আমেরিকা কানাডার পথে

এম. সোহেল খান টিপু | বুধবার , ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ at ৮:২৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বিকট শব্দে আমাদের গাড়ি পাশে গিয়ে পড়ল। কিন্তু আমাদের গাড়ির ক্ষতি হলেও ভাগ্যক্রমে আমরা সামান্য চোট পেলেও প্রায় অক্ষত ছিলাম। ছোট ভাই পুলিশকে কল করল, আমরা গাড়ির পাশে অপেক্ষা করতে লাগলাম। পিছনের গাড়ির আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলা চালকও পুলিশের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু কারও সাথে কোন কথা হল না বা আশেপাশে উৎসাহী কোন জনতার ভীড়ও দেখলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ উপস্থিত হল। পুলিশ এসে প্রথমে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করল আমাদের কোন চোট লেগেছে কিনা বা কোন চিকিৎসার দরকার আছে কিনা। তারপর জিজ্ঞাস করল আমরা গাড়ি নিয়ে অটোয়া ফিরতে পারব কিনা। আমাদের ঐ ব্যাপারে কোন সাহায্যের প্রয়োজন নেই বলাতে পুলিশ অফিসার পিছনের গাড়ির ভদ্র মহিলার গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির কাগজ পত্র দেখে গাড়িটাকে মহিলাসহ থানার দিকে নিয়ে গেল। আর আমার ভাইকে অটোয়া থেকে ইনস্যুরেন্সের দাবীর টাকা নিয়ে নিতে বলল।
কি সুন্দর ব্যবস্থা, কারও সাথে কোন ঝামেলা নাই, যা আমাদের দেশে কল্পনাও করা যায় না। দুর্ঘটনার কারণে আমাদের প্রায় ১ ঘন্টা সময় নষ্ট হয়। তারপর আমরা কাছের অলিম্পিক ভিলেজে ঢুকে মন্ট্রিল অলিম্পিকের রানী খ্যাত রোমানিয়ার বিশ্ববিখ্যাত জিমনেস্ট নাদিয়া কোমানিচির মূর্তি দেখলাম। পুরো ভিলেজ ঘুরে অলিম্পিকের বিভিন্ন স্মারক ও ছবি দেখে আর আমাদের ছবি তুলে মন্ট্রিল শহরটা ঘুরে বিকেলে নদীর তীরে একটা পার্কের মত জায়গায় বসলাম। জায়গাটা বেশ সুন্দর এবং প্রচুর টুরিস্ট। আমরা ওখানে বসে ফাস্টফুড ও কফি খেয়ে সন্ধ্যার দিকে অটোয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমরা রাত ৯টার দিকে অটোয়া এসে পৌঁছালাম।
পরের দিন আমাদের দূরে কোথাও যাওয়ার আর কোন পরিকল্পনা নাই শুধু আমাদের চট্টগ্রামের এক আত্মীয়ের ডিনারের দাওয়াত আছে। ঐদিন সকালে বের হয়ে আমার ভাইয়ের বাসার কাছেই কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর সরকারী বাসভবন দেখতে গেলাম। এলাকাটা নিরিবিলি ছায়াঘেরা সুন্দর কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষীর কোন বাড়াবাড়ি দেখলাম না। তারপর কানাডার পার্লামেন্ট বিল্ডিং দেখতে গেলাম।
বিল্ডিংটা বৃটিশ আমলের স্থাপত্যে নির্মিত সামনে ঐতিহাসিক অনেক ভাস্কর্য দেখলাম। আমরা এলাকাটা ঘুরে কিছু ছবি তুলে দুপুরে একটা জাপানী রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। বুফে খাবার অনেক রকম জাপানী, চীনা খাবারের আয়োজন। খাবারের মান ও খুব ভাল এবং স্বাদেও অতুলনীয়। তবে দাম একটু বেশী। বিকেলে আর কোন কাজ না থাকায় ভাইয়ের প্রস্তাবে সিনেপ্লেঙে ছবি দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা অনেকগুলো ছবির মধ্যে ভারতীয় অভিনেত্রী শ্রীদেবীর মেয়ে এবং শাহেদ কাপুরের ভাই অভিনীত ‘ধড়াক’ ছবিটি দেখলাম। সুন্দর পারিবারিক পরিচ্ছন্ন ছবি। হল থেকে বের হয়ে আমরা দাওয়াত খেতে একটা ভারতীয় রেস্টুরেন্টে গেলাম। খাবারের পরিমাণ ও মানের তুলনায় দাম খুব যৌক্তিক মনে হল। খাবার খেতে খেতে অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ হল। আমাদের হোস্ট ভদ্রলোক এবং ওনার স্ত্রী বেশ আলাপী ও আন্তরিক। ডিনার শেষে ফিরার পথে ভাই হোমলেস লোকজনের একটা আবাস্থল দেখাল। সরকারি ভাবে হোমলেস লোকজনের জন্য এই ব্যবস্থা।
বাসায় ফিরে লাগেজ গুছিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে অটোয়া থেকে টরেন্টো হয়ে নিউইয়র্ক যাওয়ার ফ্লাইট। ভাই আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে গেল। আমি চেক ইন করে এয়ার কানাডার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে প্রায় ২ ঘন্টা সময়ে টরেন্টো এসে পৌঁছলাম। টরেন্টোতে প্রায় ২ ঘন্টা যাত্রা বিরতি এই ফাঁকে আমি সেন্ডউইচ ও কফি দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিয়ে নির্ধারিত সময়ে চেক ইন করে এয়ার কানাডার নিউইয়র্কের ফ্লাইটে উঠলাম কিন্তু ফ্লাইট ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে প্রচণ্ড বজ্রপাত সহ বৃষ্টি শুরু হল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য ফ্লাইট ছাড়তে ১ ঘন্টা দেরী হল। টরেন্টো থেকে নিউইয়র্ক পৌঁছাতে সময় লাগল মাত্র ১ ঘন্টা ১৫ মিনিটের মত। বিমান ঔঋক বিমান বন্দরে নামার পূর্বে আকাশ থেকে নিউইয়র্কের আকাশ চুম্বি অট্টালিকাগুলি পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। অবতরণের পর লাগেজ নিয়ে বের হতে বেশী সময় লাগল না কারণ ইমিগ্রেশন ফরমালিটিজ গুলি টরেন্টোতে হয়ে গেছে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে পূর্ব নির্ধারিত ম্যানহাটনের একটি পাঁচতারকা হোটেলে উঠলাম। হোটেলে চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যার দিকে রাতের নিউইয়র্ক দেখার জন্য বের হলাম, ম্যানহাটনের বিভিন্ন রাস্তায় পর্যটক গিজ গিজ করছে। কেউ কেউ দেখলাম গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে বা দলবেঁধে নেচে নেচে টাকা নিচ্ছে। এক তরুণীকে দেখলাম শরীরে পেইন্টিং করে নাচছে। রাত যত বাড়ছে মানুষের ভীড় এবং হই হুল্লোড় ততই বাড়ছে। নিউইয়র্ক যে কখনও ঘুমায় না তা চোখে দেখলাম। চারিদিকে সুউচ্চ অট্টালিকা গুলিতে আলোর ঝলকানি। এলাকাটিতে প্রচুর নাইট ক্লাব এবং বার। ঐগুলি থেকে উচ্চস্বরে গান শুনা যাচ্ছিল। আমি ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে আসলাম। পরের দিন বুফে আমেরিকান ব্রেকফাস্ট সেরে নিউজার্সি গেলাম। নিউ জার্সিতে ঘুরাঘুরি করে জার্সি মল নামে একটা শপিং মলে গেলাম। ঐ মল ঘুরে আমার জন্য একজোড়া জুতা কিনলাম। দাম বেশী হলেও মান খুব ভাল।
বিকেলে নিউইয়র্ক ফিরে এসে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা শেষে হোটেলে ফিরে আসলাম। পরের দিন এই যাত্রায় নিউইয়র্কে আমার শেষ দিন তাই সকাল সকাল বের হয়ে নিউইয়র্ক থেকে একটু দূরে কনি আইল্যান্ড এ গেলাম। নিউইয়র্ক থেকে ট্রেনে যেতে সময় লাগল প্রায় ১ ঘন্টার মত। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে এই দ্বীপে বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত এবং নানা রকম রাইড সমৃদ্ধ একটি বিশাল পার্ক আছে। দেশী বিদেশী প্রচুর পর্যটক এবং সমুদ্র সৈকতে প্রচুর বিকিনি পরা রমনী। যে যার মত সমুদ্র স্লানে ব্যস্ত। সমুদ্র তীরে মহিলা এবং পুরুষের জন্য আলাদা কাপড় বদলানোর ব্যবস্থা। আমি সমুদ্রের তীর ধরে কিছু দূর হেটে একটু পা ভিজিয়ে নিউইয়র্কে ফিরে আসার জন্য ট্রেন ধরলাম। হোটেলে ফিরে এসে লাগেজ গুছিয়ে ডিনার শেষে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম কারণ পরের দিন সকালে দেশে ফিরার ফ্লাইট ধরার জন্য ভোরে উঠতে হবে। যথাসময়ে নিউইয়র্ক ঔঋক এয়ারপোর্ট পৌঁছে কাতার এয়ারওয়েজের কাউন্টারে চেক ইন করে ফ্লাইট ধরলাম। কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইট দোহায় যাত্রা বিরতি শেষে পরের দিন ঢাকা পৌঁছলাম এবং ঢাকা থেকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছালাম। আসার পর আমার মনে হল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জায়গা আমার দেশ। এত আপন ও প্রশান্তির জায়গা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও সাবেক ব্যাংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপলব্ধি
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে