক সুগভীর চক্রান্ত। অথচ সরকারের লোকজন ব্যস্ত তাদের নিজেদের বাহবা আর স্তুতি নিয়ে। কে না জানে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে এগিয়ে চলেছে। তার গায়ে লেগেছে উন্নয়নের হাওয়া।

কিন্তু পুল উড়াল পুল রাস্তা বা সেতুই শেষ কথা না। শেষ কথা মানুষ। ভালো মানুষ। জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রসর মানুষ। এঁদের তৈরী করে শিক্ষক। সে প্রক্রিয়া যদি ধ্বংস করা যায় তাহলে যাদের লাভ তারাই আজ মাঠে। কে বুঝছে কে বুঝছে না জানি না তবে যারা সামাল দিতে পারে তারা গা করছে না।

কথায় বলে অন্যায় অপমান বা খারাপ কিছু সংক্রামক। সেটা এখন দেখতে পাচ্ছি সবাই। মানুষ বলাবলি করছেন লিখছেন এর চাইতে পাকিস্তান আমল খারাপ কি ছিলো? বরং তখন এমন কিছু হতো না। কেন হতো না? কারণ তখন সরকার আর রাষ্ট্র সামপ্রদায়িক বা সংঘাতমুখি হলে ও মানুষ ছিলো বাঙালি। এখন সরকার বা রাষ্ট্র যতোই সেক্যুলার দেখাক না কেন তলে তলে বিদ্বেষ বাড়ছে। বাড়ছে নাশকতা আর বিকৃতি। সব মিলিয়ে এমন বিকৃত ঊলঙ্গ সমাজ আমাদের দেশ বা জাতির জন্য অহিতকর। কেউ বুঝুক বা না বুঝুক বাংলাদেশ তা জানে আর রাতের অন্ধকারে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কি করার আছে তার?

লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু