দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চমৎকার কিছু ব্যাপার স্যাপারের মাঝ দিয়ে শুরু হয়েছিল সকাল। দারুণ একটি দিনের শুভসূচনা বলে মনে হচ্ছিল। সাত-সকালে চন্ডীগড় শহরের চমৎকার পরিবেশ দেখে ভালো হয়ে উঠেছিল মন। সুখনা লেকের সুশীতল জলরাশি এবং ধারে কাছের প্রাকৃতিক পরিবেশ মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। লেকের পাড়ের পরিবেশ এবং প্রকৃতির নানা আয়োজন মনে যেমন নাচন ধরিয়েছিল, তেমনি রক গার্ডেনের অতিমাত্রিক ব্যাপার স্যাপারেও ভরে উঠেছিল মন। শিল্প সংস্কৃতির তেমন কিছু না বুঝলেও দারুণ একটি সকাল পেয়ে বর্তে গিয়েছিলাম।
নাস্তার টেবিলে বসে সকালের সুখনা লেক দর্শনসহ নানা কিছুর বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। তিনি এত সুন্দর করে গুছিয়ে গুছিয়ে সবকিছুর বর্ণনা দিচ্ছিলেন যে, সুখনা লেক গল্পে যেন অধিক মুগ্ধকর হয়ে উঠছিল। আমারই আফসোস হচ্ছিল, কেন যে স্যারের মতো করে দেখতে পারলাম না। শুধু সুখনা লেকই নয়, ধারে কাছের সবকিছুর এত সুন্দর বর্ণনা গুছিয়ে দিচ্ছিলেন যে আমার আবারো সেখানে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমাদের সফরসঙ্গি লায়ন নিশাত ইমরান, লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী এবং আমার স্ত্রী তাদের বাদ দিয়ে যাওয়ায় কিছুটা ক্ষোভও প্রকাশ করলেন। আমার ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেক এবং লায়ন সুপ্রভা বৌদি মুখে কিছু না বললেও বেশ বুঝতে পারছিলাম ওনারাও মিস করছেন। অবশ্য লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া সকালে মন ভরে ঘুমানোর তৃপ্তিতে বেশ সন্তুষ্ট ছিলেন।
নাস্তা পর্ব শেষ হয়েছে আমাদের। দ্বিতীয় দফা কফি চলছিল। রাজকীয় ব্রেকফাস্টের কথা আগেই বলেছি। অগুনতি আইটেমের নাস্তা। থরে থরে সাজানো। টেবিলে নাস্তা, গ্যালারীতে নাস্তা, শোকেসে নাস্তা। চারদিকে যেন নাস্তার ছড়াছড়ি। চা ও কফি দেয়া হয়েছে অনেক ধরনের। গ্রীণ টি, রেড টি, ব্ল্যাক টি, রেডি টিসহ নানা আয়োজন। কফির পাত্রেও ভিন্নতা টের পেলাম। রাখা হয়েছে কফির বৈয়ামও। নিজের মতো করে গুঁড়ো গুলিয়ে দুধ চিনি মাখন বাটার সব মিশিয়ে খেতে চাইলেও কোন সমস্যা নেই। সবকিছুর যোগানই রয়েছে। স্বাদ গন্ধও অচিন অচিন। হোটেল তাজ চন্ডীগড় কাস্টমারদের মন ভরাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে বলেও মনে হলো। অবশ্য, এই হোটেলের এক রাতের ভাড়ার কথাটা নাইবা বললাম!
লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘রেডি হতে হবে। চল যাই।’ হ্যাঁ, আমাদেরকে ফ্লাইট ধরতে হবে। যেতে হবে বিমানবন্দরে। দুপুরে ফ্লাইট। তাই রয়ে সয়ে হোটেল থেকে বের হলেই হবে। গুগল ম্যাপে দেখে নিলাম যে, আমাদের হোটেল থেকে ১২ কিলোমিটার দূরেই চন্ডীগড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আমরা দিল্লী যাবো। দূরত্ব মাত্র আড়াইশ’ কিলোমিটার। আমাদের ট্রাভেলার্স বেশ স্বাচ্ছন্দে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু কেন যে, আবার বিমানে টিকেট কাটা হলো কে জানে! আমাদের ট্যুর অপারেটর লায়ন আনোয়ারুল আজিম নিশ্চয় আমাদের ভালোর জন্যই সড়ক পথের পরিবর্তে আকাশ পথের ব্যবস্থা করেছেন। তবে বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া থেকে শুরু করে এয়ারপোর্টে গিয়ে নানা ঝক্কিঝামেলা সয়ে অপেক্ষা করা, পঞ্চান্ন মিনিটের ফ্লাইটাইম এবং বিমান থেকে নেমে গন্তব্যে পৌঁছতে যতটুকু সময় লাগবে ততক্ষণে ট্রাভেলার্স আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে বলে মনে হলো। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। ফ্লাইটের টিকেট কাটা হয়ে গেছে বহু আগে। অতএব নাস্তার টেবিল ছাড়তে হলো।
আমাদের ব্যাগ গোছানো ছিল। এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। দরোজার সামনে লাগেজ রেখে রুম সার্ভিসে ফোন করলাম। আমাদের চেক আউটের কথা জানিয়ে লাগেজগুলো নিচে নামানোর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলাম। সবগুলো রুমের নম্বরও বলে দিলাম। ট্রাভেলার্সের ড্রাইভারকে ফোন করে আসতে বললাম। তিনি হোটেলের সামনে পার্কিং-এ আছেন বলে জানালেন। বললেন, আপনারা বের হলেই আমাকে দেখতে পাবেন। অতএব আমাদের আর কোন কাজ নেই।
নিচে নেমে রিসিপশনে চাবি দিলাম। মিনিবার থেকে আমরা কিছু খাইনি তাও জানালাম। তবুও রিসিপশনের তরুণী কাকে যেন ফোন করে রুম নম্বর বললেন। আমরা চেক আউট করছি বলেও জানিয়ে দিলেন। মনে হলো এর থেকে বেশী কিছু আর বলতে হয় না। বাকি কাজ ফ্লোর ইনচার্জই করে নেন। তিনি রুমে গিয়ে ফ্রিজ খুলে দেখে নেন যে, সেখানে মদ বিয়ারের যেই যোগান আছে সেগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা, চিপস চকলেট বা বিস্কুট ঠিকঠাকভাবে আছে কিনা। না থাকলে আমাদের কাছ থেকে মূল্য আদায় করা হবে, থাকলে ঠিক আছে। আমরা কেউই মদ বিয়ারের ধারে কাছে যাইনি। অবশ্য কেউ চকলেট বা বিস্কিট টিস্কিট খেয়েছেন কিনা কে জানে! অবশ্য, অল্পক্ষণের মধ্যেই তরুণী আমাদের ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দিলেন। দারুণ এক হাসি দিয়ে বিদায় জানালেন।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও এই ‘হোটেল ক্লিয়ারেন্স’ নিয়ে ছোট্ট একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করে রাখি। যেটি ভবিষ্যতে বিদেশভ্রমণকারীদের কারো কারো কাজে লাগতে পারে। ঘটনাটি প্যারিসের। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের অতিথি হিসেবে প্যারিস গিয়েছিলাম। ওটি ছিল প্যারিসে আমার তৃতীয় সফর। আমাদের রাখা হয়েছিল একটি পাঁচ তারকা হোটেলে। সপ্তাহ খানেক প্যারিসের ওই হোটেলে থেকে আমি নরওয়ে চলে যাই। ওখান থেকে সুইডেন, ডেনমার্কসহ বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে টুরে আমি হাজির হয়েছিলাম লন্ডনে। লন্ডনে বেশ ব্যস্ত সময় কাটানোর সময় আমার ঘরনী ফোন করে জানালো যে, যারা আমাকে প্যারিস নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের এক কর্মকর্তা আমাকে পাগলের মতো খুঁজছেন। আমার স্ত্রীর কাছে একটি ফোন নম্বর দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব আমি যেন ওই নম্বরে তার সাথে যোগাযোগ করি সেই তাগাদা দিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা আমার স্ত্রীকে বলেছেন যে, প্যারিসের যে হোটেলে তারা আমাকে রেখেছিলেন সেখানে কোন ইনফরমেশন না দিয়ে এবং চেক আউট না করে আমি অজ্ঞাত স্থানে চলে গেছি। হোটেল কর্তৃপক্ষ আমার রুমটি ওভাবেই রেখে দিয়েছে। খোলেনি। এখন তারা বেশ কয়েকদিনের বাড়তি ভাড়া চার্জ করছে। আমি যেন দ্রুত ওই কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করি।
লন্ডন সফরে আমার ফুরফুরে মেজাজে দারুণভাবে বজ্রপাত হলো। বলে কি! হোটেল থেকে চলে আসার সময় যে চেকআউট করতে হয় সেই নিয়ম কি প্যারিসে ভুলে গিয়েছিলাম!! না, বেশ মনে আছে আমার। অত্যন্ত ছোটোখাটো টাইপের এক তরুণী আমার চাবি বুঝে নিয়েছিলেন। ক্লিয়ারেন্স দিয়েছিলেন। তাহলে! সমস্যা কোথায়!! বেড়ানো শিকেয় তুলে লন্ডনে যেই বাসায় উঠেছিলাম দ্রুত সেখানে ফিরি। নিজের ব্যাগ তন্নতন্ন করে খুঁজে প্যারিসের ওই হোটেলের ক্লিয়ারেন্সের কাগজটি খুঁজে বের করি। কাগজটি হাতে পেয়ে আমার পরানে পানি এসেছিল। হোটেল ক্লিয়ারেন্সের কাগজটির ছবি তুলে দ্রুত হোয়াটস আপে ওই কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। একই সাথে পাঠিয়ে দিলাম স্ত্রীর কাছেও। টেলিফোনেও ওই কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলাম। নিজের অবস্থান এবং অবস্থা ক্লিয়ার করলাম। ভাগ্যকেও ধন্যবাদ দিলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে প্যারিসের হোটেলের একটি উটকো কাগজ লন্ডন পর্যন্ত বহন করার কথা নয়। আমার মতো একজন অগোছালো মানুষের পক্ষে তো তা একেবারেই অসম্ভব। ব্যাগের কোণায় ভাগ্যক্রমে ফেলে রাখা কাগজটি শুধু আমাকে স্পন্সর করে বিদেশ নিয়ে যাওয়া ওই কোম্পানির অর্থই নয়, ঘরে বাইরে আমারও ইজ্জত রক্ষা করেছে। কাগজটি না থাকলে আমি কোনভাবেই কাউকে বিশ্বাস করাতে পারতাম না যে, আমি রিসিপশনে চাবি জমা দিয়ে যথাযথ নিয়ম মেনেই চেক আউট করেছি। ওই কোম্পানি বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাই শুধু নয়, আমার স্ত্রীও মনে করতেন যে ‘উজবুক, হোটেল ব্যবহারই জানে না।’ প্যারিসের ওই হোটেল শেষতক নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ‘সরি’ বলেছিল বলে ওই কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছিলেন। অবশ্য, ওই ঘটনায় লন্ডন টাওয়ারের সামনে রিসিভ করা একটি ফোনে স্ত্রীর কণ্ঠে যেই উদ্বেগ আমি টের পেয়েছিলাম তা একজীবনে আর আমার ভোলা হলো না। এতে করে যখনি যেখানেই যাই না কেন, হোটেল ক্লিয়ারেন্স ছাড়া আমি রিসিপশন ছাড়ি না। বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হলেও হোটেল তাজ চন্ডীগড় ছাড়ার সময় আমার মনে পড়ে গেল।
যাক, আমাদের সব লাগেজ ট্রাভেলার্সের পেটে ঢুকে গেছে। হোটেলের লোকজন এবং আমাদের ড্রাইভার মিলে লাগেজগুলো গুছিয়ে নিয়েছেন। আমরা সিটে সিটে বসে গেলাম। গন্তব্য এয়ারপোর্ট। চন্ডীগড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ভারতে পঞ্চাশটিরও বেশি বিমানবন্দর রয়েছে। এর অনেকগুলোই আবার আন্তর্জাতিক। চন্ডীগড় থেকে ভারতের নানা স্থানের পাশাপাশি বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যেও হরদম ফ্লাইট চলাচল করছে। এতে করে চন্ডীগড় বিমানবন্দরকে যতটুকু মফস্বলীয় ভাবছিলাম তা কিন্তু নয়। হরিয়ানা এবং হিমাচল প্রদেশের বিমানবন্দর হিসেবে এটির বেশ ব্যস্ততা রয়েছে। গেটে নানা ধরনের তল্লাশী সামাল দিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। ফ্লাইট সিডিউল দেখতে গিয়ে টের পেলাম যে, আমাদের ফ্লাইট আপাতত এক ঘন্টার ডিলে দেখাচ্ছে। বাকিটা সময়ই বলে দেবে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভবিষ্যৎমুখী সমাজবিজ্ঞান
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে সাংবাদিকতার উত্থান ও ‘আজাদী’