(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সন্ধ্যা হতে খুব বেশি দেরি নেই। সূর্য বেশ দ্রুতই নিচের দিকে নামছে। শুধু আকাশ জুড়ে সূর্যের বিদায়ের প্রস্তুতি, প্রকৃতিতেও কেমন যেন তাড়াহুড়ো। শুধু হযরত সেলিম চিশতি (রঃ) মাজারের সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর যেন কোন তাড়া নেই। তারা নিজেদের মতো করে কাউয়ালি গান করছেন, কেউবা জিকির করছেন। কেউ কেউ ধ্যানমগ্ন হয়ে কি যেন ভাবছেন, কেউবা বুঝি স্রষ্টার কাছে আকুতি জানাচ্ছেন। চারদিকে এক পুত পবিত্র আবহ। আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। কিন্তু আর দেরি করার উপায় ছিল না। আমাদের দিল্লী ফিরতে হবে। গাইডও তাড়া দিলেন। তিনি আমাকে আগ্রায় থেকে যাবো কিনা সেটিও জানতে চাইলেন। বললেন, হোটেল তিনি ঠিক করে দিতে পারবেন। আমি থাকবো না বলায় তিনি আরো যেন কিছুটা বাড়তি তাড়া দিলেন। বললেন, তাহলে আর দেরি করবেন না। সাথে মহিলা আছে। আপনার এখনি ফিরতি গাড়ি ধরা দরকার। হযরত সেলিম চিশতির অনন্য সুন্দর মাজারের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। গাইড আমাদের পার্কিং এরিয়া পর্যন্ত আসলেন। সেখানে আমাদের গাড়িটি পার্কিং করে রাখা আছে। ড্রাইভারকে ফোন করলে তিনি জানালেন যে, পার্কিং এর চায়ের দোকানের সামনেই আছেন তিনি। গাইড বললেন, আপনাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তবুও যদি স্যুভেনির শপগুলো দেখে না যান তাহলে মিস করে ফেলবেন। আমার মনে হয় আপনাদের এক পলকের জন্য হলেও স্যুভেনির শপগুলো ঘুরে দেখা দরকার। তিনি আমাদেরকে আরো নানাভাবে প্রলুব্ধ করছিলেন। প্রশংসা করছিলেন স্থানীয় মহিলাদের হাতের কাজের। গাইড বেচারার সম্মান রাখতে আমরা স্যুভেনির শপে ঢু’ মারলাম। সত্যিই বিস্ময়কর। দারুণ সব জিনিসে ঠাসা প্রতিটি দোকান। হাতের নানা কারুকাজ। নানা ধরনের স্যুভেনির। বিভিন্ন ধরনের পণ্য। ফতেহপুর সিক্রির রেপ্লিকা থেকে শুরু করে আগ্রা ফোর্ট, তাজমহল সবই রয়েছে। রয়েছে হাত পাখা থেকে শুরু করে আরো নানা কিছু। কিন্তু তেমন ক্রেতা নেই দোকানগুলোতে। আমরা যে দোকানেই ঢুকছিলাম সেখানেই সর্বোচ্চ মনোযোগ পাচ্ছিলাম। গাইড চাচ্ছিলেন আমরা কিছু কেনাকাটা করি। কিন্তু আমাদের তেমন কোন কেনাকাটার আগ্রহ ছিল না। কোন কিছুর প্রয়োজনও ছিল না। তবুও আমার স্ত্রী টুকটাক কিছু স্যুভেনির কিনলো।
পার্কিং এর ঠিক মাঝখানে একটি দোকান। মসলা চা বিক্রি করছিলেন। ড্রাইভার চায়ের সুনাম করলেন। গাইডও। আমি সবাইকে নিয়ে চা খেলাম। সত্যি এত ঠুনকো একটি দোকানে এমন শানদার চা! বিস্ময়কর। সম্রাট আকবর কি এই চায়ের স্বাদ কোনদিন পেয়েছিলেন! আচ্ছা তখনো কি চা আবিষ্কৃত হয়েছিল! আমরা দিল্লীর পথ ধরলাম। ফতেহপুর সিক্রি থেকে আগ্রা হয়ে ফিরবো আমরা। গাইড অনুরোধ করলেন তাকে যেন আগ্রার মোড়ে নামিয়ে দিই। আমরা দুজন মাত্র মানুষ। বিশাল একটি গাড়ি। সুতরাং গাইডকে সামনের আসনে বসিয়ে মাইল কয়েক পথ পাড়ি দেয়ায় আমাদের কোন সমস্যা ছিল না। গাইড সামনের আসনে বসলেন। আমরা পেছনে। যাত্রা করলাম আমরা। লালসে পাহাড়ি পথে ধুলোর আস্তর। চারদিকে মরুর আবহ। সন্ধ্যা জমে বসতে শুরু করেছে। আকাশজুড়ে সন্ধ্যার আনাগোনা। কিন্তু ফতেহপুর সিক্রির প্রকৃতি ঠিক আমাদের মতো মনে হলো না। কেমন যেন উদাসীনতা। পাখিদের ঘরে ফেরার কোন তাড়া দেখা গেল না। কোথাও কোন পাখিও দেখলাম না। আহা, কী এক বিরহ!!
