(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দিল্লী শহরে ঘুরছি। ঘুরছি রাজপথ ধরে। কখনো ভিড়ভাট্টা ঠেলে অলিতে গলিতে, আবার কখনোবা চকচকে রাজপথ ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। প্রচুর গাড়ি রাস্তায়। মানুষও অনেক। দিল্লী শহরের ব্যস্ততা দেখে গল্প করছিলাম আমরা। গাড়ির চালকই আমাদের গাইড। তিনি আমাদের দিল্লী ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। আমরা পথঘাট কিছুই চিনি না, কিছু জানিও না। এতে করে নিজেদের তার উপর হাওলা করে দিয়েছি। কোথায় থেকে কোথায় যাবে বা কোনটির আগে কোনটি দেখবো সেই সম্পর্কে আমরা কোন মতামতই দিইনি। ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি তার সুবিধামতো আমাদের ঘুরিয়ে দেখাতে। তিনিই আমাদের দিল্লীর ঐতিহ্য মোড়ানো দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘোরাবেন, ঘোরাচ্ছেন।
শিখ ধর্মাবলম্বী ড্রাইভার নিজেকে সর্দার পরিচয় দিতেই যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। আমরাও যে কোন কথার শুরুতে সর্দারজী বলে শুরু করছি। শুরু করছি মানে আমি তেমন কিছু বলছি না, যা বলার আমার ঘরণীই বলছে। হিন্দীতে আমার দখল ‘ম্যারা ত্যারা’ কিংবা ‘হাম তুম’ পর্যন্ত, তবে আমার স্ত্রী মোটামুটি চালিয়ে নেয়ার মতো পারে। যেখানে সে আটকায় সেখানে আমার বডি কথা বলে উঠে। বডি ল্যাঙ্গুজ বা হাত ইশারায় না হলে খাস চাটগাইয়্যা দিয়েও বুঝানোর চেষ্টা করি। অবশ্য, সর্দারজীকে নিয়ে আমাদের এখনো তেমন কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি।
কুতুব মিনারে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে এখন আমরা ছুটছি লালকেল্লার পথে। কুতুব মিনারের নানা কিছু চোখের সামনে ভাসছিল। ভাসছিল ইতিহাস আর ঐতিহ্য। কি অসাধারণ দক্ষতায় গড়ে তোলা হয়েছিল কুতুব মিনার! এত বছর আগে উন্নত প্রযুক্তি ছাড়াই কুতুব মিনারের মতো অসাধারণ একটি স্থাপনা কি করে গড়ে তোলা হলো তা এক বড় বিস্ময় আমার কাছে। কি করে দেয়ালে দেয়ালে পরতে পরতে এত সুন্দর ক্যালিওগ্রাফি তৈরি করা হলো। আসলে প্রযুক্তি না থাকলেও মানুষ বুঝি তখনো অনেক মেধাবী ছিল, ছিল দক্ষও। প্রযুক্তির অভাব মানুষ মেধা দিয়ে ঘুচিয়ে ফেলতো।
লালকেল্লার গেটে এসে আমাদের নামিয়ে দিলেন সর্দারজী। বললেন, লালকেল্লার দুইটি প্রধান গেট। একটি লাহোরি গেট, অপরটি দিল্লী গেট। এটি দিল্লী গেট। আপনাদের এখানে নামিয়ে দিলাম, আবার এখান থেকেই তুলে নেবো। দিল্লী গেটের কথা মনে রাখবেন। সর্দারজী বেশ খোশ মেজাজে বললেন, কোন হুড়োহুড়ি করতে হবে না। ধীরে সুস্থে ঘুরে টুরে আসুন। অনেক সময় লাগবে। বের হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে আমাকে ফোন করবেন। এই দিল্লী গেটেই আমি থাকবো। আমাদের সবকিছু সুন্দর করে দেখারও পরামর্শ দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন।
লালকেল্লা দিল্লীর প্রধান টুরিস্ট স্পর্টগুলোর একটি। দিল্লীর প্রধান আকর্ষণও। প্রায় চারশ’ বছর আগেকার এই স্থাপনা আজো মানুষের নজর কাড়ে, মন ভোলায়। সুউচ্চ দেয়াল ঘেরা একটি স্থাপনা। লাল দেয়াল। এই লাল দেয়ালের জন্যই দুর্গটির নাম লালকেল্লা হয়ে গেছে! প্রচুর মানুষ প্রতিদিনই এই কেল্লা পরিদর্শন করেন। এতে করে বেজায় ভিড় লেগে থাকে কেল্লার টিকেট ঘরে। সারা দুনিয়ার হাজার হাজার মানুষ এই কেল্লা পরিদর্শন করেন। আমি নিজে লাইনে না দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে দিলাম। মহিলাদের লাইনটি কিছুটা ছোট বলে মনে হলো। বউ নিয়ে ঘোরার আরো একটি সুবিধা টের পেলাম। এখানেও বিদেশিদের জন্য টিকেটের দাম ভারতীয়দের তুলনায় আকাশ ছোঁয়া। এত বেশি যে মন খারাপ হয়ে যায়!
বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার স্ত্রী। আমিও লাইনের বাইরে তার পাশে পাশে এগুচ্ছি। গল্প করছি আমরা। লালকেল্লার গল্প! তাকে বললাম যে, লালকেল্লার এত কাছে যে আসতে পেরেছি সেটাই ভাগ্য মনে করো। মুঘল সাম্রাজ্যের রাজপ্রাসাদ হিসেবে এই কেল্লা থেকেই পুরো সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো। সম্রাট থাকতেন এখানে, থাকতেন সম্রাজ্ঞী। রাজপুত্র এবং রাজকন্যাদের পাশাপাশি উজির নাজিরের জমজমাট সব কাজ কারবার ছিল এখানে। ছিল সৈন্য সামন্ত, সেনাপতি। কেল্লার ধারে কাছে আসতে চাইলে কল্লা কেটে নেয়ার মানুষের অভাব ছিল না। আমাদের মতো অতি সাধারণ মানুষের এই কেল্লার ধারে কাছে ভিড়ারও সুযোগ ছিল না। থাকা স্বাভাবিকও নয়। বাংলাদেশের গণভবন কিংবা বঙ্গভবনের কাছ ঘেঁষতে কলজে টিপটিপ করে, আর এখন মুঘল সাম্রাজ্যের রাজপ্রাসাদে হাওয়া খাচ্ছ! স্ত্রী হাসলো।
লালকেল্লার ইতিহাস মনে হয় লেখার কোন প্রয়োজন নেই। তবে একটু স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য দু’চার লাইন লিখছি। এই কেল্লা নির্মিত হয়েছিল সম্রাট শাহজাহানের সময়। যমুনা নদীর প্রতি অন্যরকমের একটি আসক্তি ছিল সম্রাট শাহজাহানের। তিনি রাজধানী আগ্রা থেকে শাহজাহানবাদে (বর্তমানে পুরান দিল্লী) স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়ার দুর্গ নির্মাণের জন্য বেশ কয়েকটি জায়গা দেখেন। কিন্তু এখানেও তিনি যমুনা নদীর পাড়কেই পছন্দ করলেন। শাহজাহানবাদের যমুনা পাড়েই তিনি শুরু করলেন নতুন প্রাসাদ গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করেন। ১৬৩৮ সালে সম্রাট শাহজাহান দুর্গটির নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে নির্মাণ কাজ পুরোদমে শুরু হয় ১৬৩৯ সালের ১২ মে। ৮ বছর ১০ মাস ২৫ দিন ধরে কয়েক হাজার মানুষ নির্মাণ কাজ পরিচালনা করে ১৬৪৮ সালের ৬ এপ্রিল দুর্গটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। ওস্তাদ আহমদ লাহোরি ভারতীয়-ইসলামী এবং মোঘল স্থাপত্যকলার অপূর্ব এক মিশ্রয় ঘটিয়ে অসাধারণ নান্দনিকতায় ভরা এই কেল্লা নির্মাণ করেন। যমুনা পাড়ের এই দুর্গটির নাম তখন লালকেল্লা ছিল না, ছিল ‘কিলা-ই-মুবারক’ বা আশীর্বাদধন্য দুর্গ। দুর্গটিও মোটেই লাল ছিল না। দুর্গটির সুউচ্চ দেয়ালের বিভিন্ন অংশ নির্মিত হয়েছিল চুনাপাথর দিয়ে। শুভ্র শ্বেত বর্ণ ছিল দেয়ালের। দুর্গটি ছিল সাদা। কিন্তু একসময় এর শুভ্রতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ায় এর উজ্জ্বলতা মলিন হতে শুরু করে। পরবর্তীতে বৃটিশরা দুর্গের দেয়ালে লাল রং করে দেয়। এতে দুর্গটি অরজিন্যাল রঙ হারায়, সাথে জুটে যায় নতুন নামও। লালরঙেই দুর্গটির নাম লালকেল্লা হয়ে যায়। এই দুর্গের উত্তর পূর্ব কোণে সালিমগড় দুর্গ নামে অপর একটি প্রাচীন দুর্গ ছিল। লালকেল্লা নির্মাণের প্রায় একশ’ বছর আগে ১৫৪৬ সালে ইসলাম শাহ সুরি সালিমগড় দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। নতুন দুর্গ নির্মাণের পর দুইটি দুর্গ এক হয়ে যায়।
টিকেট নিয়ে হাসিমুখে লাইন থেকে বের হয়ে আসলো ঘরণী। আমরা বেশ আনন্দচিত্তে কেল্লার ভিতরে যাওয়ার জন্য হাঁটতে লাগলাম। কেল্লার দেয়ালগুলো সুউচ্চ। ১৮ থেকে ৩৩ মিটার অর্থাৎ ৫৯ ফুট থেকে ১০৮ ফুট পর্যন্ত। উচ্চতা বিচারে বর্তমানের দশতলা ভবনের সমান। চারশ’ বছর আগে কোন প্রযুক্তিতে এতো উঁচু দেয়াল নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল কে জানে! বিশাল চওড়া দেয়াল। বিশাল গেট, বিশাল দরোজা। তখনকার দিনের সবকিছুই বুঝি বিশাল বিশাল ছিল! লালকেল্লার ভিতরে ঢুকে আমাদের অনেকেরই বিস্ময়ের কমতি থাকে না। কেল্লা নির্মাণের পরিকল্পনা ও সাজসজ্জা দেখে মোঘল সম্রাট শাহজাহানের সময়কালের স্থাপত্যকলা এবং নির্মাণশৈলীর ব্যাপারে শ্রদ্ধা জাগে। কি অসাধারণ সব চিত্রকলা! বহু কিছু নেই, এই কেল্লার প্রায় সব সম্পদই লুট করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো ইট পাথরের পরতে পরতে যা রয়েছে তা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ঘোরলাগা চোখে আমরা চারদিকের সবকিছু দেখছিলাম। আমার স্ত্রীর বিস্ময়ের মাত্রা ছিল আরো কিছু বেশি। তার কথা হচ্ছে বর্তমানে এরূপ শত শত দুর্গ করার মতো প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি মানুষের হাতে এসে গেছে। বিজ্ঞানের জয়রথ মানুষকে বহুদূর নিয়ে গেছে। কিন্তু সেই অযান্ত্রিক যুগে, যখন মানুষের হাত এবং বাহুবলই ছিল সবকিছুর মূল তখন এমন নান্দনিক একটি স্থাপনা নির্মাণ কত কঠিন ছিল! মানুষের মেধা, রুচি আর শিল্পমনের যে পরিচয় লালকেল্লার ইট পাথরের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে রয়েছে তার তুলনা করা কঠিন। এমন অসাধারণ একটি কাজ সম্পন্ন করা কোনমতেই সহজ ছিল না। সহজ ছিল না মানুষের এমন স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া। অথচ সেই কঠিন কাজটিই আমাদের চোখের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক দুই বছর নয়, চারশ’ বছর! তাই এই লালকেল্লা শুধু একটি দুর্গই নয়, আরো বহু কিছু। এরসাথে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, ঐহিত্য। জীবনের নানা কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই দুর্গের পরতে পরতে। এরসাথে জড়িয়ে রয়েছে অগুনতি গল্প। রয়েছে প্রেমের গল্প, জয়ের গল্প। বিজয়ের গল্প, বিরহের গল্প। ইটপাথরের এই দেয়াল বুঝি আজো সেইসব গল্পে জীবন্ত হয়ে উঠে! (চলবে)।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।