আমরা আগ্রা মোড়ে এসে গাইডকে নামিয়ে দিলাম। বেশ খুশী হলেন তিনি। আমাদের আবারো আগ্রা আসার দাওয়াত দিলেন। নিজের ফোন নম্বর দিলেন। আগ্রায় যে কোন প্রয়োজনে তাকে স্মরণ করলে হবে বলেও উল্লেখ করলেন তিনি। আমি মাথা নাড়লাম। কবে যে আর আগ্রায় আসবো! সত্যি কি আর কোনদিন আসবো!! শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছিল। সারাদিনের টানা ঘোরাঘুরিতে বেশ পরিশ্রম হয়েছে। এখন শরীর মন সবই শুধু আয়েশ খুঁজছিল। প্রিয়তমা স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ফিরছি। দিল্লীর পথে ছুটছে আমাদের গাড়ি। দিল্লী-আগ্রা মহাসড়কে আমাদের ড্রাইভার কেবলই যেন গতি বাড়াচ্ছিলেন। আমি কিছু বললাম না, বাধাও দিলাম না। সারাদিন অলস বসে থাকা ড্রাইভার কী বিরক্ত হয়েছেন! কিন্তু দরোজা খুলে দেয়া থেকে শুরু করে গাড়িতে উঠার আগ দিয়ে সালাম দেয়া পর্যন্ত সবকিছু এত সাবলীল ছিল যে, ড্রাইভার রেগে আছে ভাবার কোন কারণ নেই। তিনি লো ভলিউমে কি যেন একটি গান শুনছিলেন। আমাদের অবশ্য গান শোনার কোন আগ্রহ ছিল না। আমি স্ত্রীর হাতটি হাতে নিয়ে গাড়ির সিটে হেলান দিলাম। আমার খুব ঘুম পাচ্ছিলো।
তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট এবং ফতেহপুর সিক্রিতে পুরোদিন কাটিয়ে নিজেকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল। আহা, কত জৌলুশ! কত ভোগ বিলাস!! সবই যেন মাটিতে মিশে আছে। একদিন যে সম্রাটের হুকুমে শুধু ভারত উপমহাদেশই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার একটি বিস্তৃত অঞ্চলে বাঘ-মহিষ একসাথে পানি খেতো সেই সম্রাট কত অনাদরে পড়ে আছেন! সম্রাট কিংবা সম্রাজ্ঞীর অতি প্রিয় প্রাসাদে কী অবলীলায় চলছে সর্বসাধারণের আনাগোনা! যেসব স্থানে দূর থেকে চোখ দিতেও সাধারণ মানুষের বুক কাঁপতো আজ কত অনায়াসে সেখানে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি আমরা! সময় কত দ্রুত পাল্টে যায়, সবকিছু পাল্টে দেয়!
ছুটছিল আমাদের গাড়ি, দারুণ গতিতে। মহাসড়ক জুড়ে হাজার হাজার গাড়ি, সবগুলো ছুটছে। চালক বেশ খোশমেজাজে আছেন মনে হলো। তিনি গান শুনছিলেন। আমাদের দিন কেমন কেটেছে জানতে চাইলেন তিনি। বেজায় ভালো লাগার কথা জানাতে তিনি নিজেও যেন কিছুটা বাড়তি খুশী হলেন। হিন্দি ইংরেজী মিলিয়ে তিনি যা বললেন, তার সবকিছু আমি বুঝতে পারছিলাম না। স্ত্রীর সহায়তায় যতটুকু বুঝতে পারলাম, তাতে মনে হলো তিনি আমাদেরকে আরো সময় নিয়ে আসা দরকার ছিল বলে পরামর্শ দিলেন। আগ্রায় এক রাত থেকে অন্তত দুইদিন যদি ঘুরতেন তাহলে মন ভরে দেখতে পারতেন বলেও তিনি মন্তব্য করলেন। আমার মনের কথাটিই যেন তিনি বললেন। ভবিষ্যতে যদি কখনো আবার আসার সুযোগ হয় তাহলে অবশ্যই আগ্রাতে রাত থাকবো আমি। আগ্রার ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সম্রাট সম্রাজ্ঞীদের সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে দুইদিন ব্যয় করবো।
দিল্লী-আগ্রা মহাসড়কের দুপাশে বহু ঘরবাড়ি, দোকান পাট, শপিং মল। আলোকোজ্জ্বল নানা স্থাপনা। বহুতল নানা ভবন। আবার কোথাও কোথাও শুধু মাঠ। দুইপাশে শুধু স্ট্রিট লাইট ছাড়া কোথাও যেন আর কিছু নেই। ট্যুর অপারেটর থেকে নেয়া গাড়ি না হলে এমন অচিনপুরী অচিন চালক নিয়ে এই পথ পাড়ি দিতে যথেষ্ট ভয় পেতাম। এখন কোন ভয় পাচ্ছিলাম না। গাড়ি ছুটছিল, দারুণ গতিতে।
আর কতক্ষণ লাগবে জানতে চাইলাম। ড্রাইভার বললেন, আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে হোটেলে পৌঁছতে পারবো। তবে ট্রাফিক জ্যাম বেশি হলে একটু বাড়তি সময় লাগবে। দিল্লীতে ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম লেগে থাকে বলেও বললেন তিনি। আমি অবশ্যই গত দুয়েকদিনে রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক জ্যাম দেখেছি দিল্লীতে। এখন এই রাতের বেলায়ও জ্যাম হবে কিনা কে জানে! ফোন বাজছিল। আমার এডিটর স্যার (দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক) ফোন করেছেন। তিনি আমাদের খোঁজ খবর নিলেন। ফিরতে কতক্ষণ লাগবে জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, সবাই শপিং থেকে ফিরে এসেছে। হোটেলেই আছে। ডিনার হোটেলের রেস্টুরেন্টেই করবো। তোমরা পৌঁছে ফোন করিও। আমি স্যারের কথাতে সায় দিলাম।
আমরা একেবারে সময়মতো হোটেলে পৌঁছে গেলাম। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এডিটর স্যারকে ফোন করলাম। বললাম, আমরা রুমে আছি জানালাম। স্যার বললেন, আর দেরি করে লাভ নেই। সবাইকে ফোন করো। রেস্টুরেন্টে যাও। আমি তোমার ম্যাডামকে নিয়ে আসছি।
এই কাজটি বেশ ভালোই করতে পারি আমি। হোটেলের ইন্টারকম থেকে টিমের সকল সদস্যকে ফোন করা। প্রথমে ফোন করলাম, কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম কর্ণধার, সাবেক লায়ন গভর্নর লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়াকে। সুপ্রভা বৌদিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা বললাম। কোন ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট তা আবারো স্মরণ করিয়ে দিলাম। অতপর একে একে ফোন করলাম সাবেক গভর্নর লায়ন মনজুর আলম মনুজকে। রাশু ভাবীকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসার কথা বলে দিলাম। ফোন করলাম, লায়ন নিশাত ইমরানকে। কিন্তু ধরলেন লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনা। উনারা দুজন একই রুমে রয়েছেন। উনাদেরকেও রেস্টুরেন্টে যাওয়ার তাগাদা দিয়ে আমরা রুম থেকে বের হলাম। লিফটের দিকে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, ডিনারের চেয়ে বুঝি বিছানাটা জুরুরি ছিল! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।